|
মোবায়েদুর রহমান
|
|
সমাধান : নির্ভেজাল গণতন্ত্র
14 October 2015, Wednesday
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পাশ্চাত্যের মতি গতি ইদানিং অত্যন্ত দুর্বোধ্য ঠেকছে। তিল থেকে নাকি তাল হয়। বাংলাদেশেও তাই হলো। ২৮ সেপ্টেম্বর অষ্ট্রেলীয় ক্রিকেট টিমের ঢাকায় আসার কথা ছিল। তারা এলোনা। কিন্তু ঘটনাটি কাততালীয় কিনা জানি না, ঠিক সেদিনই ঢাকায় খুন হলেন ইটালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার। সেই শুরু। ৪ দিন পর রংপুরে খুন হলেন জাপানী নাগরিক হোসি কোনিও। একজন বাঙ্গালী খ্রিস্টান লুক সরকারের ওপরও মার্ডার এ্যাটেম্পট হয়েছিল। তিনি বেঁচে গেছেন। কিন্তু ২৮ সেপ্টেম্বর থেকেই শুরু হলো বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়া। খবরের কাগজে সবই এসেছে। কাজেই সেগুলো আর রিপিট করলাম না। অষ্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়রা এলেন না, বিশ্বের পশ্চিম গোলার্ধ থেকে শুরু করে পূর্ব গোলার্ধের অনেকগুলো দেশে ট্র্যাভেল এ্যালার্ট জারি হলো, বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদেশী কর্মী উইথড্র হলো এবং আরো কত কি। বাংলাদেশ সরকার বিদেশীদেরকে খুশী করার জন্য গুলশান এলাকাকে রীতিমত দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে ফেলেছেন। গত ১০ তারিখে আমি গুলশানে ঘুরছিলাম। কয়েকটি রাস্তায় দেখা গেল উদ্যত সঙ্গীন হাতে টহলরত অস্ত্রধারী বাহিনী। এক দিকে বর্ডার গার্ড, অন্যদিকে একটি নতুন বাহিনী। নাম সোয়াত। রীতিমত ভীতিকর অবস্থা। বিদেশীদের তৎপরতাজাপান থেকে এসেছে একটি স্পেশাল টিম। তারা হোসি কোনিওর খুনের তদন্ত করছেন। এসেছে জাতিসংঘ টিমও। বিদেশীরা এখন একলা বা দোকলাভাবে পথ চলতে ভয় পান। তাই তারা রিসেন্টলি সংঘবদ্ধভাবে চলছেন। মুসিবতে পড়েছেন মোটরসাইকেল ওয়ালারা। গুলশান এবং রংপুর উভয় স্থানেই যারা দুই বিদেশীকে হত্যা করেছে তারা সকলেই ছিল মোটরসাইকেল আরোহী। হতে পারে, সে কারণেই মোটর সাইকেলগুলো তন্ন তন্ন করে তল্লাশী করা হচ্ছে। সরকারের তৎপরতার অভাব নাই। ধারণা করছি যে, সরকারের আন্তরিকতারও অভাব নাই। কিন্তু তারপরেও তাভেলা সিজার হত্যার পর আজ ১৫ দিন হয়ে গেল। অথচ আজ পর্যন্ত একজনকেও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ওরা কারা? খুন করেই ওরা ভোজবাজির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? অথচ আমরাই তো বলি যে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি ইচ্ছা করে তাহলে অপরাধীকে মাটির নীচ থেকেও উঠিয়ে আনতে পারে। কিন্তু এখানে কারও টিকিটিরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? আইএস আছে, আইএস নাইবাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বাহিনী যখন সবেমাত্র তদন্ত শুরু করেছে ঠিক সেই মুহূর্তে আইএসের নামকরে টুইট বার্তা আসে। বলা হয় যে, আইএস এই দুটি হত্যাকা-ই ঘটিয়েছে। প্রথমে খবর রটে যে, আমেরিকার শিকাগো থেকে আইএসের নামে ঐ টুইট বার্তা আপলোড করা হয়েছে। কিন্তু গত ১১ তারিখ রবিবার তথ্য প্রযুক্তি বিশারদদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, ঐ ম্যাজেস দুটি আপলোড করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী এই দুটি হত্যাকা-ের সাথে আইএসের সংশ্লিষ্টতার কথা দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করেছেন। যদিও অনেকদিন থেকে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব রয়েছে বলে পুলিশ থেকেই দাবি করা হয়। আর সরকারও সে প্রচারণা চালায় লাগামহীনভাবে। এ পর্যন্ত সব মনে হয় ঠিক মতই চলছিল। অবশ্য আইএসের সম্পৃক্ততার খবরটি এমন জোরের সাথে অস্বীকার করাটা কিছুটা বিদঘুটে লেগেছে। কারণ, এখনও তো তদন্ত চলছে। তার আগেই আপনি কিভাবে বলেন যে, আইএস এসব ঘটনার পেছনে নাই? আইএস আছে, তাও তো বলা যায় না। এসব তো বলবেন তদন্ত কমিটি, তাদের রিপোর্টে।হঠাৎ করে বিএনপি জামায়াতকে আনা হলোযাই হোক, যখন এমন একটি জটিল অবস্থার মধ্যদিয়ে তদন্ত এগুচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে সুদূর আমেরিকায় বসে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয় যে, বিএনপি-জামায়াত এই হত্যাকা-ের সাথে জড়িত থাকতে পারে। তারপর যতই দিন যেতে থাকে ততই বিএনপি জামায়াতের বিরুদ্ধে বিশেষ করে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ উত্থিত হওয়া শুরু হয়। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহম্মদ নাসিম, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ আরও মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা কখনো প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনো পরোক্ষভাবে সরাসরি ২০ দলীয় জোট নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে দায়ী করেন। একাধিক মন্ত্রী এবং অত্যন্ত সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতারা কোনোরূপ রাখঢাক না করে বলেন যে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য বেগম জিয়া লন্ডন গেছেন এবং সেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তারা আরও বলেন যে, লন্ডনে বসে বেগম জিয়া বাংলাদেশে মানুষ মারার চক্রান্ত করছেন। বিচারের আগেই রায়?আইএস জড়িত কি আইএস জড়িত নয়, সেটা বের করবে কে? অবশ্যই তদন্ত টিম। বেগম খালেদা জিয়া অথবা বিএনপি-জামায়াত জড়িত কিনা, সেটিই বা বের করবে কে? অবশ্যই তদন্ত টিম। এর আগে তো পরোক্ষভাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রাক্তন মন্ত্রী মঈন খানকে জড়িত করা হয়েছিল। ইদানিং তাকে নিয়ে আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। লন্ডনে বেগম জিয়া যদি এত বহুমুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন তাহলে সরকার ঝেড়ে কাশেন না কেন? এত বড় ষড়যন্ত্র যদি তিনি করে থাকেন তাহলে তাকে কি এই অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে? যদি সরকারের অভিযোগ সত্যি হয় তাহলে তো দাঁড় করানোই উচিত। না হলে এগুলো তো স্রেফ পলিটিক্যাল রেটোরিক হয়ে দাঁড়াবে। এত স্পর্শকাতর বিষয়ে কি পলিটিক্যাল রেটোরিকের আশ্রয় নেওয়া উচিত? সমাধান: নির্ভেজাল গণতন্ত্রসরকারের অবস্থান ও নীতির মধ্যে কনসিসটেন্সির অভাব লক্ষ্য করা যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, দেশে কোনো আইএস নাই। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম আরেক ডিগ্রী ওপরে উঠে বলেছেন যে, দেশে জঙ্গিবাদ বলে কিছু নাই। আরেকজন বলেছেন যে, বাংলাদেশে আইএস থাকার দরকার নাই, বিএনপি এবং জামায়াতই যথেষ্ট। তাদের মতে, ওই দুটি দল এখন আর রাজনৈতিক দল নয়। তারা এখন জঙ্গি পার্টি হয়ে গেছে। যেমন কথা, তেমন কাজ। তদন্ত এখনও সিঁড়ি ঘরে ঘোরাফেরা করছে। অথচ দেশজুড়ে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতের নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। গত ১৩ তারিখ মঙ্গলবার একাধিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক সিজার হত্যার পর প্রায় ১৫ দিনে কম করে হলেও সাড়ে ৩ হাজার বিরোধী দলীয় নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার অভিযান এখনও চলছে। তদন্ত এখনও শেষ হয় নাই। বিচার তো পরের কথা। মনে হচ্ছে বিচারের আগেই রায় ঘোষণার মহড়া চলছে। যদি জঙ্গিবাদ থেকেই থাকে তাহলে এভাবে কি তার মোকাবেলা করা যাবে? এটি নতুন করে বোঝানোর দরকার নাই যে, জঙ্গিবাদের প্রজনন ক্ষেত্র হলো স্বৈরতন্ত্র। যেখানে বাক স্বাধীনতা নাই, লেখার স্বাধীনতা নাই, যেখানে প্রকাশ্য সভা-সমিতি, মিছিল করা তো দূরের কথা, মানব বন্ধন পর্যন্ত করা যায় না তেমন পরিস্থিতিই তো ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের উপযুক্ত অবস্থা। যেখানে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ছাড়া আর সব বিষয়ে অবাধে কথা বলা যায়, সে ক্ষেত্রে এখানে সেখানে কিছুটা উঁকি ঝুঁকি মারলেও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র নয়, নির্ভেজাল গণতন্ত্রই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠিন বুল ওয়ার্ক। অবাধ ও নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করলে জঙ্গিবাদকে জনগণই মাথাচাড়া দিতে দেবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন