|
মোবায়েদুর রহমান
|
|
ক্রসফায়ার ও সিপিবি : হরতালে ট্র্যাফিক জ্যাম কেন?
24 February 2015, Tuesday
পিনাকি ভট্টাচায্যি নামের একটি ছেলে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে। বিষয় বস্তু এবং প্রশ্নগুলো আমার ভালো লেগেছে। আমি তার স্ট্যাটাসটি হুবহু নিচে তুলে দিচ্ছি। তার আগে একটি কথা। পিনাকি ভট্টাচায্যি স্ট্যাটাস ‘দিয়েছে’ বললাম কেন? স্ট্যাটাস ‘দিয়েছেন’ বললাম না কেন? আমি জানি, সে একজন ডাক্তার, একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি (সম্ভবত একটি ওষুধ কোম্পানির মালিক)। পিনাকি আমাকে চেনে না। কিন্তু আমি তাকে চিনি। ওর পিতা শ্যামল রঞ্জন ভট্টাচায্যি আমার ক্লাসমেট। বগুড়া জিলা স্কুলে ক্লাস থ্রি থেকে আইএ পর্যন্ত একসাথেই লেখাপড়া করেছি। অবশ্য আইএ-তে আমার ছিল আর্টস, ওর ছিল সায়েন্স। ওর ডাক নাম কাজল। ইন্টারমিডিয়েটের পর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্সে ভর্তি হই। কাজল বগুড়াতে লেখাপড়া করে। এরপর বগুড়ায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়। পিনাকির চাচারা সবাই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলেন। ওর বড় চাচা চিত্তদা, তারপর সত্যদা, মিনাদি, রবি, বাবলা- এরা সবাই মেধাবী ছিলেন। সবাই ইন্ডিয়ায় সেট্ল্ করেছেন। এসব কারণেই পিনাকিকে আমি পরোক্ষভাবে ‘তুমি’ বলে সম্ভাষণ করেছি।
কাজল, তুই তোর এই ছেলের কথা এতো বলেছিস, কিন্তু সে যে এতো রাজনীতি সচেতন, সেটা তো আমাকে বলিসনি।
যাই হোক, পিনাকির মন্তব্য আমার ভালো লেগেছে এবং সঠিক মনে হয়েছে। তাই ওর স্ট্যাটাসটি নিচে হুবহু তুলে দিলাম।
“সিপিবি ২৭ তারিখে একটা জাতীয় সমাবেশ করবে। সেই সমাবেশের মূল বক্তব্য দিয়ে তারা একটা পোস্টার করেছে। সেখানে চারটা দাবি লেখা আছে। আমার দাবিগুলো দেখে কিছু প্রশ্ন উদয় হয়েছে। প্রশ্নগুলো ব্র্যাকেটে লিখলাম।
১/ পেট্রলবোমায় মানুষ খুন বন্ধ করো।
(ক্রসফায়ারে মানুষ খুন কি চলবে? এটার বিষয়ে কোন মন্তব্য নেই কেন?)
২/ গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কর।
(কার কাছে থেকে রক্ষা করবে? কে গণতান্ত্রিক অধিকার নষ্ট করেছে? বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল কবে? আপনাদের ঘোষিত নীতি তো ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’। যদি কোনদিন ক্ষমতায় যান তবে তো প্রথমেই এটাই কায়েম করবেন। নাকি এখন আর সেটা করবেন না?)
৩/ দেশের সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান চাই।
(কার কাছে চান? সমাধানটা কী? রাজনৈতিক সমাধান বলতে কী বুঝাচ্ছেন? আপনারা কেন বলতে পারছেন না, আপনারাই সমাধান, আপনারা ক্ষমতা চান, বুর্জোয়ারা দেশ চালাতে ব্যর্থ)।
৪/ জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ কর।
(দেশে কিন্তু ধর্মবাদী দল আরো আছে, সেগুলোর রাজনীতি করার ক্ষেত্রে আপনাদের কোন আপত্তি নেই?)”
॥ দুই ॥
রোববার ২২ জানুয়ারি এই কলাম লেখার সময় ডেইলি স্টারে দেখলাম যে, গত ৫ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৪৭ দিনে ‘সুটআউট’ অর্থাৎ পুলিশ-র্যাব প্রভৃতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন ৩৫ জন। এর মধ্যে গত শনিবার বরিশালে বিএনপির দু’জন কর্মীকে বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে একজন ৩০ বছর বয়সী টিপু হাওলাদার। পিতা মতিউর রহমান হাওলাদার। টিপু হাওলাদারের শরীরে ৬টি বুলেটের চিহ্ন রয়েছে। অর্থাৎ তাকে ৬ বার গুলি করা হয়েছে। অপরজন কবির মোল্লা। বয়স ৩২। পিতা হোসেন মোল্লা। তাকে গুলি করা হয়েছে ৩ বার। বরিশালের আগৈলঝরায় তাদেরকে গুলি করা হয়। ডেইলি স্টারের মতে, ওপরের দুই ব্যক্তিসহ ৬ জানুয়ারি বেগম জিয়ার অবরোধ এবং হরতালে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলেন ৩৫ জন। সোমবার এই লেখা সংশোধনীর সময় পত্রিকায় দেখা গেল যে আরও ৪ হতভাগ্য গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। এই নিয়ে ক্রসফায়ারে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৯। একই দিন দৈনিক ‘প্রথম আলোর’ প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে, এ পর্যন্ত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ৩০ জন। এবার একটি অদ্ভুত কিন্তু ঘৃণিত ব্যাপার দেখা যাচ্ছে। সেটি হলো, মানুষ মরছে অসংখ্য, কিন্তু সব মৃত্যুতে একশ্রেণীর মিডিয়া আহাজারি করছে না। শুধুমাত্র পেট্রলবোমা নিয়েই তারা আকাশ-বাতাস কাঁপাচ্ছে। এতে কোনো অন্যায় নেই। অথচ শুধু কি তারাই মানুষ? যারা পুলিশি সুটআউটে মারা যাচ্ছে তাদের জন্য নীরবে হলেও ওরা একফোঁটাও অশ্রু বিসর্জন করছে না। অথচ সবাই মানুষ। সবাই বাঙালি।
॥ তিন ॥
এখনকার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, যারা ক্রসফায়ারে মারা গেল তারা যেন মনুষ্য প্রজাতির অংশ নয়। তারা যেন অন্য কোন জগৎ থেকে এসেছে। যারা শুধুমাত্র পেট্রলবোমা হামলায় মারা যাচ্ছে একমাত্র তারাই মনুষ্য প্রজাতির অংশ। এত দিন সরকার এ কাজটি করেছে। ধরলাম, পুলিশ বা র্যাব নিজেদের হাতে গুলি করে মানুষ মেরেছে, তাই তারা সেই মৃত্যু স্বীকার করতে বিব্রত বোধ করে। কিন্তু কম্যুনিস্টরা ক্রসফায়ারে নিহতদের কথা লিখতে শরম পাচ্ছে কেন? আসল কারণ হলো, এরা ওপরে ওপরে কম্যুনিস্ট বিপ্লবী সাজলেও ভেতরে ভেতরে তারা আওয়ামী লীগের বি টিম।
আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি সিপিবি রাজনীতি কণ্ঠলগ্ন সহচর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এরা একটি ঐক্যজোট করেন এবং নাম দেন জাতীয় ঐক্যজোট। কিন্তু জনগণ তাদের এই ধোঁকাবাজি ঠিকই ধরে ফেলেছিল। সারা জীবন অন্যের পদাঙ্ক অনুসরণের রাজনীতি করেছে বলে বিগত ৪০ বছরে তাদের কোন বৃদ্ধি নেই, বিকাশ নেই। তারা যেখানে ছিল সেখানেই আছে।
॥ চার ॥
অবরোধ এবং হরতালের ৪৮ দিন অতিক্রান্ত হলো। এটিকে একটি আন্দোলন বলা যাবে কিনা, জানি না। আমি গত রোববার বনানী থেকে ধানম-ি আসছিলাম। রাস্তায় অসহনীয় ট্রাফিক জ্যাম দেখলাম। এই জ্যাম স্বাভাবিক দিনের জ্যামের সমতুল্য। বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, সিএনজি এবং রিক্সা সবই আছে। হরতালে এমন ট্রাফিক জ্যাম? এ যেন কাঁঠালের আমসত্ত্ব। মফস্বলেও এখন হরতাল আগের মতো কঠোর নয়। এখন অনেক মফস্বল জেলায়ও হরতাল ঢিলেঢালা হয়ে গেছে।
জামায়াতে ইসলামীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এমন এক ব্যক্তির সাথে কথা হলো। জানতে চাইলাম, আপনাদের সংগঠনের সেই তেজ কোথায় গেল? তিনি সরাসরি স্বীকার করলেন, কিছু দিন আগেও আমাদের যে শক্তি ছিল আজ আর তা নেই। আমাদের হাজার হাজার কর্মী কারাগারে। শত শত কর্মী নির্যাতিত ও আহত হয়ে বসে আছেন। প্রায় প্রতিটি কর্মীর মাথায় হুলিয়া। আসলে আমাদের শক্তি কমে গেছে। তাই ইচ্ছা থাকলেও সে শক্তি আর দেখাতে পারি না।
তবে বিএনপির বিষয়টি বোধগম্য নয়। দেশের জেলায় জেলায়, উপজেলায়, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও তাদের শাখা রয়েছে। সারাদেশে তাদের রয়েছে লক্ষ লক্ষ কর্মী। রয়েছে কোটি কোটি সমর্থক। তারপরেও তারা মাঠে নেই, রাস্তাঘাটে নেই। তাদেরও একই জবাব, রাস্তায় নামলেই গুলি করে। না হয় ধরে নিয়ে যায় রিমান্ডে এবং সেখানে দারুণ টরচার করে। তাদেরও ১৮ হাজার কর্মী জেলে আছে। তাদেরও ১৮ জন কর্মী ক্রসফায়ারে মারা গেছে। তাদের ক্ষেত্রেও রাস্তায় দেখামাত্র পায়ে গুলি এবং ধরে নিয়ে নির্র্যাতন। কিভাবে তারা রাস্তায় নামবে?
এসব বক্তব্য এবং যুক্তি নিরেট সত্য। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। ক্ষমতায় চিরস্থায়ীভাবে থাকার জন্য সরকারের হাতে যতগুলো অস্ত্র আছে তার সবই তারা প্রয়োগ করবে এবং করছে। তাই বলে কি আন্দোলন থেমে থাকবে? সরকারি নির্যাতনের ভয়ে তারা যদি রাজপথ ছেড়ে দেয় তাহলে সারা জিন্দেগীতেও তাদের আন্দোলন সফল হবে না। কারণ আওয়ামী লীগ তো ক্ষমতা থেকে নামতে চাইবে না। আর নামতে চাইবে না বলে তারা বল প্রয়োগ করবে।
কারণ গত আন্দোলনে অর্র্থাৎ ২০১৩ সালে তারা বল প্রয়োগ করে ফল পেয়েছে। বিরোধী দল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঠেকাতে চেয়েছে। আর আওয়ামী সরকার চেয়েছে বল প্রয়োগ করে ইলেকশন করতে। ৫ জানুয়ারি সরকার বল প্রয়োগ করে ইলেকশন করেছে। বিরোধী দল সেই ইলেকশন ঠেকাতে পারেনি। ইলেকশনের আগে ২০১৩ সালে সরকার পতন আন্দোলন হয়েছে। দুই শতাধিক লোক সেই আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন।
আগে যেখানে পুলিশের গুলিতে ২-৪ জন লোক মারা গেলে দেশ কেঁপে উঠত সেখানে এখন শত মানুষ মারা গেলেও মানুষের কোন বিকার দেখা যায় না। মনে হচ্ছে সমগ্র জাতির মন-মানসিকতায় একটি বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। ৪৮ দিনের অবরোধ ও হরতালকে যদি কোন আন্দোলন বলা যায় তাহলে বলব যে, চলমান আন্দোলনে বেগম জিয়া সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কোন শীর্ষ নেতা স্বাধীনতার পর এত বড় স্যাকরিফাইস করেছেন বলে আর দেখা যায় না। বেগম জিয়া যদি ১০০ হাত এগিয়ে গেছেন তাহলে তার তৃণমূল কর্মীরাও ততখানি এগিয়ে গেছেন। কিন্তু তার নেতারা ৫০ হাতও এগোয়নি। আর জনগণ? এটি একটি বিভ্রান্তির ব্যাপার। এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, দেশের মানুষের ৮৫ শতাংশই এন্টি-গভর্নমেন্ট। অথচ তারা রাস্তায় নামছেন না। ঘরে, দোকানপাটে বা অফিসে আসর জমলে মানুষ আওয়ামী সরকারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছে। তারা চলমান আন্দোলনকে সমর্থনও করছে। তারপরও তারা রাজপথে নেমে আসছে না। আর অন্যেরা সরকারবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও এবং নীতিগতভাবে আন্দোলনের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও রাস্তায় গাড়ি বের করছেন এবং হরতালের মধ্যেও বাস, ট্রেন এবং লঞ্চে চলাচল করছেন। ফলে হরতাল বা অবরোধ অকার্যকর হতে চলেছে।
এই পটভূমিতে বিএনপি-জামায়াত এবং ২০ দলকে নতুন করে ভাবতে হবে। কেন জনগণ রাস্তায় নামছে না? কেমন করে তাদেরকে রাস্তায় নামানো যায়?
উৎসঃ ইনকিলাব
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন