রাজনীতি নিয়ে তো অনেক লিখলাম। ‘ইনকিলাবেই’ লিখছি ২৫ বছর ধরে। তারও আগে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই লিখছি। অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক আজাদ’ থেকে শুরু করে অধুনালুপ্ত ইংরেজি ‘দৈনিক মর্নিং সান’ পর্যন্ত সর্বত্রই লিখেছি। মাঝখানে ইংরেজি ‘দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভারেও’ সম্পাদকীয় লিখেছি। এরকম ফিরিস্তি দেয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। এ কারণেই দিচ্ছি যে, আমার মত অনেকেই প্রায় অর্ধশত বছর ধরে দেশ এবং দশ সম্পর্কে লিখে চলেছেন। কিন্তু কোথাও কোনো কাজ হয়নি। রাজনীতির অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে। ইংরেজিতে যেটিকে বলা হয় ঋৎড়স নধফ ঃড় ড়িৎংব.স্বাধীনতার পর শুরুটা হয়েছিল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা দিয়ে। তারপর হলো সামরিক শাসন। তারপর হলো বহু দলীয় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন। তারপর আবার হল সামরিক শাসন। তারপর হলো বহু দলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন। তারপর বহু দলীয় সংসদীয় শাসনের আড়ালে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন। সেই জন্যই বলছিলাম যে, রাজনীতির অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়েছে। ॥ দুই ॥রাজনীতির কথা থাক। আসুন, ঢাকা মহানগরীর দিকে তাকাই। এই ঢাকা মহানগরীতে আমি অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বসবাস করছি। চোখের সামনে কত কি ঘটে যেতে দেখলাম। এই মহানগরীর আয়তন কত বড় হয়েছে সেটার হিসাব একমাত্র ডিআইটি বা রাজউক ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। যে কোনো একটি বহুতলা ভবনের ছাদে উঠলেই এই মহানগরীর বিশালতা সম্পর্কে আপনি একটি ভালো ধারণা পাবেন। তারপরেও আপনি দেখবেন যে, মহানগরীর এই সম্প্রসারণ বেড়েই চলেছে। এক সময় বড় মহানগরী বলতে আমরা বুঝতাম কলকাতাকে। মহানগরী কলকাতাকে নিয়ে সে যে কত রূপকথার গল্প। এখন আমাদের ঢাকাও একটি মেগা সিটি। এই মুহূর্তে এই মহানগরীর জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লক্ষ, অর্থাৎ মোটামুটি পৌনে দুই কোটি। ভারত বিভাগের পর যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে ৩ কোটি (মতান্তরে ৪ কোটি)। আর এখন শুধু ঢাকা মহানগরীর লোক সংখ্যাই পৌনে ২ কোটি। গত বছরের মে মাসে ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম। আমার গন্তব্যের মাঝপথে আসা-যাওয়ার সময় কলকাতায় থাকতে হয়েছিল। কলকাতায় থাকা সত্ত্বেও কোনরূপ আইডিয়া করতে পারিনি যে ঢাকা আর কলকাতা, এই দুইটি মহানগরীর মধ্যে কোনটি বড়। ঢাকা মহানগরী অনেক, অনেক বড় হয়েছে সত্যি। উন্নয়নের কথা অনেক ঢোল শোহরত যোগে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু নিট রেজাল্ট দাঁড়িয়েছে সেই প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মত। ড. মনমোহন সিং ভারতে দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রথম মেয়াদে তিনি বা তার দল কংগ্রেস যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তখন ক্ষমতায় ছিল বিজেপি সরকার। ঐ সরকার ব্যাপক প্রচারণা চালায় যে, তাদের আমলে সারা ভারতে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ব্যাঙ্গালোর এবং হায়দারাবাদে আইটি হাব বা তথ্য প্রযুক্তির নগর গড়ে উঠেছে। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয় বলে তৎকালীন ভারত সরকার দাবি করে। বোম্বে, চেন্নাই প্রভৃতি মহানগরী আলোয় ঝলমল করছে। কিন্তু বিরোধী দল দাবি করে যে, আলোর নিচেই রয়েছে অন্ধকার। বড় বড় শহর ছাড়িয়ে গেলেই শহরতলী বা গ্রামে দেখা যায় বঞ্চনা এবং অবহেলার চিত্র। কংগ্রেস দাবি করে যে, ভারতের কোটি কোটি মানুষের জন্য কখনো স্যানিটারি পায়খানা নেই, সুপেয় পানি নেই, গ্রামে-গঞ্জে বিজলী বাতি নেই। মানুষ কংগ্রেসের কথা শুনেছিল এবং বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় বসিয়ে ছিল। অবশ্য দুই মেয়াদে দেশ শাসন করার পর গত বছরের ইলেকশনে ভারত জুড়ে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটেছে। নরেন্দ্র মোদির নের্তৃত্বে বিজেপি আবার দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। ॥ তিন ॥বাংলাদেশের অবস্থা বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর অবস্থা ১০ বছর আগের ভারতের চেয়েও খারাপ। গত শনিবার এরশাদপন্থী জাতীয় পার্টির মহিলা শাখার উদ্যোগে যমুনা ফিউচার পার্কে এক ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ঐ ইফতার মাহফিলে সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, পবিত্র রমজান মাসের প্রথম দশ দিন আল্লাহর কাছে রহমত চাওয়ার দিন। তিনি বলেন, কি রহমত চাইবো আল্লাহর কাছে? যে দিকে তাকাই দেখি সবই অন্ধকার। কোথাও আলো দেখি না। আল্লাহর কাছে কি চাইবো? ১০ মিনিটের রাস্তা চলতে ১ ঘণ্টা লাগে। ৪ ঘণ্টার রাস্তা চলতে ১২ ঘণ্টার প্রয়োজন হয়। সব ফুটপাত দখল। রাস্তা দখল। পুরো রাজধানী যেন নোংরা নর্দমায় পরিণত হয়েছে। কোথাও স্বস্তি নেই, কোথাও শান্তি নেই। হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, এখন আল্লাহর কাছে একটাই রহমত চাই, হে আল্লাহ, তুমি আমাদের এমন অবস্থা থেকে মুক্তি দাও। আমাদের দেশটাকে সুন্দর কর। আমাদের শাসকদের সুন্দর কাজ করার তৌফিক দান কর। এই ইফতার মাহফিলে বক্তৃতা প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবং সাবেক মন্ত্রী জিয়া উদ্দিন বাবলু এমপি বলেন, দেশ এখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে। দুর্নীতি চরমে উঠেছে। হত্যা, ধর্ষণ বেড়েছে। রাস্তাঘাট উন্নয়নের নামে দুর্নীতি চলছে। আর এজন্য আজ মানুষ বৃষ্টির পানির কারণে ঘর থেকে বের হতে পারছে না। রাস্তাঘাট ধ্বংস হচ্ছে। বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ছেই। কেউ এসব দেখছে না। এরশাদ বা বাবলুর কথা শুনে হাসি ছাড়া আর কি উপায় আছে। ঢাকায় একটি কথা আছে, ‘ঘোড়ায় শুনলেও হাসবে’। এরশাদ এবং বাবলুর কথা ঘোড়া শুনলেও হাসবে। তারাই সরকার, আবার তারাই বিরোধী দল। এটা কি কোন দিন হয়? এরপরেও তার পার্টি থেকে আরো ৩ জন মন্ত্রী নেয়ার জন্য এরশাদ নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তদবির করেছেন। এরশাদ বলেছেন যে- রাস্তাঘাট, ফুটপাত নাকি সব দখল হয়ে গেছে। এগুলো দখলমুক্ত করা কি কোনো কঠিন কাজ? মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নিলে বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী উদ্যোগ নিলে এই দখলদারদের উচ্ছেদ করতে ২৪ ঘণ্টা সময়ও লাগার কথা নয়। তাহলে রাস্তাঘাট এবং ফুটপাত দখল মুক্ত হচ্ছে না কেন? এরশাদ কি জানেন না যে, সরিষায় ভূত রয়েছে? জনগণ কিন্তু সবই বোঝে। কোথা দিয়ে কি ঘটছে, জনগণ সেগুলো ঠিকই বুঝতে পারছে। জনগণকে উল্লুক ভাবলে এরশাদ খুব ভুল করবেন। ভুল তিনি আগেও করেছেন। সেজন্যই তো আজ তার এই পতিত অবস্থা। তিনি তো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। অথচ সেই দুতিয়ালী করা জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত দেড় বছরে এরশাদকে একবারও বিদেশে পাঠাননি। বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ঐ মন্ত্রণালয়ের অফিসারগণ। এরপরেও কি এরশাদ বুঝতে পারেন না যে, তার এবং তার দলের মর্যাদা এই সরকারের কাছে কতটুকু?যানজটের কথা বলেছেন এরশাদ। এটি একটি পুরনো সমস্যা। যতই দিন যাচ্ছে ততই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। কারণ ঢাকা মহানগরীতে লোকসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। নতুন করে জন্ম গ্রহণের ফলে লোকসংখ্যা যত না বাড়ছে তার চেয়ে অনেক গুণে বেশি বাড়ছে মফস্বল শহর এবং গ্রাম-গঞ্জ থেকে মানুষ রাজধানীতে মাইগ্রেশন করার কারণে। বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক (টহরঃধৎু) রাষ্ট্র। ফলে এর একটি মাত্র রাজধানী। যদি এটি একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হত তাহলে একাধিক প্রদেশ থাকত। এবং প্রতিটি প্রদেশের একটি করে রাজধানী থাকত। তাহলে হয়তো বন্যার পানির মতো মানুষ হু হু করে ঢাকায় ছুটে আসত না। কারণ সেই প্রাদেশিক রাজধানীগুলোতে মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিবাকরি ইত্যাদি জুটতো। আগেই বলেছি যে, যানজট ঢাকায় নতুন কোনো সমস্যা নয়। প্রতি বছরেই পবিত্র রমজান মাসে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে। বেশ কয়েক বছর আগে রমজান মাসে যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনা বাহিনীকে রাস্তায় নামানো হতো। অবশ্য কয়েক বছর হলো সেটি বন্ধ রয়েছে। চলতি বছর রমজানে যানজট সমস্যা সকলেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়া সেদিন জামায়াতে ইসলামীর ইফতার মাহফিলে আসেন ইফতার শুরু হওয়ার পর। কারণ, রাস্তায় যানজট। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন তার অফিস থেকে গুলশানে তার বাসভবনে যাওয়ার সময় পথে যানজটে আটকে পড়েন। ফলে পথের মধ্যেই তাকে ইফতার করতে হয়। তারা বড় মানুষ, তাই তাদের কথা বললাম। আমরা যারা ছোট মানুষ তাদের পক্ষে কোনো ইফতার মাহফিলে হাজির হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে ২ দিন মাঝ পথ থেকে ফিরে এসেছি। রমজানের কয়েকদিন আগে এক ভদ্রলোক সপরিবারে সন্ধ্যার পর একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তায় সিএনজির জন্য দাঁড়ান। তিন ঘণ্টা পর্যন্ত তিনি তার স্ত্রী এবং ছোট দুই বাচ্চাকে নিয়ে অপেক্ষা করেন। সিএনজি খালি পাওয়াই দুষ্কর। হঠাৎ করে কোন একটি খালি পাওয়া গেলে ওরা ১৫০ টাকার ভাড়া ৫০০ টাকা হাঁকে। অবশেষে ভদ্রলোক বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে বাসায় ফিরে যান।॥ চার ॥এভাবে আর কতদিন চলবে? ওয়াদার ফুলঝুরি ছড়িয়ে আনিসুল হক এবং সাঈদ খোকন মেয়র বনে গেলেন। নির্বাচনের নামে কি ঘটেছিল, সেটা সকলেই জানেন। যাই হোক, তারা এখন দু’জনেই ঢাকার দুইটি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, এটিই বাস্তব সত্য। মেয়র হওয়ার পর সবে ২ মাস পার হয়েছে। এখন দু’জনেই সুর ঘুরাতে শুরু করেছেন। সাঈদ খোকন বলছেন, যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে সময় লাগবে। কত সময় লাগবে? তার উত্তর, অনেক সময় লাগবে। তাও আবার সেখানে একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। একটি বাংলা দৈনিকে তিনি বলেছেন, যতদিন মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, মৌচাক ফ্লাইওভার শেষ না হবে ততদিন যানজট সমস্যা থাকবেই। তিনি আরও জানান যে, ২০১৯ সালের আগে মেট্রোরেল শুরুই করা যাবে না। এখন প্রিয় পাঠক, বুঝুন ঠেলা! ২০১৯ সালের আগে মেট্রোরেল শুরুই করা যাবে না। তাহলে শেষ হবে কবে? সেটি একমাত্র আল্লাহ্্ই মালুম। কথাটি এই জন্য বলছি যে, আমি কিন্তু মেট্রোরেল, মনোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদির কথা বহু বছর থেকে শুনে আসছি। সেটা তো ২০/২৫ বছর হবেই। ২০/২৫ বছর হয়ে গেল সেগুলো শুরুই হলো না। এর মধ্যে অবশ্য আমার মতো অনেকেই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছেন। বিদেশে যেয়ে ঐসব রেল বা এক্সপ্রেসওয়েতে চড়েছেন। এখন বাংলাদেশে সেগুলি কবে শুরু হবে, আর কবে শেষ হবে, সেটা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ বলতে পারবেন না। তবে ততদিন পর্যন্ত আমরা বেঁচে থাকলে হয়! Email:
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন