বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেল থেকে গত বৃহস্পতিবারের পত্রপত্রিকায় ঘোষণা দেওয়া হয় যে, পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার ২৪ জুলাই ওই চ্যানেলে বেলা ৩টায় ‘উত্তম গান’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। এ সম্পর্কে চ্যানেলটির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, এই অনুষ্ঠানে পরলোকগত সিনেমা নায়ক উত্তম কুমারের স্মৃতিচারণ করবেন তারই অন্যতম সহকর্মী এবং অন্তরঙ্গ দোসর সুপ্রিয়া চৌধুরী। বিভিন্ন ছায়াছবিতে যেসব গানে উত্তম কুমার লিপ দিয়েছেন সেসব গানের কোন কোনটি এই অনুষ্ঠানে গাওয়া হবে। গাইবেন বাংলাদেশের রেডিও ও টেলিভিশন শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন একঝাঁক দম্পতি যাদের প্রায় সকলেই ৫০ পেরিয়ে গেছেন। অনেকে আবার ষাট-সত্তরও পেরিয়ে গেছেন। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এসব দম্পতির প্রায় সকলেই সেলিব্রিটি। তাদের কেউ কেউ অনুষ্ঠানে তাদের কৈশর এবং যৌবনে উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন সম্পর্কে তাদের অনুভব ব্যক্ত করবেন। বলা বাহুল্য, এটি ছিল একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘোষণা। ফলে সারাদেশের হাজার হাজার তথা লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় দারুণ ঔৎসুক্য। যারা পঞ্চাষোর্ধ্ব তাদের মাঝে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই শুরু হয় দারুণ নষ্টালজিয়া। সকলেই সেই ৫০ এবং ৬০ দশকের সুচিত্রা-উত্তমের স্মৃতি কাতরতায় আক্রান্ত হন। আমিও তাদের থেকে ব্যতিক্রম ছিলাম না। তাই ৩টা বাজার আগেই আমি সস্ত্রীক টেলিভিশনের সামনে হাজির হই এবং চ্যানেলটি চালু করি। এ সম্পর্কে আর কিছু বলার আগেই স্পষ্ট করে একটি কথা বলতে চাই যে, প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি লক্ষ লক্ষ দর্শক-শ্রোতার মাঝে যে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল, অনুষ্ঠান শেষ হলে দেখা গেল যে সেই আগ্রহের ৫০ শতাংশও পূরণ হয়নি। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, আবার অনুষ্ঠানের শুরুতেও ঘটা করে বলা হলো যে, সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হক এই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করবেন। শামসুল হক ঠিকই এলেন, উপস্থাপনাও করলেন। কিন্তু কোথায় তার সেই উপস্থাপনার জৌলুস? একজন অশতিপর বৃদ্ধকে দিয়ে কি এমন ঝলমলে অনুষ্ঠান উপস্থাপন হয়? হয় না এবং এটিও হয়নি। অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। সুপ্রিয়া চৌধুরী রূপালি পর্দায় শুধুমাত্র উত্তম কুমারের সহযাত্রীই নন, তাদের দু’জনের ব্যক্তিগত সম্পর্কও অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতায় রাঙানো ছিল বলে ঐ জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেন। তাদের দু’জনকে নিয়ে টালিগঞ্জে অনেক কথা বাতাসে আজও ভেসে বেড়ায়, যেমন ভেসে বেড়াতো সুচিত্রাকে নিয়ে। অনেকে বলেন, এই ধরনের গসিপ রূপালি জগতের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তাদের সম্পর্ক এই গসিপের উর্ধ্বে আরও কিছু ছিল বলে ঐ জগতের প্রবীণরা বলেন। সেই সুপ্রিয়া চৌধুরীকে বলতে গেলে অ্যাংকর কিছুই বলতে দিলেন না। দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি প্রশ্নেই সুপ্রিয়া যেভাবে জবাব দিতে যাচ্ছিলেন সেই জবাবের মাঝ পথে তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নেওয়া হয়। তারপরেও শেষ পর্যায়ে তিনি বলেই ফেলেন যে, উত্তম কুমারের সাথে তার ঘনিষ্ঠতার কথা স্মরণ করলে তার বড় কষ্ট হয়। তাই বললেন, আজ সেসব কথা নাহয় নাইবা বললাম। যখন তিনি এই কথা বলেন তখন আমার মনে পড়ল সন্ধ্যা মুখার্জীর সেই কালজয়ী গানের একটি চরণ, ‘নয়ন কোণে মোর সজল বরিষণ / থাক না গোপনে’। যেসব অতিথিকে এই অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয়েছিল তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন একটি বিশেষ ঘরানার। এদের মধ্যে দু’জন ছিলেন মন্ত্রী। এরা হলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ছিলেন কয়েকজন রাজনীতিবিদ এবং সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ। এটা এখন ওপেন সিক্রেট যে, বাংলাদেশের সমাজের প্রতিটি স্তর এবং প্রতিটি সেক্টর এখন সার্পলি দ্বিধা বিভক্ত। পলিটিশিয়ান ছাড়াও কালচারাল ফিগার, গায়ক-গায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবীÑ কে নয়? সংখ্যার দিক দিয়ে বলতে গেলে ‘কেহ কারে নাহি পারে সমানে সমান’। কোন রাজনৈতিক দল তার অনুষ্ঠানে দাওয়াত করতে গেলে সেই রাজনৈতিক বিভাজন বিবেচনায় নিতেই পারে। কিন্তু তাই বলে একটি টেলিভিশন চ্যানেল সেটি করবে কেন? ॥ দুই ॥বলা হয়েছে উত্তম গান। কিন্তু যেসব গান গাওয়া হবে সেগুলো নির্বাচন সঠিক ছিল বলে মনে হলো না। মনে হলো যে, দু-একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত পছন্দের গান এখানে নির্বাচন করা হয়েছে। তাই যদি না হবে তাহলে নির্বাচিত গানগুলোর মধ্যে মান্না দে এবং কিশোর কুমারের গানের ছড়াছড়ি কেন? কেন শ্যামল মিত্রের গানের আধিক্য? একটি দিক অবশ্য ভালো লেগেছে। সেটি হলো, গৌরী প্রসন্ন মজুমদার যেসব গান লিখেছেন সেগুলোকেই দারুণভাবে অনুষ্ঠান পরিবেশনায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। উত্তম-সুচিত্রা যুগে উত্তম-সুচিত্রাকে ঘিরে আরও তিন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দারুণ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। এরা হলেন, হেমন্ত কুমার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং গৌরী প্রসন্ন মজুমদার। হেমন্ত মুখার্জী যথার্থই বলেছেন, তার কণ্ঠের গাওয়া গান যখন ছায়াছবিতে উত্তম কুমারের ঠোঁট দিয়ে পরিবেশিত হয় তখন আর সেটি হেমন্তের গান থাকে না। তখন সেটি হয়ে যায় উত্তম কুমারের গান। হেমন্ত কুমারের কথা ধার করে বলা যায়, সন্ধ্যা মুখার্জীর কণ্ঠের গাওয়া গান যখন ছায়াছবিতে সুচিত্রা সেনের ঠোঁট দিয়ে পরিবেশিত হয় তখন আর সেটি সন্ধ্যা মুখার্জীর গান থাকে না। সেটি হয়ে যায় সুচিত্রা সেনের গান। আর উত্তম ও সুচিত্রার লিপ দেওয়া অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকার হলেন গৌরী প্রসন্ন মজুমদার। এই ৫ জন সেই জামানায় বাংলা ছায়াছবির জগতে হয়ে উঠেছিলেন পঞ্চরতœ। উত্তম কুমারের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। একই সাথে অনুষ্ঠানটিকে গ্ল্যামারাস করার জন্য ঈদ অনুষ্ঠানমালার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই অনুষ্ঠানের ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিসে যাওয়ার আগে অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাকারীদেরকে বিশেষ ধন্যবাদ না জানালে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। সেটি হলো, অনুষ্ঠানটিকে তারা বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে জর্জরিত করেননি। এ ধরনের একটি মেগা প্রোগ্রাম, যেটি পূর্বাহ্নিক ঘোষণা দেওয়ার ফলে সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল, তেমন অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপনের নহর বইয়ে দেওয়া যেত এবং তার ফলে কর্তৃপক্ষ বিপুল অর্থ রোজগার করতে পারতেন। কিন্তু এখানে তারা পরিমিতি বোধের পরিচয় দিয়েছেন এবং দর্শক সাধারণের সেন্টিমেন্টকে সম্মান জানিয়েছেন। ॥ তিন ॥এই অনুষ্ঠানে যারা উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন এবং সুপ্রিয়া চৌধুরীর লিপ দেওয়া গান গাইলেন তারা হলেন সৈয়দ আবদুল হাদী, কনক চাঁপা, রিজিয়া পারভিন, ফেরদৌস আরা, সুবীর নন্দী, রফিকুল আলম, মনির খান প্রমুখ। নতুনদের মধ্যে আলিফ লায়লা, কোনাল, ইমরান এবং ঝিলিক। তবে উত্তমের গান যদি সাদী মোহাম্মদ, হাবিব এবং সুচিত্রা ও সুপ্রিয়ার গান যদি রুনা লায়লা, সাবিনা গাইতেন তাহলে অনুষ্ঠানের গাম্ভীর্য বজায় থাকতো। আগেই বলেছি যে, উত্তম কুমার এবং হেমন্ত মুখার্জী একাকার হয়ে গেছেন। অথচ সেই হেমন্তর গান এই অনুষ্ঠানে খুব কম সংখ্যায় পরিবেশিত হলো। উত্তমের লিপ দেওয়া ‘সাপ মোচনের’ সেই ‘শোন বন্ধু শোন’, ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে ফাগুনের গান গেয়ে’ প্রভৃতি গান যদি এই অনুষ্ঠানে গীত হতো তাহলে অনুষ্ঠানের বাতাস অন্য রকম হতে পারতো। অথবা ‘আজ দু’জনার দুটি পথ ওগো/দুটি দিকে গেছে বেঁকে’, ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি’, ‘মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে’, ‘পথ হারাবো হলে এবার’ প্রভৃতি গান যদি গাওয়া হতো তাহলে, আমি নিশ্চিত, অনুষ্ঠানের সমস্ত অভ্যাগতই মারাত্মক নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হতেন। ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশটা বড়’ অথবা ‘সূর্য ডোবার পালা’ গানগুলো অনুষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত হতে পারতো। ঐ অনুষ্ঠানে যাদের মেহমান হিসেবে দাওয়াত করা হয়েছিল তারা নিশ্চয়ই, ‘নিলাম ওয়ালা ছ’আনা’ অথবা ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ গানে দারুণভাবে স্মৃতি কাতর হতে পারতেন। ‘তারে বলে দিও সে যেন আসে না আমার দ্বারে’ কিংবা ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’ কিংবা ‘কে জানে ক’ঘণ্টা তাদের এই জীবনটা’, ‘আমি কোন পথে যে চলি’ বা ‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন’, এসব গান তারা ছাত্র থাকা কালে নিশ্চয়ই আকাশ বাণী কলকাতার অনুরোধের আসরে শুনতেন। আমরা এবং তারা সকলেই সেদিন শুনতাম ‘মার্ফি রেডিওর’ গান। যাদের বাসায় রেডিও ছিল আমরা তাদের বাসায় যেতাম অথবা সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বা ফজলুল হক হলের কমন রুমে এসব গান শুনতাম। স্মৃতি জাগানিয়া এসব গান গাইলে ফরিদুর রেজা সাগর বা শাইখ সিরাজের পরিকল্পনা, ইচ্ছা এবং আশা আরও বেশি করে পূরণ হতো। ॥ চার ॥যারা আমন্ত্রিত অভ্যাগত ছিলেন তারা সকলেই সস্ত্রীক এসেছিলেন। যেহেতু তাদের অর্ধাঙ্গিনী তাদের সাথে ছিলেন তাই মন্তব্য করার সময় তারা অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তবে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ‘ডেইলি স্টারের’ সম্পাদক মাহফুজ আনামকে। পতœী উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মাহফুজ আনাম স্পষ্ট ভাষায় বললেন যে, তিনি উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখতে যেতেন শুধুমাত্র সুচিত্রা সেনকে দেখার জন্য। আমি একজন নামকরা গায়িকাকে জানি। তিনি আমাকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তিনি উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখতে যান শুধুমাত্র উত্তম কুমারকে দেখার জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী এবং আমি সিনেমা হলে যেতাম শুধুমাত্র উত্তম-সুচিত্রার প্রেম দেখার জন্য। সুচিত্রা-উত্তম সারা বাংলায় যে কেমন ঝড় তুলেছিলেন সেটি একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করবো। বগুড়ার জলেশ্বরীতলা রোডে একটি লন্ড্রি দেওয়া হয়। লন্ড্রিটির নাম দেওয়া হয় ‘সুচিত্রা লন্ড্রী’। সাইন বোর্ডের নিচে লেখা ছিল, “আমাদের সুচিত্রা লন্ড্রীতে উত্তম রূপে কাপড় ধোলাই করা হয়”। Email:
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন