বাংলাদেশের নগরবাসী, বিশেষ করে ঢাকা মহানগরের পথিক পথের ওপর তাদের অধিকার হারিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নবকুমারের মতো তারা পথ হারায়নি বটে। তবে অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে পথে চলাফেরার অধিকার। নগরের মূল পথ ধরে চলে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। সেগুলোতে চলাচলও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। চালকের অবহেলায় ঝরে যায় অনেক মূল্যবান জীবন। এই তো সেদিন এমনি এক দুর্ঘটনায় চলে গেলেন সাংবাদিক জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী। পথিকের জন্য থাকার কথা পায়ে চলার পথ। এগুলো ফুটপাত নামে পরিচিত। সে পথে চলা আজ অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর কারণও বিচিত্র। ফলে যাঁরা হেঁটে গন্তব্যে যেতে পারতেন, তাঁরাও চেপে বসেন নিদেনপক্ষে রিকশায়। ফলে যানবাহনের সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। পথচারীদের হয়রানি নিরসনে মাঝেমধ্যে ক্ষীণ প্রচেষ্টা চলে। কিন্তু সুফল নেই।
পথিকের ভুলও ক্ষেত্রবিশেষে তাদের এমনকি যানবাহন চলাচলব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণ হয়। পথ পারাপারের জন্য ঢাকা নগরে আছে কিছুসংখ্যক ওভারব্রিজ। কিন্তু অনভ্যাসে এগুলোর বেশির ভাগ অব্যবহৃত। কিছু স্বল্প ব্যবহৃত। আন্ডারপাসগুলোর অবস্থাও তাই। ফলে এগুলোর বেশ কিছু হকারসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিদের দখলে চলে গেছে। কিছু হয়ে পড়েছে জরাজীর্ণ। তা সত্ত্বেও পথিক এগুলো ব্যবহার শুরু করলে স্বাভাবিকভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর দিতে বাধ্য হবে। তা না করে রাস্তা পারাপারে রাজপথ অনিয়ন্ত্রিতভাবে যত্রতত্র আড়াআড়ি পাড়ি দেওয়ার মন্দ সংস্কৃতি চলছে বেশ কয়েক বছর। ক্ষেত্রবিশেষে দৌড়েও পাড়ি দেন কেউ কেউ। এমনকি কয়েকজন মিলে নিজেরাই হাত দেখিয়ে চলমান যানবাহনকে থামিয়ে পাড়ি দেন। এতে ট্রাফিকব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটে। ক্ষেত্রবিশেষে দুর্ঘটনা।
এর প্রতিকার করতে সম্প্রতি যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাকে নীতিগতভাবে স্বাগত জানাতে হয়। পাশাপাশি পথচারীদের রাস্তা পারাপার নিরাপদ করার জন্য আবশ্যক বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ। সব পথচারী ওভারব্রিজ পাড়ি দিতে শারীরিকভাবে সক্ষম নন। তাঁদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থার প্রয়োজন। প্রয়োজন ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাসগুলোর সংস্কার, পরিচ্ছন্নতা ও দখলমুক্ত করা। পাশাপাশি জেব্রা ক্রসিং চিহ্নিত করা ও তা অনুসরণের জোর তৎপরতা চালাতে হবে।
রাজপথের পাশাপাশি যে ফুটপাত রয়েছে তাতেও মানুষের হাঁটার সুযোগ খুব কম। পার্শ্ববর্তী দোকান মালিকদের কেউ কেউ একে ব্যবহার করেন দোকানের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে। মালামাল রাখা হয় এখানে। কোথাওবা সে ফুটপাত চলে গেছে ফেরিওয়ালার দখলে। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবহৃত হচ্ছে বর্জ্য ফেলার স্থান হিসেবে। আবার ফেরিওয়ালা ও বর্জ্য নিষ্কাশনের স্থান হিসেবে ফুটপাত ছাড়াও মূল সড়কের অংশবিশেষ ব্যবহৃত হচ্ছে স্থানভেদে। চলমান নির্মাণকাজের সামগ্রী রাখার স্থান তো ফুটপাত আর মূল সড়কের অংশবিশেষই। মূল সড়ক ধরে চলাচল করে যানবাহন। যাত্রী ওঠানামার জন্য বাসকে নির্ধারিত স্থানে বিরতি দিতে হয়। তবে তারা সে বিরতি দেয় তাদের ইচ্ছামতো স্থানে এবং যতটা সময় ইচ্ছুক ততক্ষণ। ফলে সড়কের যানজট বেড়েই চলছে। অনেক বিপণিবিতান, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে চলছে অননুমোদিত পার্কিং। এ পার্কিং শুধু ফুটপাত নয়, মূল সড়কের অংশবিশেষও নিয়ে নিচ্ছে। মাঝেমধ্যে এসব পার্কিংয়ের জন্য জরিমানা হয়। তবে যাদের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এ পার্কিং তাদের কারও কিছু হয় না। প্রয়োজনীয়সংখ্যক পার্কিং ব্যবস্থা ছাড়াই অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এসব স্থাপনা। ক্ষেত্রবিশেষে অনুমোদিত নকশা উপেক্ষা করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে দু-একটি নোটিশ হলেও তাদের কারও কিছু হয়েছে, এমনটা জানা যায় না।
ফুটপাত দখলমুক্ত ও মোটামুটি পরিচ্ছন্ন থাকলে অনেক লোক হেঁটে চলতেন। সে সুযোগ থেকে বিরল দু-একটি ক্ষেত্র ব্যতীত সর্বত্র বঞ্চিত নগরবাসী। তবু বেপরোয়া হয়ে কিছু লোক হাঁটেন। সেখান দিয়েও হঠাৎ করে মোটরবাইক চলে দ্রুতগতিতে। ঝুঁকিতে থাকেন পথচারী আর বাইক আরোহী সবাই। সব যেন বেপরোয়া। আইনকানুনের ধার কেউ ধারছে না। যে যেভাবে পারছে সেভাবে চলতে চাইছে। এতে সবার পথপরিক্রমা হচ্ছে বিলম্বিত ও ঝুঁকিপূর্ণ।
আবাসিক এলাকার রাস্তাগুলোতে ফুটপাত নেই। থাকার কথাও নয়। সেখানে লোকজনের মূল রাস্তা ধরেই হাঁটতে হয়। কিন্তু সে রাস্তায়ও ক্ষেত্রবিশেষে নির্মাণসামগ্রী আর স্তূপীকৃত বর্জ্য এগুলোকে সংকীর্ণ করে ফেলেছে। অনুমোদন নিয়ে বা না নিয়ে সেসব স্থানেও চলছে পার্কিংবিহীন বিভিন্ন স্থাপনা। তাই পার্কিং হয় যত্রতত্র। এসব আবাসিক এলাকার অনেকগুলো ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত। হেঁটে বেড়ানো বা বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য পার্ক, এমনকি খেলার মাঠও নেই অনেক ক্ষেত্রে। যেগুলো আছে সেগুলোও ক্রমান্বয়ে বেদখল হয়ে পড়ছে। আবাসিক এলাকায় আর কোনো স্থান না থাকায় অনেক লোক সকালের দিকে রাস্তায় হাঁটেন। সন্ধ্যায় সে সুযোগও থাকে না। অতি ভোরে হাঁটা বেশ কিছু কারণে অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। ছিনতাইকারীদের ভয় তো আছেই। তা ছাড়া, সে সময়েই বেপরোয়াভাবে চলে ছোট-বড় সব গাড়ি। গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণও চলে তখন। এতে প্রাণ যায় অনেক পথচারীর। কাকডাকা ভোরেও নগরবাসী পথিক পথ চলতে পারছে না বিনা শঙ্কায়। পথ ব্যবহারের বিষয়েও আমাদের নগরবাসী পথিক নিজভূমে পরবাসী। অথচ সরকারের নীতিমালা অনুসারে তাদেরই অগ্রাধিকার থাকার কথা।
ফুটপাত দখলমুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে। সব সরকারই এ বিষয়ে সময়ে সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ সুফল দেয়নি। বরং উত্তরোত্তর জটিল হয়েছে পরিস্থিতি। দখলবাজদের আওতা আজ শুধু ফুটপাত নয়, ক্ষেত্রবিশেষে মূল রাজপথের অংশবিশেষেও। হকাররা ফুটপাতে ব্যবসা করে জীবিকা অর্জন করেন। বিকল্প ব্যবস্থা না করে তাঁদের উচ্ছেদ করা অমানবিক। জীবন-জীবিকায় টান পড়বে বিশাল জনগোষ্ঠীর। তবে শৃঙ্খলাবদ্ধ তো করা চলে। অংশবিশেষ হকারের জন্য ছেড়ে দিলেও পথচারীর তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে এখানে বর্জ্য ফেলার কাজটি তো বন্ধ করা চলে। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায় ফুটপাত দিয়ে চলা মোটরবাইকচালকদের বিরুদ্ধে। অনির্ধারিত পার্কিংয়ের জন্য শুধু পার্ক করা গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই যথেষ্ট নয়। যে কারণে পার্কিং তার উদ্যোক্তা ও সুফলভোগী যারা, তাদের কি আইনের আওতায় আনা চলে না? এসব স্থান থেকে গাড়ি তাড়িয়ে দিলেও দাঁড়িয়ে থাকবে এবং কোথাও থাকছে শত শত রিকশা কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা। এ ধরনের অব্যবস্থা নগরজীবনে যানবাহন চলাচলে ভোগান্তির বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে। এগুলো দেখার অনেক সংস্থা আছে। আছে রাজউক, সিটি করপোরেশন ও পুলিশ। তবে তারা কার্যকর কিছু করতে পারছে, এমনটা বলা যাবে না।
বাংলাদেশের মতো স্বল্পায়তনের দেশে এত লোকের বসবাস ও চলাচল ব্যবস্থা যেকোনো সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ বটে। ঢাকা মহানগরে নতুন রাস্তা করা বা যেগুলো আছে সেগুলোর সম্প্রসারণ প্রায় অসম্ভব। বিকল্প চলাচলব্যবস্থা করার বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে সমস্যা হয়তোবা কিছুটা কমবে। আর এগুলো হওয়াও তো সময়ের ব্যাপার। যেগুলো আছে সেখানে কি আমরা ন্যূনতম শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পারি না? অবশ্যই করা চলে। এর জন্য প্রয়োজন রয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সদিচ্ছা ও সমন্বয়। পাশাপাশি এর জন্য গৃহীত কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা। সম্প্রতি পথচারীদের যত্রতত্র রাস্তা পাড়ি দেওয়া বন্ধ করতে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এরই ধারাবাহিকতায় উপরিউক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের আবশ্যকতা রয়েছে। আমাদের সবাইকে এটা মেনে নিতে হবে, পথ মূলত পথিকের।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন