|
আলী ইমাম মজুমদার
|
|
আমাদের অগ্নিকোণের দিগন্তে রুপালি রেখা
03 September 2016, Saturday
রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। নৌকায় করে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে তারা ছোটে আশ্রয়ের সন্ধানেমিয়ানমারের রাজধানী নেপিডো থেকে একটি চমক সৃষ্টিকারী খবর এসেছে। সেখানে সরকারের মূল নেতা অং সান সু চি রাখাইন কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করেছেন। কমিশনের নেতৃত্ব দেবেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। আরও নয়জন সদস্য থাকছেন কমিশনে। তাঁদের ছয়জন সে দেশের। এতে বৌদ্ধ ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের প্রতিনিধি থাকার কথা রয়েছে। কমিশনে তিনজন বিদেশিও থাকবেন। কমিশন সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত জানা যায়নি বটে। তবে এটা জানা গেছে, তাঁরা ৫ সেপ্টেম্বর ইয়াঙ্গুনে প্রথম বৈঠকে বসছেন। এক বছর সময়কালের মধ্যে রাখাইন প্রদেশের নৃতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসহ সব দিক বিস্তারিত পর্যালোচনা করবেন। সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কী কী উদ্যোগ প্রয়োজন, তা-ও চিহ্নিত করবেন। এর আলোকেই কমিশনের প্রতিবেদন তৈরি হবে। স্বাভাবিকভাবে সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মিয়ানমার সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।
রাখাইন রাজ্যের জাতিগত সমস্যা যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, এ অবস্থায় অং সান সু চির আলোচিত উদ্যোগ সন্দেহাতীতভাবে সাহসী ও প্রশংসনীয়। তিনি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে অকুতোভয় ভূমিকায় ছিলেন। তবু পেছনে হটেননি। বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত করেছেন জনগণের সরকার। আইনের মারপ্যাঁচে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। তবে প্রকৃত ক্ষমতা তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। রাখাইন রাজ্যের জাতিগত সংঘাতে তাঁর তখনকার ভূমিকায় আমরা কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম। তবে তাঁকে জানতাম বলে ব্যর্থ নমস্কারে ফিরিয়ে দিইনি। বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপরীতে নিপীড়িত একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পক্ষে যেতে পারে এরূপ কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে আটঘাট বেঁধে নামতে হয়। তাই হয়তো কিছুটা সময় নিয়েছেন। তবু তো একটি শুভ সূচনা হলো। কমিশনের গঠনকাঠামো ও কার্যপরিধি আশা জাগানোর মতো।
প্রথমত উল্লেখ করতে হয়, মিয়ানমার ৬ লাখ ৭৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি বিশাল দেশ। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী এর জনসংখ্যা ৫ কোটি ১৫ লাখের মতো। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনঘনত্ব ৭৬। প্রভূত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ ব্যাপক। দীর্ঘকালের সামরিক শাসন এর প্রায় সব গণতান্ত্রিক অবকাঠামো বিনষ্ট করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। গড়ে ওঠেনি দক্ষ জনশক্তি। তাই দেশটি দারিদ্র্যে ধুঁকছে। তার মধ্যেও সম্পূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা নিল অং সান সু চির দল। বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা সামরিক বাহিনীর সঙ্গেও একটি কার্যকর সমঝোতা গড়ে তুলেছে। নতুন মিয়ানমার গড়ার দায়িত্ব অং সান সু চির দলের হাতে। জরাজীর্ণ অতীত আর সমস্যাসংকুল বর্তমানকে পেছনে ফেলে তাদের যোজন-যোজন দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। এতে বাধা আসবে। সময়ও লাগবে। দেশটির একটি বড় সমস্যা বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে সংঘাত। সেই সংঘাত ক্ষেত্রবিশেষে সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী। এটা থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সেই সুযোগ সৃষ্টি করেছে। একে কাজে লাগাতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গে। এরূপ একটি সমস্যায় রাখাইন প্রদেশ জর্জরিত। এর সমাধানের লক্ষ্যে রাখাইন কমিশন গঠনও সঠিক পদক্ষেপ বলে বিবেচনা করা যায়।
রাখাইন প্রদেশ এককালে আরাকান নামে পরিচিত ছিল। ছিল স্বাধীন। তার শাসকগোষ্ঠী ও ভৌগোলিক সীমায় পরিবর্তন এসেছে অনেকবার। একসময় মুসলিম শাসকদের অধীনেও ছিল। আরাকান রাজ্যের আওতায় কিছুকাল ছিল আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মোগলরা চট্টগ্রাম ছিনিয়ে আনে। ১৭৮৪ সালে রাজ্যটি তখনকার ব্রহ্মদেশ (বার্মা নামে পরিচিত, এখন মিয়ানমার) জয় করে তাদের অংশ করে নেয়। তবে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা খুবই নাজুক। আরাকান পর্বতমালার ১০ হাজার ফুট উঁচু ‘ভিক্টোরিয়া পিক’ এই যোগাযোগব্যবস্থার বড় বাধা।
ব্রিটিশরা ১৮২৬ সালে বার্মা দখল করে ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত করে। দেশটি স্বাধীনতা পায় ১৯৪৮ সালে। রাখাইন প্রদেশের আয়তন ৩৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা ৩২ লাখ। এর প্রধান জাতিসত্তা দুটি হচ্ছে রাখাইন ও রোহিঙ্গা। সেই রাজ্যে আরও বেশ কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বাস করে। রাখাইনরা বৌদ্ধ আর রোহিঙ্গারা মুসলমান। প্রদেশের রাজধানী এককালে আকিয়াব নামে পরিচিত এখনকার সিত্তাওয়ে। এর অবস্থান আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব, অর্থাৎ অগ্নিকোণে। একেবারেই নিকট প্রতিবেশী। সমস্যা বাধে রোহিঙ্গাদের নিয়ে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতে, ষোড়শ শতক থেকে তারা সেখানে বাস করছে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে এ রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করার একটি পরিকল্পিত কার্যক্রম চলে আসছে। ২০১২ সালের জনগণনায় তাদের অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি। বলা হচ্ছে, তারা রাষ্ট্রহীন বাঙালি মুসলমান। তবু সেখানে এখনো রোহিঙ্গা ১৩ লাখ আছে। নির্যাতন ও আর্থিক সংকটে তারা ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দেশে। যতটুকু জানা যায়, এই জাতিগোষ্ঠীর ৪ লাখ লোক বাস করে সৌদি আরবে। আমাদের দেশে আছে ৩ থেকে ৫ লাখ। পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডে যথাক্রমে ২ ও ১ লাখ। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও ভারতে কিছু রোহিঙ্গা বসবাস করছে। নৌকায় করে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে তারা ছোটে আশ্রয়ের সন্ধানে। নিরাপত্তা ও জীবন ধারণের প্রয়োজনে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। নিজ মাতৃভূমি নিরাপদ হলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোথাও ছুটবে না। জনবহুল ও রোহিঙ্গা সমস্যায় আক্রান্ত বাংলাদেশের উপকূলে এসে মহিলা, শিশুসহ নৌকা ভেড়ানোর জন্য জোর হাতে নিবেদন করবে না; বরং এপারে যে রোহিঙ্গারা মর্যাদাহীন জীবন যাপন করছে, তারাও ফিরতে চাইবে নিজভূমে।
রাখাইন কমিশন গঠনে আমাদের উৎসাহ বেড়েছে মূলত এর প্রধান ব্যক্তির মনোনয়নে। কফি আনান আফ্রিকার গোল্ডকোস্টে (আজকের ঘানায়) জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৮ সালে। ৭৮ বছর বয়স। দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটিসহ অনেক নামীদামি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। জাতিসংঘের বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহুকাল। তিনি সংস্থাটির সপ্তম মহাসচিব। তাঁর কার্যকাল ছিল ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। কফি আনানের ধীশক্তি, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম সবার প্রশংসা অর্জন করেছে। একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ বিশ্বসমাজ গড়ে তুলতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ ও এর মহাসচিব কফি আনানকে ২০০১ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। এমন একজন লোকের হাতে রাখাইন কমিশনের নেতৃত্ব, যিনি বহুদর্শী ও ব্যাপকভাবে সম্মানিত। সুতরাং বিবাদপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য আনতে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত কমিশন সফল হবে—এমন আশা করা অসংগত নয়।
তবে এটা সহজবোধ্য যে সদিচ্ছা থাকলেও সবকিছু হয়ে যায় না। বিভিন্ন দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে মূল স্রোতের সঙ্গে একীভূত করার কাজটি সহজ নয়। অনেক দেশই তা করতে পারেনি। এমনকি আমরা পুরোপুরি করতে পেরেছি এমন দাবি করাও যাবে না। ঠিক তেমনি অবস্থা ভারতের। তবে ভারত ও বাংলাদেশ এ ধরনের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অধিকার মেনে নিয়েছে। শাসনব্যবস্থায় তাদের অংশীদার করতে বিভিন্ন প্রচেষ্টাও চলছে। তবু বেশ কিছু অসম্পূর্ণতা রয়ে যাচ্ছে। তবে কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই সময়ান্তরে মিটে যাওয়ার কথা। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারই স্বীকার করা হয় না। সুতরাং সেখানে সমস্যার গভীরতা অনেক বেশি।
রাখাইন প্রদেশের যেকোনো আলোড়নের ঢেউ আমাদেরও প্লাবিত করে। ইচ্ছা ও সামর্থ্য না থাকলেও তাদের দিক থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে রাখা যায় না। এবার আমরা নতুনভাবে আশায় বুক বাঁধলাম। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির হাতে মিয়ানমারের নেতৃত্ব। সব জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর একটি বিশেষ দায় রয়েছে। মনে হয় তিনি শক্ত হাতেই হাল ধরেছেন। সাথি করে নিয়েছেন আরেক নোবেল বিজয়ী কফি আনানকে। তিনিও সারা জীবনের অর্জনকে অমলিন রাখতে সক্রিয় রইবেন, এমনটাই আশা করা যায়। সব মিলিয়ে আমরা সেই অঞ্চলটির দিগন্তে রুপালি রেখা দেখতেই পারি। এ রেখা ক্রমান্বয়ে সূর্যের আলোকময় করে তুলতে পারে প্রদেশটিকে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন