|
মোবায়েদুর রহমান
|
|
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে অচলাবস্থা
30 July 2015, Thursday
দেশের পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি এবং ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশের প্রধান ২ টি রাজনৈতিক ক্যাম্প অর্থাৎ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট প্রকাশ্যে না হলেও অপ্রকাশ্যে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার সমিতির নব নির্বাচিত কর্মকর্তাবৃন্দ বেগম জিয়ার সাথে তার গুলশান কার্যালয়ে দেখা করতে আসেন। সেখানে বেগম জিয়ার একটি মন্তব্যকে এক শ্রেণীর সরকারপন্থী মিডিয়া ইচ্ছে মত বিকৃত ভাবে ব্যাখ্যা করছে। বিকৃত ব্যাখ্যার সেই প্রক্রিয়ায় বলা হচ্ছে যে, বেগম জিয়া তথা বিএনপি আগামী নির্বাচন ইস্যুতে একটি বিশাল ছাড় দিয়েছেন। বলা হচ্ছে যে, তিনি আর তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে অনড় নন। এখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক তো দূরের কথা, নির্বাচনকালে তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবী থেকেও সরে এসেছেন। এখন তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে রাজী। দাবী মেনে সরকার যদি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয় তাহলে শেখ হাসিনার অধীনে হলেও বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। খবরটি সঠিক নয়বেগম জিয়ার ঐ বক্তব্যের সূত্র ধরে শুধুমাত্র আওয়ামী পন্থী পত্র-পত্রিকাই নয় আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাও বিএনপি বিশেষ করে বেগম জিয়ার প্রতি বক্রোক্তি করছেন। সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদসহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন যে, শেখ হাসিনার পতন ছাড়া খালেদা জিয়া নাকি রাজপথ থেকে ঘরে ফিরবেন না। শেখ হাসিনার পতন হয়নি। কিন্তু খালেদা জিয়া পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করে ঘরে ফিরেছেন। তিনি আরও বলেন, বেগম জিয়াকে নির্বাচন করতে হলে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। একই ধরনের বক্তব্য দেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। আওয়ামী লীগপন্থী একাধিক পত্রিকা গত দুই দিন ধরে রীতিমত ঘোষণা দিচ্ছে যে, নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে বিএনপি সম্পূর্ণ ইউটার্ন করেছে। একটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে বলা হয়েছে যে, বর্তমান সরকার প্রধান বা প্রেসিডেন্ট স্বপদে বহাল থাকলেও সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতেও আপত্তি নেই বিএনপির। আওয়ামী ঘরানার একাধিক পত্র-পত্রিকা এবং নেতৃবৃন্দ যখন বেগম খালেদা জিয়ার তথাকথিত ‘আত্মসমর্পণ’ নিয়ে কোরাস গাইতে শুরু করেছে তখন ডেইলি স্টার সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের রিপোর্ট ছেপেছে। গত সোমবার ডেইলি স্টারে যে রিপোর্ট ছাপা হয়েছে, সেই রিপোর্টের শিরোনাম:POLLS UNDER NON-PARTY GOVT/Khaleda won’t budge from demand. বঙ্গানুবাদ: “নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন/ দাবী থেকে খালেদা সরবেন না।” রিপোর্টে বলা হয়, “গত শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার সমিতির নব নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের নিকট তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেই বক্তব্যের পর অনেকের মনে একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে যে, বেগম জিয়া হয়ত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবী থেকে সরে এসেছেন। তাদের কাছে তিনি বলেছেন যে, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কেয়ারটেকার সরকার একটি অপরিহার্য শর্ত নয়। তিনি বলেন, নাম যাই হোক না কেন, এটি একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেও হতে পারে। তবে তিনি সেখানে একথাও দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোন বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না।”মওদুদ আহমেদের বক্তব্যব্রাহ্মণবাড়িয়া আইনজীবী সমিতির নব নির্বাচিত কর্মকর্তারা যখন গুলশান কার্যালয়ে বেগম জিয়ার সাথে কথা বলেন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। জনাব মওদুদ আহমেদ বলেন যে, সেদিন দলীয় প্রধান অর্থাৎ বেগম জিয়ার এ্যাপ্রোচ হয়তো ভিন্ন ছিল। কিন্তু তার মূল বক্তব্যের কোন হেরফের হয়নি। সেই মূল বক্তব্য ছিল এই যে, ভবিষ্যৎ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনেই হতে হবে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, বিএনপি প্রধান সেদিন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ভবিষ্যতে যদি কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে কোন অবস্থাতেই সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। নির্বাচনকালীন যে সরকার হবে সেটি অরাজনৈতিক এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হতে হবে। বেগম জিয়া সেদিন যা বলেছেন তার অন্তর্নিহিত বক্তব্য ছিল এটি।জোটের শরীকদের বক্তব্যবিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান পত্রিকান্তরে বলেন, আমাদের দাবি হচ্ছে, এমন একটা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা, যার অধীনে সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যেতে সম্মত হবে। ওই সরকারের ভূমিকা নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন থাকবে না। শর্তসাপেক্ষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ নিয়ে থিঙ্ক ট্যাঙ্কদের কেউ কেউ মতামত তুলে ধরলেও দলীয় ফোরামে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। আর নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কার্যপ্রণালী কেমন হবে তা সব দলের আলোচনার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত করা হবে।২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ একটি বাংলা দৈনিককে বলেন, জোটনেত্রী এর আগেও এমন দাবি জানিয়েছেন। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন তার চেয়ে বড় হচ্ছে তার ভূমিকা নিরপেক্ষ হবে কিনা। কয়েকটি শর্তে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে বিএনপি জোট নির্বাচনে যেতে পারে এমন আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক। কোনো থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বা অন্য কেউ কি বলল তাতে কিছু হবে না। রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে এবং রাজনীতিবিদদেরই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।জোটের আরেক শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী যুগান্তরকে বলেন, শর্তসাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে, এই নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা তাদের মতামত দিতেই পারেন। কিন্তু জোটগতভাবে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে এমন প্রমাণ তারা কখনও দিতে পারেনি। তাই তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন এটা বললেও সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করবে না। বিভ্রান্তির উৎস এমাজউদ্দিনওপরে উল্লিখিত জোট শরীকদের বক্তব্য এবং মওদুদ আহমেদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, বেগম জিয়া অথবা বিএনপি অথবা ২০ দল আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তো দূরের কথা, এ নিয়ে কোনো চিন্তা ভাবনাও করেননি। এই বিষয়ে আওয়ামী ঘরানা যে কথা ছড়াচ্ছে সেই কথা এবং তাদের বক্তব্যের রসদ যুগিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ। দৈনিক যুগান্তরকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়ে তিনি বলেছেন, ৪ শর্তে নাকি বিএনপি শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করতে পারে। এসব শর্ত হলো (১) নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন, (২) আইন শৃঙ্খলা সহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা, (৩) মেয়াদ শেষে সংসদ বাতিল এবং (৪) বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন। জনাব এমাজউদ্দিন এই সব শর্ত কোথায় পেলেন, সেটা তার পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন। এছাড়া এই ধরনের নীতিগত বক্তব্য দেওয়ার জন্য তাকে অথারাইজ করা হয়েছে কিনা সেটিও তাকে পরিষ্কার করে বলতে হবে। বার ভূতের কারবারহাল আমলে বিএনপির সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে এই যে, দলটি এখন যেন বার ভূতের কারবারে পারিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা যেদিকে আঙ্গুল ঘোরান সাথে সাথে তার সমস্ত নেতা ও কর্মী সেই দিকেই হেলে পড়েন। কিন্তু বিএনপিতে এই ধরনের শৃঙ্খলার বড় অভাব। বিএনপি এই মুহূর্তে ১২ ভূঁইয়ার একটি সংগঠন। চলছে সেখানে ফ্রিস্টাইল কারবার। যার যা মনে হচ্ছে তিনি তাই বলছেন। আর এ জন্যই আওয়ামী লীগ উঠতে বসতে বিএনপির প্রতি এমন সব কটাক্ষ করছে যা তাদের মান সম্মান ধরে টানাটানি করার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বিএনপির চেইন অব কমান্ড স্ট্রীক্ট না হওয়ার কারণেই আওয়ামী লীগ বেল্টের নীচে আঘাত করার সুযোগ পাচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন