|
পীর হাবিবুর রহমান
|
|
বীর তোমাকে অভিবাদন
14 December 2017, Thursday
আমরা আবেগ-অনুভূতিতে এক কথায় দিন দিন বোধহীন হয়ে যাচ্ছি। চিরসত্যকে মাথার মুকুট করে রাখব কোথায় উল্টো সেই সত্যকে নির্বাসনে পাঠাচ্ছি। আমরা সুমহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গৌরব করি, চেতনার কথা বলতে বলতে জান কোরবান করে দিই। কিন্তু যার নেতৃত্ব ও ডাকে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধ এসেছিল আমাদের জীবনে জাতির সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অন্ধ বিবেকহীনের মতো বিতর্ক করি। ইতিহাসের মীমাংসিত সত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলতে বলতে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রচনা ও চর্চার তাগিদ দেয়। বীর যোদ্ধদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলি কিন্তু আমরা আমাদের আত্মার সঙ্গে নিয়ত প্রতারণা করি। জাতীয় বীরদের যাদের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে প্রভাব-ভাবমূর্তি রয়েছে তাদেরই অসম্মান, অনাদর, অবহেলা করতে কার্পণ্য করি না। আর যে সাধারণ মানুষ সেদিন জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল তাদের অনাদর, অসম্মান করতে তো বুক কাঁপেই না।
এত কথা বলার কারণ একটাইÑ সেটি হচ্ছে টাঙ্গাইলে ১১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছে, বিজয় দিবসের উৎসব আনন্দ ও গৌরবের কিন্তু সেই উৎসবে যদি বিজয়ের নায়ককে মধ্যমণি করা না হয় গোঁটা আয়োজন মহিমা অর্জন দূরে থাক, ছন্দপতনই ঘটে না, অন্তঃসার শূন্য হয়ে যায়। ’৯০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই উৎসব কাদেরিয়া বাহিনী করে আসছিল। পরে পৌরসভা এই আয়োজনের উদ্যোক্তা হয়ে যায়। আমাদের নিউজ পোর্টালের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি তপু আহম্মেদ যখন সংবাদ পাঠাল সেটি পড়তে পড়তে আমার বুক কেঁপে উঠেছে। বিস্মিত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘এবারও ব্যাপক ঘটা করে এ অনুষ্ঠান পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমন্ত্রণ কার্ডও ছাপানো হয়েছে, তবে গত বছরের মতো এবারও সেই আমন্ত্রণ কার্ডে নাম নেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী জননেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের।
১৯৯০ সালে টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত দিবস প্রথম পালন করে সপ্তসুর সাংস্কৃতিক সংস্থা। পরে কাদেরিয়া বাহিনীর উদ্যোগে দিবসটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপিত হতে থাকে।
১১ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পর্যন্ত ৬ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান করে তারা। এর পর পৌরসভার সাবেক মেয়র শহিদুর রহমান খান মুক্তি পৌরসভার উদ্যোগে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেন। সেই দিবসে বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীসহ আরও অনেককেই নিমন্ত্রণ না করায় ২০১২ সালে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকী ঘোষণা দেন, কাদেরিয়া বাহিনীর উদ্যোগে টাঙ্গাইলে আর হানাদারমুক্ত দিবস পালন করা হবে না।’
টাঙ্গাইলে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উৎসব হবে আর সেই মঞ্চে সেখানকার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে অতিথি করা হয় না এ কেমন বিজয় উৎসব?
টাঙ্গাইলে বিজয় উৎসবের জাঁকজমক অনুষ্ঠান হবে আর সেখানে গোটা টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান বা কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার কাদের সিদ্দিকীকে দাওয়াত করা হবে না সেটি বিজয় দিবসের উৎসবের নামে নিদারুণ প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। টাঙ্গাইলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুল মান্নান, শামসুর রহমান খান শাজাহান, আবদুর রাজ্জাক ভোলাসহ অনেকেই ইন্তেকাল করেছেন। জীবিতদের মধ্যে এই দুই বীর সহোদর রয়েছেন, তাদের আমন্ত্রণ জানালে তাদের ভাগ্যে কিছু প্রাপ্তি যোগ হতো না, কিন্তু বিজয় দিবসের আয়োজকদের মানমর্যাদা যেমন বাড়ত, মুখ যেমন উজ্জ্বল হতো তেমনি অনুষ্ঠানের জৌলুস, আবেগ-উচ্ছ্বাস অন্য মাত্রা লাভ করত।
কবি হাসান হাফিজুর রহমান বলেছিলেন, ‘এ দেশে বীর নেই, শহীদ আছে।’ অর্থাৎ বীরদের জীবিতকালে সম্মান করতে আমরা পারি না, মারা গেলে গুণকীর্তন করি, অশ্রুজলে বুক ভাসাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার অনুজপ্রতিম স্নেহভাজন ছিলেন এনামুল হাবিব। বর্তমানে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রতাপশালী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। মাঝখানে নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী একাধিক মামলায় দীর্ঘ কারাবাস ভোগ করলে তিনিই ছিলেন একচ্ছত্র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এনামুল হাবিব যখন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম তখন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে গিয়ে ভারতে নির্বাসিত জীবন ভোগ করছেন। এনামুল হাবিব যখন সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাদের সিদ্দিকী তখন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি। সিলেট গিয়েছিলেন সাংগঠনিক সফরে, উঠেছিলেন সার্কিট হাউসে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন এই অজুহাতে সূর্যের চেয়ে বালির তাপ বেশি দেখিয়েছিলেন এনামুল হাবিব। তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল সে আলাপে উপলব্ধি করেছি এনামুল কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে কোনো পাঠ নেননি ।
সেই ঘটনার প্রতিবাদ করে কলাম লিখেছিলাম। এনাম সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এ নিয়ে আমি ব্যথিত নই। গৌরব আছে জাতির বীরত্বের মুকুট পরা একজন বাঘা সিদ্দিকীর জন্য শত শত এনামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলে কিছু যায় আসে না। একাত্তর সালে দেশের অভ্যন্তরে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে সংগঠিত করে ভারতের সাহায্য ছাড়া কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, আহত হয়েছেন তবু মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত করার যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে যাননি। এগিয়ে গেছেন, দুনিয়া তাকে সেদিন বাঘা সিদ্দিকী বলে যেমন চিনেছে, তেমনি সম্মান করেছে।
বঙ্গবন্ধু একমাত্র বেসামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তাকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করেছেন। অগাধ পুত্রস্নেহ দিয়েছেন। জাতির জনকের কাছেই সামরিক কায়দায় তিনি ও তার বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছে। বঙ্গবন্ধু তাকে সংসদ সদস্যই নির্বাচিত করেননি, টাঙ্গাইলের গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। আজকে অনেক সমাজপতি, অনেক সুবিধাভোগী রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ে যে মতা ভোগ করছেন, বিভিন্ন পেশায় দাপট দেখাচ্ছন এই কাদের সিদ্দিকীও কাদেরিয়া বাহিনীর বীর যোদ্ধারা জীবন বাজি রেখেছিলেন বলেই তা করতে পারছেন। স্বাধীন দেশে বুকভরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছেন। এই জাতির জীবনে অনেক প্রতিভাবান সন্তান জগৎ-সংসার আলোকিত করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী থেকে অনেক কিছু হতে পারবেন, কেউ যেমন একজন বঙ্গবন্ধু হয়ে পৃথিবীতে আসতে পারবেন না, তেমনি একজন কাদের সিদ্দিকী হয়েও জন্ম নেবেন না।
আমরা অনেকেই জীবনে একবার দেশ ও মানুষের কল্যাণে কঠিন পরিস্থিতির মুখে অগ্নিপরীায় উত্তীর্ণ হতে পারি না। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম একবার নয়, দু-দুবার জাতির জীবনে অগ্নিপরীায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তার সব ভুল-ত্রুটি এই বীরত্বের কাছে ধুয়েমুছে যায়। তার পরও মানুষের স্বাধীনতা আছে তাকে পছন্দ-অপছন্দ করার। কিন্তু টাঙ্গাইলে হানাদারমুক্ত দিবসে বিজয় দিবসের উৎসব সূচনা হবে আর সেই হানাদারমুক্ত করার অসিম সাহসী নায়ককে দাওয়াত করা হবে না, সম্মানের সঙ্গে মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হবে না সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটি তার প্রতি অসম্মান নয়, নিজের সঙ্গে আত্মপ্রতারণা। ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
’৭১-এর বীরত্বের কাদের সিদ্দিকী আরেক দফা বীরত্ব দেখিয়েছেন, সেই বীরত্ব ছিল অন্তহীন বেদনা ও ১৫ বছরের নির্বাসিত জীবনের। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রোপটে এ দেশের সশস্ত্র বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য যখন গভীর রাতে হামলা চালিয়ে পরিবার-পরিজনসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সশস্ত্র উল্লাস করেছে তখন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রধানরা প্রতিরোধেই ব্যর্থ হননি, প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। খুনি চক্রকে সমর্থন দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আপনজনরা খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতি থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত লাশ তখনো ধানম-ির বাসভবনে খুনিদের প্রহরায় অনাদরে পড়ে আছে। অস্ত্রের মুখে তাদের জানাজা পড়তে দেওয়া হয়নি। বনানীতে পরিবারের সদস্যদের লাশ দাফন হয়েছে। টুঙ্গিপাড়ায় সশস্ত্র প্রহরায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইমামের আপত্তির মুখে দ্রুত কয়েকজনকে জানাজা পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। খুনিদের বর্বরতা মৃত মুজিবের সঙ্গে ও কত নৃশংস ছিল, স্তম্ভিত দেশ ও বিশ্ব দেখেছে।
সেদিন গোটা দেশের মানুষ বিমর্ষ নির্বাক। বিশাল দল আওয়ামী লীগ কর্মীরা পথহারা দলের জীবিত নেতারাও প্রতিরোধের ডাক দিতে ব্যর্থ সেই দুঃসময়ে দলের কোনো দায়িত্বে না থাকলেও যার অন্তর আত্মা কেঁদে উঠেছিল পিতৃহত্যার প্রতিবাদে তিনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। বঙ্গবন্ধুর আরেক সন্তান জীবিত এই কথা বলে অস্ত্রহাতে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে ১৭ হাজার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সন্তানরা সেই যুদ্ধে যুক্ত হয়েছিল। সেদিন খুনি মোশতাক ও সামরিক শাসকদের হাতে নির্যাতিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রাজনীতির ময়দানে এতিম অসহায়ের মতো ছিলেন। বাঘা সিদ্দিকীর প্রতিরোধ যুদ্ধ তাদের প্রাণশক্তি জুগিয়েছিল। আজ যারা বঙ্গবন্ধুর কন্যার সুবাদে মতার অংশীদার বা আশ্রিত তারা কেউ কেউ সেনাশাসক জিয়ার খাল কাটা শ্রমিক হয়েছিলেন, বাকিরা নানা অপপ্রচারে আওয়ামী লীগ রাজনীতির পথের বাধা হয়েছিলেন। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয়তা বা লাভ-লোকসানের সম্পর্ক নেই, একজন বীরের প্রতি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীনচেতা মানুষ যে ভালোবাসা ও সম্মান থাকার কথা সেটিই আছে। যতদিন বেঁচে আছি এই জাতির বীরদের প্রতি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সেই সম্মান ও নিখাদ ভালোবাসা থাকবে।
য় পীর হাবিবুর রহমান : সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিম বিডি নিউজ
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন