|
আলী ইমাম মজুমদার
|
|
ধন–মান নিয়ে লড়াই
03 February 2016, Wednesday
ধন ও মান মানুষের চিরন্তন চাওয়ার বিষয়। সবাই তা চায়। আর এটা পেতে চালায় সাধ্যসাধনা। অব্যাহত থাকে নিরন্তর প্রচেষ্টা। তবে সে প্রচেষ্টা যখন কিছুটা মাত্রা লঙ্ঘন করে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যক্রম হয় ব্যাহত। শঙ্কিত হয় আপামর জনগণ। এরূপই অনেকটা ঘটে চলছে বর্তমান বেতন স্কেলটি ঘোষিত হওয়ার পর থেকে। এর কিছু কারণও আছে। আবার কেউবা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টায় আছেন। সরকারি মানক্রমের সঙ্গেও একে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে।
টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড রদ হওয়ায় কোনো কোনো ক্যাডার কিংবা নন-ক্যাডার পদগুলোয় ওপরের দিকে যাওয়ার সুযোগ কমে যায়। বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে বিষয়টির সুরাহা করতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি টিম কাজ করছে। তারা শিগগির গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমস্যাটি প্রধানমন্ত্রী নিজে দেখবেন বলে তাঁদের আশ্বস্ত করেছেন। আমরাও এটার একটা যৌক্তিক ও দ্রুত সমাধানের অপেক্ষায় আছি। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে শিক্ষকেরা ক্লাসে ফিরে গেছেন। স্বীকার করতে হবে, এ শিক্ষকদের বিরতিহীন প্রচেষ্টায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট এখন আর নেই। সাফল্যটি ধরে রাখতে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ শান্ত রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। বিরত থাকা সংগত অন্যের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া থেকে। পাশাপাশি কারও ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করাও অসংগত। বেতন স্কেল ঘোষিত হলে বরাবরই কিছু অসংগতি দেখা দিয়েছে। তার মীমাংসাও হয়েছে। আর এবারেও হবে।
এর ধারাবাহিকতায় বরাবরই সাংবিধানিক পদধারীদের বেতন বা পারিতোষিকও বৃদ্ধি করতে হয়। প্রয়োজন হয় আইন সংশোধনের। এমনভাবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, বিচারপতি, স্পিকার, সাংসদদের বেতন বা পারিতোষিক এবং ভাতাদি বৃদ্ধির সংশোধনী বিলও পেশ করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। এ-বিষয়ক সংসদীয় কমিটি সাংসদদের ব্যতীত বাকি সব কটি সুপারিশ করেছে পাসের পক্ষে। সাংসদদের প্রসঙ্গে তাদের মতামত, এ বৃদ্ধি অপ্রতুল। তা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের চেয়ে কম। পারিতোষিক বৃদ্ধির পাশাপাশি তাঁরা মর্যাদাক্রম নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করে একে উন্নীত করার দাবি করেছেন। তাঁদের পারিতোষিক ২৭ হাজার ৫০০ থেকে ৫৫ হাজারে উন্নীত করার প্রস্তাব রয়েছে। এটা শতভাগ বৃদ্ধি। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য তা বাড়ছে ৯৫ শতাংশ।
সাংসদদের পারিতোষিক তো প্রজাতন্ত্রের ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের চেয়ে কমই ছিল বরাবর। মানক্রমে তাঁরা সচিবদের ওপরেই। আর সে স্থিতাবস্থা বজায় রেখেই বিলটি তৈরি হয়। উপমহাদেশের অপর দুটো দেশ ভারত ও পাকিস্তান প্রসঙ্গ এখানে আলোচিত হতে পারে। ভারতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বেতন ৯০ হাজার রুপির সঙ্গে ১০৭ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা ও অন্যান্য ভাতা যোগ করে ২ লাখ ১৯ হাজার রুপি। সেখানে সাংসদদের পারিতোষিক ৫২ হাজার রুপি। এটাকে কিছু বাড়ানোর উদ্যোগ চলছে। সে দেশটির মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মানক্রম উপমন্ত্রীর ওপরে। ইন্টারনেটের কল্যাণে এ বিষয়ে গুলগল্প করার সুযোগ নেই। পাকিস্তানে সিভিল সার্ভিসকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিভিল সার্ভিস বলা হয়। বেতন-ভাতা, সুবিধাদিসহ তাদের সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য মাসিক চার লাখ রুপি ব্যয় হয়। বিদ্যুৎ ও পানির বিল দিতে হয় না। সেখানে জাতীয় পরিষদ সদস্যরা পারিতোষিক লাভ করেন ১ লাখ ২০ হাজার রুপি। ওই দেশটিতেও এমএনএ ও সিনেটরদের মানক্রমে অবস্থান মন্ত্রণালয় বিভাগের দায়িত্বে থাকা সেক্রেটারি জেনারেলদের বেশ কয়েক ধাপ নিচে। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিমন্ত্রীদের অবস্থানও সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রধানদের নিচে।
আপাতত স্থিতাবস্থা রাখতে আগের নিয়মটি চালু রাখা সংগত হবে। কোনো কারণেই শিক্ষকদের প্রতি অবজ্ঞা অগ্রহণযোগ্য। ঠিক তেমনি প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের পদে যেতে বিদ্যা, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের প্রতি অকারণ অবজ্ঞাও অযাচিত
প্রকৃতপক্ষে একটি দেশের রাষ্ট্রীয় মানক্রম নির্ধারিত হয় সে দেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতিসহ অন্য অনেক কিছু বিবেচনায়। তাই স্থান, কাল, পাত্রভেদে এর পার্থক্যও বড় ধরনের। বরাবর ঊর্ধ্বতন আদালতের বিচারপতিরা উঁচু মর্যাদা ভোগ করছেন প্রায় সব ক্ষেত্রে। সেও আবার সব দেশেই এক রকম নয়। যেমন যুক্তরাজ্যে রাজা-রানি ছাড়াও রাজপরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যও মানক্রমে সর্বাগ্রে। তাঁদের পরে কেন্টার বাড়ির আর্চ বিশপ, লর্ড চ্যান্সেলর ও আরও দুজন আর্চ বিশপের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান। তারপর ফাস্ট লর্ড অব ট্রেজারি। অতঃপর প্রিভি কাউন্সিলের লর্ড প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গভর্নর, সংশ্লিষ্ট নগরীর মেয়র এবং হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের স্পিকারের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি।
আমাদের উপমহাদেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতি মোটামুটি একই রকম। পাকিস্তানে নিরন্তর সেনাশাসনের জন্য সেদিকের পাল্লা ভারী। ভারতে গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা নিরবচ্ছিন্ন। তা সত্ত্বেও তারা বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর কোনোটিকেই অবজ্ঞা করেনি। যথোপযুক্ত স্থান দিয়েছে তাদের মানক্রমে। সেখানেও সামরিক বাহিনীর প্রধানদের মানক্রম উপমন্ত্রীদের ওপরেই। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এক ধাপ নিচে। অবশ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সামরিক বাহিনীর প্রধানদের অবস্থান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিচে। তবে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিদের ওপরে। তবে এমপিগণের অবস্থান কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবদের ওপরেই রয়েছে।
আরেকটি স্পর্শকাতর বিষয় মাঝেমধ্যে আলোচনায় আসছে ইদানীং। আমাদের মানক্রমে উপাচার্যদের একটি অবস্থান নির্ধারণ করা আছে। এটা নিয়ে বিতর্ক হয়। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত প্রায় অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে ভারত সরকারের মানক্রমে উপাচার্যদের কোথাও রাখা হয়নি। তবে নিশ্চয়ই তাঁরা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন। আসন লাভ করেন যোগ্যতম স্থানেই। তবে গুটিকয় রাজ্য সরকার আবার ভারত সরকারের মানক্রমের সম্পূরক হিসেবে নিজস্ব একটি মানক্রম তৈরি করেছে।
এর মাঝে শিক্ষায় সবচেয়ে উন্নত কেরালা রাজ্য সরকারের সচিব পর্যায়ে উপাচার্যকে দেখানো হয়েছে। অর্থনীতিতে অগ্রসরমাণ গুজরাট সরকারে তাদের অবস্থান অতিরিক্ত মুখ্য সচিবের পর। রাজ্য সরকারের মুখ্য সচিব, অতিরিক্ত মুখ্য সচিব ও সচিব কেন্দ্রীয় সরকারের যথাক্রমে সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ে। অবশ্য পাকিস্তানে তাদের অবস্থান সচিবদের পরপর। এমনকি সে দেশটিতে ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষদের মর্যাদাও জেলা প্রশাসকের ওপরে। জেলা ও দায়রা জজ আর কর্নেলের সমান। অন্যদিকে, ভারতের কেরালা ও গুজরাটে জেলা ও দায়রা জজ আর জেলা প্রশাসকের অবস্থান একই স্তরে।
শ্রীলঙ্কার মানক্রম তালিকা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। জনপ্রতিনিধি ও উচ্চ আদালতের বিচারকদের পরপর সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেল, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং সরকারি সংস্থাসমূহের শীর্ষ নির্বাহীদের দিয়েই শেষ হয়েছে। মালয়েশিয়ায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের পরপরই মুখ্য সচিবের অবস্থান। তাঁর সমপর্যায়ে আছেন রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর। অবশ্য যে কয়টি দেশের প্রসঙ্গ এখানে আলোচিত হলো, তার বাইরেও অনেক দৃষ্টান্ত থাকবে। থাকতে পারে বেশ কিছু বিপরীতধর্মী চিত্র।
শিক্ষকদের লিখিত বা অলিখিত মানক্রমের সঙ্গে তাঁদের বেতন সম্পর্কিত করার যৌক্তিকতা নেই। এ বিষয়ে নিবন্ধকারের আগের অবস্থান অটুট রয়েছে এবং থাকবে। তাঁরা এত দিন যেসব সুবিধাদি ভোগ করেছেন, তা থেকে বঞ্চিত করা সংগত নয়। চাকরিতে সবাই আসেন এর সুযোগ ও সীমাবদ্ধতা জেনে। সুতরাং, সর্বত্রই সমান সুযোগ থাকবে—এমনটা ভাবা অসংগত। এটা বুঝতে হবে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীসহ শিক্ষকদেরও। আর মর্যাদায় শিক্ষকেরা কারও চেয়ে কম নন। তাঁরা শুধু সচিব তৈরির কারিগর নন; রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীও তাঁদের কাছে লেখাপড়া শিখেছেন।
তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিতে পারে। শিক্ষক ও শিক্ষাদানের মানেও রয়েছে বড় ধরনের পার্থক্য। বেতন কমিশনের সুপারিশেও কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কথা রয়েছে। সেসব ভাবনা হয়তো সময়সাপেক্ষ। তবে কোথাও শুরু করতে হবে। আপাতত স্থিতাবস্থা রাখতে আগের নিয়মটি চালু রাখা সংগত হবে। কোনো কারণেই তাঁদের প্রতি অবজ্ঞা অগ্রহণযোগ্য। ঠিক তেমনি প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের পদে যেতে বিদ্যা, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের প্রতি অকারণ অবজ্ঞাও অযাচিত।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন