এক বিষাদ কাব্যের ভেতর দিয়ে সময় অতিক্রম করছি আমরা। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়কে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষিণ এশিয়ায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে প্রিয় স্বদেশ। পশ্চিমাসহ গণতান্ত্রিক দুনিয়া এ অগ্রগতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ সংগ্রামের পথ হেঁটে এ জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির লক্ষ্যে, স্বাধিকার-স্বাধীনতার পথে এক মোহনায় মিলিত করেছিলেন। গোটা জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত হয়ে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের যে ডাক দিয়েছিলেন, সেখানে বীরত্বের গৌরবগাথা বাঙালি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধেই ঝাঁপিয়ে পড়েনি, আত্মাহুতিও দিয়েছে গভীর দেশপ্রেমে। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তান ও তার সমর্থক বিশ্ব মোড়লরা পরাজয়ের গ্লানিতে দগ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে এক অশান্ত অস্থির সময় আবির্ভূত হয়নি সংঘবদ্ধ ঘাতক চক্রের আক্রমণে ভোরের আলো ফোটার আগেই পরিবার-পরিজনসহ জীবন দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ দেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে দেশপ্রেমিক, সৎ, নির্লোভ রাজনৈতিক নেতৃত্বের আগমন ঘটেনি।
বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে না পারলেও তার যোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের সেই মহাসড়কে টেনে উঠিয়েছেন। মানুষের জীবনযাত্রার আয় ও ব্যয় বেড়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো উন্নয়ন প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ হাসতে হাসতে নিয়েছেন। বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কদের পাশে প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের মহিমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এক সময় গার্মেন্টস খাত বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের পরিচয় নতুনভাবে তুলে ধরেছিল। বিশ্ব ক্রিকেটে আজকের বাংলাদেশ বিস্ময়কর উত্থানই ঘটায়নি, দাপটের সঙ্গে খেলতে খেলতে দেশের সুনাম ছড়িয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিবাহিনীতে যুদ্ধবিধ্বস্ত অশান্ত মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পতিত দেশগুলোয় মানবতার প্রতীক হয়ে আমাদের সেনাবাহিনী অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখছে। যুগের পর যুগ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সুনাম বেড়েই চলেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও গবেষণায় আমাদের দেশের সন্তানরা মেধার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। এমনকি বিশ্ব বিখ্যাত পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আমাদের ছেলেমেয়েরা হামেশাই উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য যাচ্ছে। দেশের তৃণমূল পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব ঘটে গেছে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের হাত ধরে।
আমাদের অর্জন অনেক। যারা একদিন তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন, তারা এখন চোখ নামিয়েই কথা বলছেন না; আমাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করছেন। যারা একদিন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত দেশ হিসেবে আমাদের চিনতেন তারা এখন বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান বাঘ হয়ে দাঁড়িয়েছি আমরা। আমাদের মানবসম্পদ ও দেশপ্রেমিক জনগণ অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ বড় শক্তি। কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এই নীতিতে কূটনীতির গতিপথ হয়েছে প্রশস্ত। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর গণহত্যার মুখে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে আসা ৮ লাখ শরণার্থীকে আমরা আশ্রয় দিয়েছি মানবিক হৃদয় নিয়ে। বিশ্ব মোড়লরা এ গণহত্যার বিরুদ্ধে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে এখনো মিয়ানমার শাসকদের ওপর কঠিন চাপ প্রয়োগ করতে পারেননি। কিন্তু আমাদের জন্য বোঝা হলেও আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি, খাবার দিচ্ছি, চিকিৎসা দিচ্ছি। এ মানবিক ইস্যুতে গোটা দেশ এখন অভিন্ন জায়গায়, জাতীয় ঐক্যের মোহনায় যার যার অবস্থান থেকে মিলিত হয়ে তাদের জন্য সহানুভূতির হাত বাড়িয়েছেন।
ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- বইছে বাংলাদেশজুড়ে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যতটা অর্জন হয়েছে, তেমনি আমরা পিছিয়েছি আমাদের আদর্শিক রাজনীতির ঐতিহ্যের ধারা থেকে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর আজকের বাংলাদেশে গণমাধ্যমও তার দিগন্ত প্রসারিত করেছে। কিন্তু গোটা সমাজকে খাবলে খাচ্ছে মূল্যবোধহীন সর্বগ্রাসী শক্তি। আমাদের রাজনীতির ইতিহাস গৌরব ও ঐতিহ্যের, আদর্শ ও সততার, গণমুখী ও মানবকল্যাণের, শান্তি ও সামাজিক সৌজন্যতার হৃদ্যতায় ভরপুর। গণমুখী ও মানবকল্যাণের সেই রাজনীতির ধারা থেকে আমরা ছিটকে পড়েছি। দিনে দিনে দেনার মতো দায় বেড়ে গেছে অনেক। আস্থা, বিশ্বাস, আদর্শিক জায়গা থেকে ভঙ্গুর হয়েছে রাজনীতি থেকে সব প্রতিষ্ঠান।
আমাদের রাজনীতির অতীত সাদাকালো যুগের দিকে তাকালে মহাকাব্যের নায়কদের চেহারা উদ্ভাসিত হয়। মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য জীবন-যৌবন উৎসর্গ করা দেশপ্রেমিক, সৎ, হৃদয়বান রাজনীতির এক মহানায়কের ছবি ও আদর্শ সবার ওপরে উজ্জ্বলতর জায়গা নিয়ে আছে। তিনি আর কেউ নন, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিরাভরণ, সাদামাঠা জীবনে অমিত সাহস, তেজ, দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা আর ছিল দেশ ও মানুকে বুক দিয়ে ভালোবাসার প্রখর শক্তি। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে তার পরিবার-পরিজনসহ বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে ঘাতকের বুলেটে। রক্তে ভেসে গেছে স্বাধীন স্বদেশ তবু তিনি আমাদের ইতিহাসের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়েছিলেন। তাকে বাদ দিয়ে এ দেশ, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও দীর্ঘ সংগ্রামের কাব্য রচনার কোনো সুযোগ নেই।
কৃষকের বন্ধু শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের রাজনৈতিক দল ও অগণিত কর্মীর অস্তিত্ব নাই থাকুক, ইতিহাস তাকে অমরত্ব দিয়েছে। অমরত্ব দিয়েছে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। মোটা ভাত-কাপড়ের লড়াইয়ে ক্ষমতা নয়, মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আমাদের ইতিহাসের অলঙ্কার। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা কুঁড়েঘরখ্যাত ন্যাপ মোজাফফর প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ শত বছরের কাছে এসে এখন রোগশয্যায় মেয়ের বাড়িতে। তার সব ইন্দ্রিয় এখনো সচল। দীর্ঘপথ হেঁটেছেন একটি বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে, মানবিক রাজনীতির সংগ্রামে আদর্শিক রাজনীতির পথিকৃৎ তিনি। প্রয়াত আরেক উপদেষ্টা কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মণি সিংহ ইতিহাসে এখনো চিরভাস্বর। সুদর্শন বাম রাজনীতিবিদ পীর হবিবুর রহমান আজীবন লুঙ্গি পরে সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করে গেছেন। এক ছটাক জায়গা ছিল না ঢাকায় বা সিলেটে, এটাকেই বলে আত্মত্যাগের রাজনীতি। সামন্ত পরিবার থেকে আসা কমরেড অমল সেনরাও যে রাজনীতিই করুকÑ মানুষের মুক্তির কথাই বলে গেছেন। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান আদর্শের প্রশ্নে, নেতৃত্বের প্রশ্নে খুনিচক্রের সঙ্গে আপস করেননি, মাথা নত করতে শেখেননি। ভোগবিলাস, বিত্তবৈভবের রাজনীতিরও মন্ত্র শোনেননি, দেশ-মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে রাতের অন্ধকারে কারাফটকের ভেতরে বর্বর ঘাতকদের বুলেটে জীবনদান করে গেছেন। এসব মহান রাজনীতিবিদের সহচর ও অনুসারীরা সাদাকালো যুগের রাজনীতিকে গৌরবের উচ্চতায় তোলেননি, গণমানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার গভীর বন্ধনে রাজনীতিকে মানবকল্যাণের ইবাদতের জায়গায় নিয়েছিলেন। সেই সময়ে কী রাজনীতি, কী প্রশাসন, কী ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাব্যবস্থা, রাষ্ট্রের সব স্তরে দায়িত্ব পালনরত সব পেশার মানুষই একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব নিয়ে নির্লোভ, নিরাভরণ জীবনের পথ ধরে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সামরিক শাসনকবলিত গণতন্ত্রের সংগ্রামমুখর কঠিন দুঃসময়েও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হারাননি। গণমানুষের ভালোবাসা, অগাধ শ্রদ্ধা ও সমর্থন নিয়ে রাজনীতির দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন। আদর্শের রাজনীতির আত্মত্যাগের পথপরিক্রমায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে খেয়ে না খেয়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় নেতাকর্মীরা গণআন্দোলনকে উত্তাল রূপই দেয়নি; সব বাধা-বিপত্তি বুক চিতিয়ে প্রতিরোধই করেনি, বুকের রক্ত ঢেলে দিতে কার্পণ্য করেনি। মানুষ ও তারুণ্যের ঢেলে দেওয়া বুকের রক্তের পিচ্ছিল পথে পতন ঘটেছে স্বৈরশাসকদের। দীপালি সাহা, জয়নাল জাফর, সেলিম দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়া, শাজাহান সিরাজ, কমরেড তাজুল, নুর হোসেন থেকে ডা. মিলনÑ সেসব শহীদের রক্তও বৃথা যায়নি। যে সংগ্রাম আদর্শের সেই সংগ্রামের নেতা ও কর্মীরা মানুষের ভালোবাসার হৃদয়ে যেমন ঠাঁই নেন, তেমনি শহীদরা ইতিহাসে অমরত্বই পান না, মানুষের ভালোবাসার শ্রদ্ধার অর্ঘ্য অর্জন করেন।
নব্বই-উত্তর গণতন্ত্রের নবযাত্রায় গোটা দেশ যে স্বপ্ন দেখেছিল, রাজনৈতিক কর্মীরা যে আশা দেখেছিলেন তা ধূসর হয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি। পঞ্চম ও সপ্তম সংসদ ছাড়া (বিরোধী দলের বর্জনের মুখে পড়লেও) তার পর আর কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার চিত্র খুঁজে পায়নি মানুষ। রাজনীতিতে গণতন্ত্রের পথে ক্ষমতার পালাবদল একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মীমাংসিত হওয়ার পথটিও যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে। হতাশা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয়, আতঙ্ক দিনে দিনে বেড়েছে। গণতন্ত্রের ট্রেন ওয়ান-ইলেভেনে লাইনচ্যুত হয়েছে। একুশের গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার প্রতি রাজনৈতিক শক্তির আস্থা ও পারস্পরিক সমঝোতার শেষ কফিনে পেরেক ঠুকে দিয়েছে। স্বাভাবিক গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা সেই যে আক্রান্ত হয়েছিল তার পর আমরা কতটা মেরামত করেছি বা পুুনরুদ্ধার করেছি সেই প্রশ্ন দিন দিন বড় হয়েছে।
আমাদের গৌরবের অস্তিত্বের জায়গা সুমহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার জায়গা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। সেখানে রাজনৈতিক শক্তি কতটা অনুগত, কতটা তারা পারস্পরিক সমঝোতায় শ্রদ্ধাশীল সেটি নিয়েও মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন এখনো বহাল। আমরা পাকিস্তানি সামরিক শাসনের জমানায়ও ডাকসুসহ সব ছাত্র সংসদ নির্বাচন পেয়েছি। আমাদের সেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঊনসত্তরের তোফায়েলরাই জন্ম দেয়নি, জন্ম দিয়েছে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা আ স ম আবদুর রব ও মরহুম আবদুল কুদ্দুস মাখনরা। সেসব নির্বাচন আমাদের স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে সুসংহত ও শক্তিশালী গতিময়ই করেনি, জাতীয় রাজনীতিকে মেধাবী নেতৃত্বনির্ভর করেছিল আর ছাত্র রাজনীতিকে ইতিহাস উজ্জ্বল বর্ণময় করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনকবলিত বাংলাদেশেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হয়েছে। এতে ছাত্র রাজনীতি উর্বর হয়নি, গণতান্ত্রিক শক্তিও সুসংহত শক্তিশালী হয়েছে। রাজনীতিতে ঘটেছে মেধাবী তারুণ্যের প্রবেশ। ২৬ বছর ধরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এতে করে আমাদের গৌরবময় ছাত্র রাজনীতির উত্তরাধিকারিত্ব হোঁচট খেয়েছে। ছাত্র রাজনীতি ইতিহাসের গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার নজিরবিহীন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গণরাজনীতিতে বন্ধ্যত্ব এনেছে। ছাত্র রাজনীতির আলোর পথে ছাত্র সমাজের ম্যান্ডেট নিয়ে আসা রাজনৈতিক কর্মীর আবির্ভাব জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে ঘটছে না। এতে করে রাজনৈতিক শক্তি যে পথে হাঁটছে, ভোগবিলাসে মত্ত মূল্যবোধহীন যে শক্তির উত্থান দলে দলে ঘটতে দিয়েছে, তাতে গোটা রাজনীতির প্রতি মানুষের অনীহা ও অশ্রদ্ধা জন্ম নিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতামূলক পথ হাঁটা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার এই দায় যেমন এড়াতে পারে না, তেমনি এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ না করার দায়ও এড়াতে পারে না। রাজনীতিতে দেশজুড়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেতা লুটেরা সিন্ডিকেট রাজনীতিকে ব্যবহার করে যেভাবে বিত্তবৈভব, ভোগবিলাসের পথকে প্রশস্ত করছে, রাজনীতিকে আদর্শিক গণমুখী চরিত্র থেকে সরিয়ে পেশি ও অর্থশক্তির ওপর দাঁড় করানো হয়েছে, আদর্শিক, সৎ নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে তার দায়ও এড়াতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সিনেট নির্বাচন হয়, শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয়, কর্মচারীদের নির্বাচন হয়, নির্বাচন কেবল হয় না ছাত্র সমাজের। দেশের ছাত্র সমাজ ভবিষ্যৎ নেতৃত্বই নয়, দেশের সবচেয়ে প্রাণবন্ত শক্তি, তাদের প্রতিনিধি সিনেটে থাকেন না। একেকজন উপাচার্য দলীয় আনুগত্যের ওপর আত্মমর্যাদাবোধের পথ হারিয়ে উপাচার্য নিযুক্ত হন। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক মেধা ও মননশীলতার ওপর গড়ে তোলা দূরে থাক, রাজনৈতিক দলাদলি, মারামারি, কাড়াকাড়ি থেকে শিক্ষকদেরই নিভৃত করতে পারে না। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেফিনযুগে একদল দাপট দেখায়। তাদের অবসানে আখতারুজ্জামান গ্রুপ রুদ্রমূর্তি নিয়ে ক্ষমতার দম্ভে আবির্ভূত হয়। প্রশাসন বহু আগেই দলীয়করণের শিকার, বিচার বিভাগ নিয়ে বিতর্কের যে ঝড় কোথায় গিয়ে শেষ হয় জানি না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ কোন দিকে উপলব্ধি করতে পারি না।
মুক্তিযুদ্ধের জায়গা থেকে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে দীর্ঘ পেশাদারিত্বের অভিজ্ঞতায় নিজের মতো বেঁচে থাকার জন্য নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিম বিডি ডট নিউজ নিয়ে পথ হাঁটছি। সেই প্রতিষ্ঠানের খেয়ালি ভাবুক টাইপের সংবাদকর্মী উৎপল দাস ২৫ দিন ধরে নিখোঁজ। সংবাদকর্মীরা রাজপথের আন্দোলনে কিন্তু রাষ্ট্র তাকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। অসহায় পিতা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক চিত্তরঞ্জন দাস যখন উৎপলের বোনদের নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আমি তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে করি। রোজ ঘুম থেকে উঠি উৎপল ফিরে আসবে এই আশায়। কখনো বা সারারাত নিদ্রাহীন থাকি। উৎপল ফিরে আসে না। একি মানসিক যন্ত্রণা ও দহন বোঝাতে পারব না। এর মধ্যেই রবিবার আমাদের নিউজ পোর্টালের সাইট বিটিআরসি ব্লক করে দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা বিটিআরসি করলেও তথ্য মন্ত্রণালয়কে জানাতে হয়। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু যখন বলেন, তিনি নিজেই জানেন না। আরও অসহায় হই। যাহোক উৎপল ফিরে আসুক। রাষ্ট্রবিরোধী, সরকারবিরোধী কোনো অসত্য খবর প্রচার না করার পরও নিউজ পোর্টাল কেন ব্লক করা হলো তার জবাব কে দেবেন আজ? কার কাছে কৈফিয়ত চাইব আমরা মানুষ।
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গণতন্ত্রের সেই দরজা খুলুক যে গণতন্ত্র আমরা স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে চেয়েছিলাম। আমরা চাই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, কার্যকর সংসদ, আদর্শিক সৎ, গণমুখী জনপ্রতিনিধি, শক্তিশালী সরকার ও বিরোধী দল, জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা, মানুষের ন্যায়বিচার লাভ ও সুশাসন। রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে অনুগত থেকে স্বাধীন শক্তিশালী রূপ নিক। না হয় বিষাদ কাব্যগাথা সময় থেকে আমাদের কারো মুক্তি আসবে না। আমরা বিষাদ কাব্যগাথা অস্থির অশান্ত সময় থেকে মুক্তি চাই।
পীর হাবিবুর রহমান : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন