|
আলী ইমাম মজুমদার
|
|
মেধা কোটায় নিয়োগে পরিচয় গোপন কেন?
24 August 2016, Wednesday
৩৫তম বিসিএসে প্রাধিকার কোটার চেয়ে মেধা কোটা প্রাধান্য পেয়েছে। সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) সূত্রের বরাতে প্রথম আলো এ মর্মে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে ২ হাজার ১৫৮ জনকে। মেধা কোটা প্রাধান্য পাওয়ার খবরটি স্বস্তিদায়ক। বিষয়টি অবশ্য স্থায়ী নয়। এবার বেশ কিছু (যতটুকু মনে হয় ডাক্তারসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল ক্যাডারে) প্রাধিকারভুক্ত ন্যূনতম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীর অভাব পূরণ করতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি মন্দের ভালো। কেননা, গত কয়েক বছর এ ধরনের শূন্য পদ ফেলে রাখা হয়েছিল। যোগ হতো পরবর্তী বছরে প্রাধিকারের সঙ্গে। এটুকু উদ্যোগ যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। তবে বিসিএসের সব ক্যাডারে নিয়োগে মেধাকে প্রাধান্য দিতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রেও এ প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। একটি দক্ষ ও কার্যকর সিভিল সার্ভিস গড়ে তুলতে এর বিকল্প নেই, এটা সবাই বোঝেন। কিন্তু কোনো একটি জায়গায় এসে গিঁট লেগে যায়। পরিবর্তন হয় না ব্যবস্থাটির।
তবে কারা মেধা আর কারা প্রাধিকার কোটার নিয়োগের সুপারিশ পেলেন, তা জানতে চাই। পিএসসি ৩৪তম বিসিএস থেকে এ তথ্য প্রকাশ না করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। সে ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হয়েছে ৩৫তম বিসিএসেও। এ বিষয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা যখন সুপারিশ করছি, মেধা ও প্রাধিকার কোটা দুটোর জন্যই করেছি। এ ক্ষেত্রে আমরা শ্রেণিগত বৈষম্য রাখতে চাইনি। ফলে পেশাগত জীবনে সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারবে।’ এ মতামতটিকে আমরা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারি! শ্রেণিগত বৈষম্য সৃষ্টি করেই তো কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ। আর বৈষম্য তো সৃষ্টি করেনি পিএসসি। সরকারের নির্ধারিত কোটা অনুসারেই তাদের সুপারিশ করতে হয়। পিএসসির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত। তবে প্রকৃত তথ্যটি না জানানোর অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো, তা আমরা জানতে চাই। তথ্য না জানানোর ফলে তা কোটাব্যবস্থাটিকে নতুনভাবে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে।
সম্মিলিত মেধা তালিকায় ওপরের দিকে থেকেও অনেকেই চাকরি পান না। আর পেলেও তা নিম্নমানের। এতে কারও আপত্তি থাকতে পারে না। কারণ, শূন্য পদের ভিত্তিতেই তো নিয়োগ। কিন্তু যখন কোনো পদে মেধা তালিকায় অনেক ওপরে থাকা প্রার্থী বাদ পড়েন আর নিয়োগ পান অনেক নিচের কেউ, তখন তো বিতর্ক আসবেই। বৈষম্যটি তো আর চাপা রইল না। আর এখন আবার তা নির্দিষ্ট করে বলাও যাবে না। আমরা ফলাও করে অবাধ তথ্যপ্রবাহের কথা বলছি, তথ্য অধিকার আইন করছি। গঠন করেছি তথ্য কমিশন। তখন এ ধরনের স্বাভাবিক তথ্য অন্তরালে রাখার সিদ্ধান্তটি নিশ্চিতভাবেই অসংগতিপূর্ণ। এত দিন তো তা চলছিল। তাতে শ্রেণিগত বৈষম্যের জন্য পেশাগত জীবনে একসঙ্গে কাজ করতে কারও কিছু অসুবিধা হয়েছিল, এমনটি জানা যায় না। আর প্রাধিকার কোটায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পরিচয় আড়ালে রাখার দায়িত্বটি পিএসসিই বা কেন নিল, এটা বোধগম্য নয়।
প্রাধিকার কোটায় আছে নারী, জেলা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বরাবরে যথাক্রমে ১০, ১০ ও ৫ শতাংশ। আর মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যদের জন্য ৩০ শতাংশ। যোগফল ৫৫ শতাংশ। আর মেধার জন্য রইল ৪৫ শতাংশ। এ প্রাধিকার কোটাগুলো যাঁদের ঘিরে, তাঁদের কোনোটির পরিচয় তো অগৌরবের নয়। নারীরা সমাজের অর্ধেক এবং এখনো পশ্চাৎপদ। কিছু জেলা রয়েছে অনগ্রসর। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে দেশের মূল স্রোতোধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে একটি বিশেষ ব্যবস্থাও থাকা দরকার। এ তিনটি শ্রেণিকে সমাজের অনগ্রসর বা পশ্চাৎপদ বলে অবশ্যই বিবেচনা করা যায়। তাই সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে সবার জন্য সমান অধিকারের ঘোষণা থাকলেও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী বা অঞ্চলের জন্য বিশেষ বিধান করার ব্যবস্থা আছে। মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য হওয়ার বিষয়টিও গৌরবের। যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের জাতি যুগ যুগ স্মরণে রাখবে। বরণীয় থাকবেন তাঁরা। তাঁদের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরও এ নিয়ে গৌরব করার অধিকার আছে। তাহলে প্রাধিকার কোটায় যাঁরা নিয়োগপ্রাপ্ত, তাঁদের পরিচয় গোপন রাখার যুক্তিটা কী?
অবশ্য এটা আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক যে এ ধরনের কোটা বিন্যাসের যৌক্তিকতা দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নবিদ্ধ ও সমালোচনামুখর। সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির পরিচয়ে যে কোটা রাখা হয়েছে, তাও সময় আর বাস্তবতার দাবিতে মাঝেমধ্যে পর্যালোচনার আবশ্যকতা রয়েছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য রাখা কোটাটির কিছু বিভাজন বিবেচনার দাবি রাখে। সাঁওতাল, কোচসহ এ–জাতীয় গোষ্ঠীগুলো কিন্তু এর সুযোগ নিতে পারছে না। আর সবচেয়ে বড় বিতর্ক মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য কোটা নিয়ে। তার চেয়ে বড় বিতর্ক এর সংখ্যা নিয়ে। তাঁদের (সনদপ্রাপ্ত) সংখ্যা আনুপাতিকভাবে কম হলেও ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে সব চাকরির ক্ষেত্রে তাঁদেরই জন্য। এমনকি অধস্তন আদালতের বিচারকের পদও। তবে সামরিক বাহিনীর কমিশন্ড অফিসার পদে এ ধরনের কোনো কোটা নেই। বলা বাহুল্য, সংখ্যাটি প্রকৃত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন।
সিভিল সার্ভিস দেশের শাসনব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। পেশাদারি পদে যাঁরা আছেন (যেমন: সরকারি কলেজশিক্ষক, বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ, প্রকৌশলী ইত্যাদি) ছাড়াও সাধারণ পদে থাকে প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ, হিসাব ও নিরীক্ষা, শুল্ক ও কর ইত্যাদি পদ। তাই বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন প্রার্থী নিয়োগ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে পিএসসি। তবে এতে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে সরকারের নির্ধারিত কোটা পদ্ধতি। আমরা সযতনে মেধাবীদের বড় অংশকে দূরে ঠেলে রাখার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত করে ফেলেছি। এমনিতে বিদেশে চলে যাচ্ছে মেধাবী ছেলেমেয়েরা। বেসরকারি খাত টেনে নিচ্ছে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। সরকারি চাকরিতে যাঁরা আসতে চান, তাঁদের সামনে আমরা বসিয়ে দিয়েছি দুর্লঙ্ঘেয় প্রতিবন্ধকতা। বিশেষ ক্ষেত্রে সীমিত কোটা পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও বেসামরিক প্রশাসনে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে ব্যাপক মতৈক্য রয়েছে।
১৯৭৩ সালের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস রিঅর্গানাইজেশন কমিটি এবং ১৯৭৭ সালের রশিদ কমিশন কোটা পদ্ধতির বিপক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিল। উভয়টির মতে, এটা অদক্ষতা আনে। তারা আরও উল্লেখ করে, দেশের চাহিদা একটি উঁচু মানের সিভিল সার্ভিস। আর কোটা পদ্ধতি এ প্রচেষ্টার অন্তরায় হিসেবে বিরাজ করবে। ২০০০ সালে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও (পার্ক) বলেছে, বাংলাদেশের নিয়োগ পদ্ধতিতে বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর নিয়োগ দিতে কোটা পদ্ধতির আধিক্য লক্ষণীয়। মেধা ও কৌশল ভালো নীতিনির্ধারণের পূর্বশর্ত। প্রশাসন চালানোর জন্য নেতৃত্বের গুণাবলি একটি পূর্বশর্ত। বর্তমান কোটা প্রক্রিয়ায় মেধাবী ও চৌকস কর্মকর্তার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে, এমন আশঙ্কা কমিশন ব্যক্ত করেছে। অধিকন্তু ‘পার্ক’-এর মতে, এ ধরনের কোটা বিন্যাস যুক্তির চেয়ে অধিকতর আবেগনির্ভর।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে আমরা প্রায় সব ব্যাপারেই অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের উন্নয়ন–সহযোগীরা তাই এ দেশের রাজনীতি, প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য দেন। বেসামরিক প্রশাসনের মান কমে যাওয়ায় তাঁরাও হতাশ ও উদ্বিগ্ন। মান বৃদ্ধির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন উপযুক্ত লোক নিয়োগ। বর্তমান কোটাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এটা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বেশি আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। পিএসসি কোটা–ব্যবস্থা নিয়ে দাতাদের অর্থে অনেক গবেষণা করেছে। এর সংস্কারের পক্ষে তাদের সুস্পষ্ট মতামতও ছিল। সে মতামত দেখা যেত বিভিন্ন প্রতিবেদনে। এখন ব্যাপারটি উল্টো দিকে চলছে। এ ধরনের কোনো আলাপ-আলোচনা বা কার্যক্রম নেই। এতে আমরা বিস্মিত ও আহত। ভবিষ্যৎ প্রশাসনের জন্য দক্ষ কান্ডারি নিয়োগের দায়িত্ব তাদের। তারা এ বিষয়ে ভিন্ন অবস্থান নিলে প্রতিকার আসবে কীভাবে? বরং কারা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত, তা নিয়ে রাখঢাক করা হচ্ছে। মেধা কোটায় অধিকসংখ্যক নিয়োগ দিয়েছে, এ দাবি আমরা মেনে নিলাম। প্রশংসাও করছি, কিন্তু জানা দরকার সেগুলো কোন কোন ক্যাডারে। বিশেষ করে প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশসহ সাধারণ ক্যাডারগুলোতে তা হয়েছে কি? আশা করার কোনো সংগত কারণ দেখছি না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন