আজ ২২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার। আর ২ দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পালিত হবে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। মুসলমানরা পশু কোরবানি দেবেন। নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই এবং কাউকে জ্ঞান দানেরও প্রয়োজন নেই যে, এই ঈদ ত্যাগের ঈদ। পশু কোরবানিকে উপলক্ষ করে এই ঈদ মানুষের মনের পশু প্রবৃত্তিকে কোরবানি করার ঈদ। সে জন্যই বাংলাদেশের জাতীয় কবি, পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পবিত্র ঈদ উপলক্ষে একটি অমর কবিতা লিখেছেন। তার ‘অগ্নিবীণায়’ প্রকাশিত এই কবিতার নাম ‘কোরবানি’। এই কোরবানির ওপরে নজরুল যা লিখেছেন তার জুড়ি আর আমি পাইনি। দুঃখ হয়, যে বাংলাদেশে এখন এই ধরনের কবিতা পত্র-পত্রিকা বা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় না। রেডিও-টেলিভিশনেও এই কবিতার আবৃতি করা হয় না এবং এটি নিয়ে কোনো আলোচনাও হয় না। অথচ কোরবানির ওপর এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কবিতা আমার চোখে পড়েনি। তাই এই কবিতার কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ আমি নিচে তুলে দিলাম-‘এয় ইব্রাহিম আজ কোরবানি কর শ্রেষ্ঠ পুত্রধন!’ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।তাই জননী হাজেরা বেটারে পরাল বলির পূত বসন!ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।এই দিনই ‘মীনা’-ময়দানেপুত্র-স্নেহের গর্দানেছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে রেখেছে আব্বা ইব্রাহিম্ সে আপনা রুদ্র পণ!ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।মুসলিম-রণ-ডঙ্কা সে,খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে?টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারেওরে হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম কারা লড়ব রণ-মরণ!ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ!আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।অথচ ঈদুল আযহার এক সপ্তাহ আগে আমরা কি দেখছি? মাত্র এক কি দুই দিনে অসংখ্য ভয়াবহ খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ এবং ছিনতাই। এই লেখাটি লিখছি রোববার ২০ সেপ্টেম্বর। ২০ সেপ্টেম্বরের পত্রিকার কয়েকটি রিপোর্ট এখানে উল্লেখ করছি। একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট মোতাবেক, বাড়ছে খুন। পাল্টাচ্ছে খুনের ধরনও। প্রতিটি খুনের ঘটনাই নির্মম। একটি নির্মম ঘটনা ছাড়িয়ে যাচ্ছে অন্যটিকে। এক কথায় লোমহর্ষক। শুনলেই গা শিউরে ওঠে। হত্যার পর পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে লাশ। উপড়ে ফেলা হচ্ছে চোখ। কেটে দেয়া হচ্ছে হাত-পায়ের রগও। শ্বাসরোধ থেকে শুরু করে জনসম্মুখে পিটিয়ে হত্যা বা ছুরিকাঘাতে খুন এখন সাধারণ বিষয়। জীবন্ত মানুষকে হাত-পা বেঁধে ফেলে দেয়া হচ্ছে পানিতে। যেখানে-সেখানে মিলছে লাশ, ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ। হত্যার পর টুকরো টুকরো করা হচ্ছে লাশ। পাওয়া যাচ্ছে লাশের খ-িত অংশ। গলা কেটে হত্যার ঘটনা বাড়ছে দিনকে দিন। নৃশংস এসব ঘটনার শিকার হচ্ছে শিশুরাও। হত্যার পর স্যুটকেসবন্দি করে রাখা হচ্ছে লাশ। লাশ পাওয়া যাচ্ছে ট্রাভেল ব্যাগেও। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মানবিক অনুভূতি দিন দিন লোপ পাচ্ছে। মানুষের মনে দানা বাঁধছে হিংস্রতা। তাই হত্যার পরও জিঘাংসা মেটাতে লাশ কেটে টুকরো টুকরো করা হচ্ছে। নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মানুষ। সামান্য ঘটনাতেই একে অপরকে খুন করতে দ্বিধা করছে না। দীর্ঘদিনের প্রিয় স্বজনই হয়ে উঠছে ঘাতক। স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, বাবা-মা খুন করছে নিজের সন্তানকে, সন্তানের হাতেও খুন হতে হচ্ছে বাবা-মাকে। ভাইয়ের হাতে খুন হচ্ছে ভাই, আত্মীয়ের হাতে খুন হচ্ছে আত্মীয়। কমে যাচ্ছে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ। চিড় ধরেছে সামাজিক বন্ধনেও। ভোগবাদী হয়ে উঠছে মানুষ। কমছে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ। ॥ দুই ॥গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকা, দিনাজপুর, খুলনা, কসবা ও জয়পুরহাটে ৫টি নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর কদমতলী এলাকায় সোহেল নামে এক যুবককে কুপিয়ে ও মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। দিনাজপুরে এক যুবককে হত্যার পর পেট্রল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। জয়পুরহাটে এক ওষুধ ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। কসবায় ছেলেকে বেঁধে রেখে মায়ের গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। খুলনায় ডাকাতিতে বাধা দেয়ায় এক মহিলা ব্যাংক কর্মকর্তা ও তার বৃদ্ধ পিতাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। জয়পুরহাট শহরের সবুজনগরে তরিকুল ইসলাম (২৮) নামের এক ওষুধ ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তার বাসার অদূরে শহরের পাঁচুরচক সড়কের পাশের একটি জমি থেকে শনিবার সকালে পুলিশ তার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। তরিকুল ইসলাম সবুজ নগর এলাকার আবদুল কুদ্দুসের ছেলে।কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের জগন্নাথপুর আমতলী গ্রামে গত শুক্রবার গভীর রাতে ছেলেকে বেঁধে রেখে তার সামনেই মাকে হাত পা বেঁধে জবাই করে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় ওই নারীর কান থেকে স্বর্ণের দুল ও নগদ টাকা লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। খুলনায় ডাকাতিতে বাধা দেয়ায় এক্সিম ব্যাংকের খুলনা শাখার ক্যাশ কর্মকর্তা পারভীন সুলতানাকে (২৫) ও তার বৃদ্ধ পিতা ইলিয়াস হোসেনকে (৭০) শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে পুলিশ খুলনার লবণচরা থানার বুড়ো মৌলভীর দরগার পেছনে ৩নং রোডের একটি টিনশেড বাড়ির সেফটি ট্যাঙ্ক থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করেছে। পুলিশের ধারণা, ডাকাতি ও মেয়েকে ধর্ষণের পর দু’জনকেই শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মালামাল লুট করেছে ডাকাতরা। গত শুক্রবার বণিক বার্তা নামে একটি জাতীয় পত্রিকার সহকারী ব্যবস্থাপকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে স্যুটকেসের ভেতর থেকে। ঘটনার দুই দিন আগে জাহাঙ্গীর আলম নামে এই বিজ্ঞাপন কর্মকর্তাকে অপহরণ করা হয়। পরে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ গুমের জন্য স্যুটকেসে রাখা হয়। একদিন আগে বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের জামতলায় ধোপা পট্টিতে বাসায় ঢুকে সোনালী দাস নামে দশ বছরের এক শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সনদ্বীপে সুমাইয়া নামে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ১০ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ সদরের যশোদল ইউনিয়নের আমটি শিবপুর এলাকায় শামীম মিয়া নামে এক অটো রিকশা চালককে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। মাদক সেবনে বাধা দেয়া দুর্বৃত্তরা তার হাত পা ও মুখ বেঁধে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই দিনে মানিকগঞ্জের মনির নামে এক কলেজ ছাত্রকে অপহরণের পর হাত পা বেঁধে জীবন্ত অবস্থায় পানিতে ফেলে হত্যা করা হয়। এর কয়েকদিন আগে একই কায়দায় সাভারের মুন্না নামে অপর এক কলেজ ছাত্রকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে মাজারের ভেতর রহমত উল্লাহ ও আবদুল কাদের নামে দু’জনকে জবাই করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৩ আগস্ট মাদারীপুরে হ্যাপী ও সুমাইয়া নামে দুই স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।॥ তিন ॥রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে চার ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ১৬টি গরুসহ একটি ট্রাক ছিনতাই করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। গুরুতর আহত ব্যবসায়ী মাসুম (২৪), সুজা (২৬), হাসু মিয়া ওরফে ঠা-ু (৪৫) ও তানজিমুলকে (২৮) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে এ ঘটনা ঘটে। আহত মাসুম জানান, ১৬টি গরুসহ একটি ট্রাক নিয়ে ঝিনাইদহের মহামায়া থেকে বাড্ডার আফতাব নগরের হাটে আসছিলেন তারা। ঢাকা আসার পথে তাদের একটি গরু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। শুক্রবার রাত ১টার দিকে ট্রাক চালক সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউতে ট্রাকটি থামালে একটি পিক আপ ভ্যানে কয়েকজন দুর্বৃত্ত এসে তাদের মারধর করে ট্রাকটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ট্রাক চালকের যোগসাজশে দুর্বৃত্তরা ট্রাকসহ ১৬টি গরু ছিনিয়ে নিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।পুলিশের গুলিতে তিন গ্রামবাসী নিহত হওয়ার পর টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে চলছে মাতম, স্বজনদের আহাজারি। গোটা এলাকায় থমথমে অবস্থা। শহরের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গত শনিবার ছিল বন্ধ। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সাধারণ মানুষের চলাচল কমে যায়। পুলিশি আতঙ্কের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে বিরাজ করেছে চাপা ক্ষোভ। নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে গত শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে পুলিশ। গত শনিবার রাতে ঘাটাইল ও কালিহাতী পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করে। গত শনিবার পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওই ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়। হাসপাতালে ময়না তদন্ত শেষে গত শনিবার দুপুরে তিনজনের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের পরিবারে চলছে মাতম। প্রতিবেশীরাও এসে সমবেদনা জানাচ্ছেন। লাশ হস্তান্তরের পর শুরু হয় পরিবারগুলোতে আহাজারি।॥ চার ॥এই হলো ঈদের এক সপ্তাহ আগের সমাজ চিত্র। কোন দেশে বাস করছি আমরা? ছেলের সামনে মাকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করা হলো। গ্রামবাসী এই বর্বর ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে এসে নিজেরাই গুলি খেয়ে মরল। পুলিশ ধর্ষকদের বিরুদ্ধে এপর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উল্টো ৩শ’ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করল। এটা কি দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন হচ্ছে? নাকি শিষ্টের দমন এবং দুষ্টের পালন হচ্ছে? সমাজের এই বিভৎস অবস্থা থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। একমাত্র উপায় হলো ঈদুল আযহার শিক্ষা। নিজের মনের ভেতরের পশু প্রবৃত্তিকে জবাই করতে হবে। মনের ভেতরের এই পশু প্রবৃত্তির নাম নফসে আম্মারা। নফসের কার্যক্রম ও বিভিন্ন অবস্থানের কারণে নফসকে তথা মানুষকে বা তার কার্যক্রমকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়ে থাকে। কোরআনে বর্ণিত আছে- হূম দারাজ্বা তুন ইন্নাল্লা-হ; আল্লাহূ বাসিরুম্মিম ইয়া মালূন (৩ঃ১৬৩)। অর্থ : আল্লাহ্র কাছে মানুষ বিভিন্ন স্তরের। তারা যা করে আল্লাহ্ তার সম্যক দ্রষ্টা।আর তাই নফসের বিভিন্ন অবস্থানের উপর ভিত্তি করে একে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। (১) নফসে আম্মারা (২) নফসে লাওয়ামা (৩) নফসে মুৎমায়েন্না (৪) নফসে মুলহেমা (৫) নফসে রহমানী।পবিত্র কোরআনে এরশাদ করা হয়েছে, ‘ইন্না নাফছা লা আম্মারাতুম বিচ্ছুয়ে ইল্লামা রাহেমা রাব্বি (১২ঃ৫৩)।’ অর্থ : ‘যাদের আমার প্রভু রহমত করেন তাদের ছাড়া নিশ্চয়ই নফসে আম্মারা অন্যদেরকে বদ কাজ করায়’। নফসে আম্মারাই মানুষকে কু-কাজ করায়। এটাকে দমনই তাই প্রথম কাজ। নফসে আম্মারাকে আবার ষড় রিপুও বলা হয়। এই ষড় রিপুর তাড়নার কথা অন্যান্য ধর্মেও বলা হয়েছে।এই ষড় রিপু বা ছয়টি রিপু হলো- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ (অহঙ্কার), মাৎসর্য (পরশ্রীকাতরতা)। ঈদুল আযহা বা কোরবানির মূল স্পিরিট হলো নফসে আম্মারা বা এই ষড় রিপুর ধ্বংস সাধন বা নিয়ন্ত্রণে আনা। আসুন, কোরবানি ঈদের পূর্বাহ্নে আমরা এই নফসে আম্মারা বা ষড় রিপুকে ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা করি।Email:
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন