|
ইকতেদার আহমেদ
|
|
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার বিপন্ন : নেপথ্যে কারা
09 December 2024, Monday
সাধারণ অর্থে মানবাধিকার বলতে একজন মানুষের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারকে বুঝায়। একজন মানুষ যেকোনো রাষ্ট্রের বা সমাজে মানুষ হিসেবে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইলে তার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অধিকার ভোগের বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদানের আবশ্যকতা দেখা দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানবাধিকারের বিষয়গুলো নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্যোগ নেয়। এ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জাতিসঙ্ঘ। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘের সদস্য। মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের যেসব দলিল রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৪৮ সালে ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার দলিল। এই দলিলে ৩০টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এ দলিলে যেসব অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সদস্যভুক্ত সব রাষ্ট্রকে প্রতিপালনে নিশ্চয়তা দিতে বলা হয়েছে; তার মধ্যে অন্যতম হলো ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য না করার অধিকার; জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিনিরাপত্তার অধিকার; দাসত্বের শিকল থেকে মুক্তির অধিকার; যন্ত্রণা, নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড বা ব্যবহার হতে সুরক্ষর অধিকার; আইনের দৃষ্টিতে সর্বত্র মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার সম-অধিকার এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার; স্বেচ্ছাচারী গ্রেফতার, আটক ও নির্বাসন থেকে অবমুক্তির অধিকার; ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিয্ক্তু ব্যক্তির আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রæত ও প্রকাশ্য বিচার পাওয়ার অধিকার; স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত দ্বারা দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আদালতের সম্মুখে নিরপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার অধিকার; প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে নিজ গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার; চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার; রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে চলাফেরা ও বসবাসের অধিকার এবং রাষ্ট্র ত্যাগ ও পুনঃপ্রত্যাবর্তনের অধিকার; নিজ দেশে নিপীড়নের বিরুদ্ধে অপর দেশে আশ্রয় লাভের অধিকার; জাতীয়তার অধিকার এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত না করার অধিকার; প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পরুষের নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার; একক ও যৌথভাবে সম্পত্তির মালিকানার অধিকার এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হওয়ার অধিকার; চিন্তা, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার; বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার; শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংগঠনের অধিকার; সরাসরি অথবা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ পেতে সুযোগের সমতার অধিকার; সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার; পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতার অধিকার এবং কোনো প্রকার বৈষম্য ভেদে সমকাজে সমমজুরির অধিকার; নিজ স্বার্থ সংরক্ষণে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও যোগদানের অধিকার; অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণগুলোর অধিকার প্রভৃতি।
জাতিসঙ্ঘের সদস্যভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের সংবিধানে উপরোক্ত অধিকারগুলোর সব বা কিছু মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। যখন কোনো রাষ্ট্রের সংবিধানে কিছু অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় তখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সেসব অধিকার ভোগের বিষয়ে নাগরিকদের নিশ্চয়তা প্রদান আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।
মানবাধিকারের সাথে গণতন্ত্রের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র একটি অন্যটির পরিপূরক। পাশ্চাত্যের বেশির ভাগ দেশ যার মধ্যে অন্যতম হলো- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবি করে থাকে। এর পাশাপাশি তারা নিজ দেশ ও অপরাপর দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় সচেষ্ট বিশ্ববাসীকে এমন ধারণা দিতে সদা তৎপর। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি পাশ্চাত্যের এসব দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে নিজ নিজ দেশের ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গি তা সমভাবে অন্য অনেক রাষ্ট্রে ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের প্রথমার্ধে ঠাণ্ডা লড়াই যুগের অবসান-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে মহাশক্তিধর রাষ্ট্ররূপে পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানটি বর্তমানে আগের মতো দৃঢ় না হলেও অদ্যাবধি বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্র মহাশক্তিধর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষের পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি। এ সুযোগে বিগত দু’দশকের বেশি সময় ধরে য্ক্তুরাষ্ট্র তার ইউরোপীয় মিত্রদের সহযোগিতায় অবলীলায় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে জনমানুষের জীবন বিপদাপন্ন করে তুলছে।
সাদ্দাম হোসেন শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালীন ইরাকের কাছে মানববিধ্বংসী রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র রয়েছে- এ মিথ্যা অজুহাতে য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনের বাহিনীকে পরাভ‚ত করে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরাসরি রাষ্ট্রটি পরিচালনা করতে থাকে। সাদ্দামকে উৎখাত-পরবর্তী দেখা গেল ইরাকে কথিত মানববিধ্বংসী রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের উদ্দেশ্য ছিল তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং উৎখাত-পরবর্তী দেখা গেল ইরাকের তেল বিক্রি করে তারা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ পরিপূরণে সফল হয়েছে।
অনুরূপ আফগানিস্তানে তথাকথিত আলকায়েদা জঙ্গিদের ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণশিবির রয়েছে- এ অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তানে বলপূর্বক প্রবেশ করে সেখানকার সকারের পতন ঘটিয়ে নিজেদের তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনীর অভিযান পরিচালনার এক দশক পর দেখা গেল তথাকথিত আলকায়েদা জঙ্গি দমনে যে অভিযান তা সফলতা পায়নি বরং তাদের অভিযানের ফলে রাষ্ট্রটির স্থিতিশীলতা বিপন্ন হওয়ায় সেখানে জনজীবনে এখনো স্বস্তি ফিরে আসেনি।
বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রারম্ভে আরব বসন্তের জাগরণে তিউনিশয়া, লিবিয়া ও মিসরে ক্ষমতাসীন বেন আলি, গাদ্দাফি ও মোবারক সরকারের পতন হয়। লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতন ত্বরান্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী অংশগ্রহণ করেছিল। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল গাদ্দাফি তার শাসন অব্যাহত রাখতে অবলীলায় বিরোধীদের হত্যা করে চলেছেন। য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাদের কল্পনাপ্রসূত অভিযোগের ভিত্তিতে ঠিকই গাদ্দাফিকে উৎখাত ও হত্যা করল। কিন্তু তার মৃত্যু-পরবর্তী গাদ্দাফির শাসনামলে লিবিয়ায় যে স্থিতিশীলতা ছিল তা কি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ফিরিয়ে দিতে পেরেছে? এখনো যে লিবিয়ায় প্রতিদিন সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের সশস্ত্র সংঘর্ষে অগণিত লোক নিহত হচ্ছে, এর দায় কার?
মিসরে হোসনি মোবারকের পতন-পরবর্তী অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুড বিজয়ী হয়ে ড. মুরসি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হলে দেশটি স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু য্ক্তুরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদেরসহ ইসরাইলের কাছে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিজয় আরব ভূ-খণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র এবং ইসরাইলের জন্য হানিকর এই বিবেচনায় তারা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসিকে অপসারণ করে ক্ষান্ত হয়নি বরং জেলে পুরে বিচারের সম্মুখীন করেছে। য্ক্তুরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ও ইসরাইল যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে থাকে তবে কী কারণে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসিকে অপসারণ করা হলো এর জবাব বিশ্ববাসী য্ক্তুরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ও ইসরাইলের কছে জানতে চায়।
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে এখনো বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রয়েছে। এ ধরনের বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক শাসন ইসলাম ধর্ম অনুমোদন করে না। কিন্তু এখনো য্ক্তুরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ও ইসরাইলের মদদে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশগুলোতে রাজতান্ত্রিক শাসন টিকে আছে। এসব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অবস্থান রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ও ইসরাইল এসব রাষ্ট্রে রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জুগিয়ে তাদের ব্যবসায়কি ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দাবিতে ১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েনমিয়েন স্কোয়ারে হাজার হাজার লোক সমবেত হলে চীনের কমিউনিষ্ট শাসকরা নির্বিচারে গুলি করে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। এ হত্যার ব্যাপারে য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় এবং আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চীনকে চিহ্নিত করতে পুনঃপুন প্রয়াস নেয়। সে প্রয়াস এখনো অব্যাহত আছে।
চীনে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের নির্মূলে যে সংখ্যক মানুষ হত্যা করা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মদদে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের যেভাবে হত্যা করে চলেছে; তাতে দেখা যায় তার সংখ্যা তিয়েনমিয়েনের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যার চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি। ইসরাইলের অভ্যন্তরস্থ গাজা ও পশ্চিমতীর দু’টি স্বশাসিত পৃথক এলাকা। এ দু’টি পৃথক এলাকা সমন্বয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র সম্মত হয়ে এরূপ রূপরেখা দিয়েছে।
২০০৬ সালে গাজা ও পশ্চিম তীর সমন্বয়ে গঠিত ফিলিস্তিনের ১৩২টি আসনের সংসদ নির্বাচনে ৭৬টি আসনে জয়লাভ করে হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনপরবর্তী গাজা হামাসের শাসনাধীন রয়েছে। অন্য দিকে পশ্চিমতীর ফাতাহর শাসনাধীন। ১৯৪৮ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদিদের এনে ফিলিস্তিনিদের ভূ-খণ্ডে যে ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়; এর পর থেকে য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ইন্ধনে ক্রমান্বয়ে ইসরাইল ভূ-ভাগ বাড়িয়ে চলেছে, তা এখনো অব্যাহত আছে।
জুলাই, ২০১৪ সালে পশ্চিমতীরে তিনটি ইহুদি বালককে অপহরণপূর্বক হত্যার অভিযোগে ইসরাইল গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধে গাজানিবাসী প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল; যার অধিকাংশ নারী ও শিশু। সামরিক শক্তির দিক থেকে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর তুলনায় হামাসের কোনো তুলনা হয় না। ইসরাইলের এ আগ্রাসী অভিযান বিষয়ে য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বলছে তাদের আত্মরক্ষায় এ ধরনের অভিযানের আবশ্যকতা রয়েছে। পশ্চিমতীরে যে তিনজন ইসরাইলি বালক নিহত হয়েছিল তার সাথে যে হামাসের সম্পৃক্ততা ছিল না বিষয়টি বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। কিন্তু তারপরও নিজেদের আত্মরক্ষা করার মিথ্যা অজুহাতে শক্তিধর ইসরাইলের দুর্বল হামাসের ওপর কেন এ হামলা? ইসরাইল যদিও মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ডে অবৈধভাবে সৃষ্ট একটি রাষ্ট্র কিন্তু ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূ-খণ্ডে তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র সৃষ্টি হোক এটি কখনো ইসরাইল ও তার মদদদাতা য্ক্তুরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো চায় না। আর তাই পুনঃপুন ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসী আক্রমণ এবং নির্বিচারে নারী-পুরুষসহ নিরীহ বেসামরিক মানুষ হত্যা। য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন ব্যতীত ইসরাইলের পক্ষে কখনো এ ধরনের গণহত্যা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ডে ইসরাইলের আগ্রাসী আক্রমণ বিশ্ববিবেকের কাছে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে এটি মানবতাবিরোধী অপরাধ বা গণহত্যা বলে বিবেচিত নয়।
২০২৩ সালের অক্টোবরের শুরুতে রকেট হামলা করে ইসরাইলের দীর্ঘ দিনের সামরিক আগ্রাসনের সমোচিত জবাব দেয়ার কার্যকর উদ্যোগ নেয় হামাস। তাতে উভয়পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি হলেও ইসরাইলের তুলনায় গাজার ক্ষতি ও জীবনহানি ব্যাপক ও বর্ণনাতীত। এ লড়াই এখনো অব্যাহত আছে। এ লড়াইয়ে লেবাননে অবস্থিত ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ জড়িয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান না হলে এটি ইসরাইল কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অমানুষিক ও অমানবিক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল নজির হয়ে আছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী তাদের সংখ্যানুপাতে সরকারি চাকরিসহ সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে এগিয়ে। তবু আমাদের পাশের বৃহৎ রাষ্ট্রটি তাদের অনুগত সরকারের অবসানে সর্বদা এ দেশের স্থিতিশীলতার প্রতিক‚লে অবস্থান গ্রহণে সচেষ্ট এমনটি প্রতিভাত।
ভারত নিজেকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দাবি করলেও দেশটির শাসন ক্ষমতায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আগমন-পরবর্তী দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্রমাবনতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভারতে বসবাসরত সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-ষষ্ঠমাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী দেশটিতে চরমভাবে অবহেলিত ও অধিকারবঞ্চিত। ক্ষণে ক্ষণে লাঞ্ছনার শিকার। কিন্তু ভারতে কয়েকটি রাজ্যে খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর অধিকারবঞ্চনা মানবাধিকারের বিশ্বমোড়লদের বিবেককে জাগ্রত করেছে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পদদলিত করে বিগত ১৫ বছরের বেশি সময় জগদ্দল পাথরের মতো স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার অবৈধ শাসন চিরস্থায়ী করার মানসে যেভাবে বিচারবহিভর্‚ত হত্যা, গুম, খুন, অবৈধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে জীবনহানি এবং ভুয়া ও মিথ্যা মামলায় বিরোধীশিবিরের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করে এ দেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম নজির সৃষ্টি করেছে; তা কখনো এ দেশের সচেতন নাগরিক বিস্মৃত হবেন না।
য্ক্তুরাষ্ট্র ও তার মিত্র এবং সহযোগী দেশগুলোর মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ে দ্বৈতনীতিতে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উভয়ের আক্ষরিক অর্থ ভিন্নতর। এ ভিন্নতার কারণে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পদে পদে দুর্বল দেশগুলোর জন্য প্রায়ই বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দেয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতিবিশ্লেষক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন