সরকার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে বিচার বিভাগের কাছে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনই নয়, সবার দৃষ্টি ছিল সুপ্রিমকোর্টের দিকে। এই সংশোধনী নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় কী আসে, তা দেখার জন্য। সরকার চেয়েছিল ’৭২-র সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতিদের অপসারণের মতা সংসদের হাতে রাখতে। তাই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এই মতা সংসদের হাতে নিয়েছিল। কিন্তু বিচার বিভাগ তাদের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছেন, সংসদের হাতে দেননি। আদালত যাদের অ্যামিকাস কিউরি নিযুক্ত করেছিলেন তাদের ৯ জনই সংশোধনী বাতিলের পে মতামত দিয়েছিলেন। এই মতামতদাতাদের মধ্যে ’৭২-র সংবিধানপ্রণেতা, খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন এবং সেই সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম অন্যতম।
রায়ের পর সংসদে যেভাবে উচ্চ আদালতের রায়ের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন নেতারা, সেখানে অনেকেই কঠিন আক্রমণ করেছেন ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে। সরকারপরে যুক্তি হলো, যারা ’৭২-র সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন, তারাই এর বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন। অন্যদিকে সংসদ হলো সার্বভৌম, যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারকে সরিয়ে দেওয়ার মতা রাখে, সেখানে রাষ্ট্রপতি-নিযুক্ত বিচারপতিদের কেন করা যাবে না? তাদের বক্তব্যেও ধার রয়েছে। তারা আরও বলেছেন, ’৭২-র সংবিধানের এই ধারাটি খর্ব করা হয়েছিল সামরিক শাসন জমানায়। সামরিক শাসকদের সব কর্মকা- যেখানে উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছেন, সেখানে এই ধরনের রায় সংবিধানের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক নয়, সেই রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণও নয়।
যারা এই সংশোধনী বাতিলের পে মত দিয়েছিলেন তাদের যুক্তি হচ্ছে, তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে বিচার বিভাগসহ কোনো প্রতিষ্ঠানই কার্যত ছিল না। তাই সংসদের হাতেই এই মতা রাখা হয়েছিল। সরকার বা সংসদে উঠে আসা পার্লামেন্টিরিয়ানদের বক্তব্যে আরও যুক্তি উপস্থাপন করে বলা হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীরও জবাবদিহিতার জায়গা রয়েছে, সেখানে বিচারপতিদেরও জবাবদিহিতার একটি জায়গা তো থাকতে হবে। সরকার প্রশ্ন তুলেছে, আদালতকে জবাব দিতে হবে, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ কীভাবে সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক? এই রায় গণপরিষদের মাধ্যমে ’৭২ সালে প্রদান করা সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে কীভাবে পরিপন্থী? সম্পূর্ণ রায়ের কপি পাওয়ার পরই সরকার এই জবাবদিহিতার জায়গাটি হয়তো চূড়ান্ত করবে।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেননসহ নেতারা এই রায় পুনর্বিবেচনার দাবিই জানাননি, এটাকে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ’ বলে মন্তব্য করেছেন। সংবিধান, রায় ও তার গতিপ্রকৃতি সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বিচার বিভাগ ভালো জানেন ও বোঝেন। এদিকে এরা যেমন আইনপ্রণেতা, তেমনি বিচার বিভাগ এর ব্যাখ্যা ও সুরা দিয়ে থাকে। সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক শক্তি সরকার ও বিচার বিভাগ মুখোমুখি হওয়ায় খানিকটা উৎফুল্লই হননি, যেন স্বস্তিও পেয়েছেন।
পর্যবেকরা মনে করছেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদার জায়গাটি সমুন্নত রেখে নিজের ইমেজকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়েছেন। অন্যদিকে বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অতীতে আইনমন্ত্রীরা বিচার বিভাগের সঙ্গে একটি অদৃশ্য মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ রা করতে পারলেও এবার এই রায়ের মধ্য দিয়ে যেন দৃশ্যমান হয়েছে, আজকের আইনমন্ত্রী সেটি রাখতে পারেননি। শুধু তাই নয়, সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যে সম্পর্ক রা করার প্রয়োজন ছিল, সেটিও রাখতে পারেননি বা দেশবরেণ্য আইনজীবীদের সঙ্গে একটা মনস্তাত্ত্বিক নৈকট্য বা হৃদয়ের বাঁধনে জড়ানোর উদ্যোগ নেননি।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আপিল বিভাগ বাতিল করে দিতে পারেন জনমনে এমন একটা আলোচনাও ছিল। সংসদে সরকারের মন্ত্রী বা প্রবীণ রাজনীতিবিদরা এই রায়কে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে অভিযোগ করলেও সেই ষড়যন্ত্রটা কী তা খোলাসা করেননি। আরেকটি বিষয়, আমাদের রাজনীতি অতীতে যতটা রাজনীতিবিদদের হাতে নিরঙ্কুশ ছিল, আজকে ততটা নেই। অতীতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি যে আস্থা ছিল বা রাজনীতিবিদদের যে উচ্চতা ছিল আজকে দিন দিন তা ভঙ্গুর হতে চলেছে।
গণতন্ত্রের নবযাত্রায়ও সংসদ বলতে মানুষের চিত্রপটে বিবেচনায় যে সম্মান ও মর্যাদার জায়গা ছিল বর্তমান সংসদ কি সেই মর্যাদার প্রতিষ্ঠান বা আইনসভার কার্যকর প্রতিনিধিত্ব করছে? প্রথমত, একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে এই সংসদ গঠিত হয়েছে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতারা যা চান বাকিরা শুধু তা অনুসরণ করেন মাত্র। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রকে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। আমাদের রাজনীতির অতীত গৌরবের আমাদের জাতীয় জীবনে যত অর্জন সবকিছু এসেছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত ধরে। কিন্তু দিনে দিনে রাজনীতি কতটা রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়েছে তা রাজনীতিবিদরা হৃদয় দিয়ে কি উপলব্ধি করছেন?
আমাদের আদর্শিক রাজনীতিকে ত্যাগের মহিমায় সাদামাঠা, নিরাবরণ, সহজ-সরল, গণমুখী পথ থেকে ভোগবিলাসের গণবিরোধী রাজদুর্নীতির পথে কীভাবে চলে যাচ্ছে তা কি তারা উপলব্ধি করছেন? আদর্শিক, মেধাবী, সৃজনশীল নেতৃত্বের বদলে সংসদে তারা কাদের তুলে আনছেন? দলের রাজনৈতিক নেতৃত্বে কাদের প্রতিষ্ঠা করছেন?
উচ্চ আদালতের রায় ঘিরে প্রবীণ রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন সংসদে যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ বলেছেন, নিশ্চয়ই এটা পল্টনী বক্তৃতার ধাঁচে বলেননি; জীবনের অভিজ্ঞতা ও তথ্য-উপাত্ত নিয়েই বলেছেন। ষড়যন্ত্র এই জাতির জীবনে কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের একদিকে ভ্রান্তনীতি অন্যদিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের আঘাত অনেক হয়েছে। একটি সদ্য স্বাধীন দেশে একটি জাতির জন্য জীবন-যৌবন উৎসর্গ করা, দীর্ঘ সংগ্রামের পথ হেঁটে জাতির জনকের আসনে ঠাঁই নেওয়া ও একটি জাতির ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠা আমাদের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ হারিয়েছি।
আমাদের সংবিধান অসংখ্যবার শাসকদের ইচ্ছায় কী সামরিক শাসক, কী গণতান্ত্রিক শাসক; তাদের হাতে তবিত হয়েছে। আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিতে যে স্বপ্ন রচিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৭২-র সংবিধানের মধ্য দিয়ে যে আশা-আকাক্সক্ষা লালিত হয়েছিল সেখান থেকে আমরা হোঁচট খেয়েছি বারবার। আমরা এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নগাথা একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান বলে রাষ্ট্র নাগরিকের প্রতিটি অধিকার নিশ্চিত করেছেÑ এমনটি আমরা বলতে পারছি না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, আদর্শিক সংঘাত, দুর্নীতি মহোৎসব, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন থেকে আমরা এখনো দেশকে বের করতে পারছি না।
আমাদের বিচার বিভাগ অনেকটা স্বাধীন হয়েছে। অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের প্রবল দাপটের মুখে রাজনীতি পতিত হয়েছে। আমরা এখনো একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। একটি স্বাধীন, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গড়ে তোলা যায়নি। অথচ গণতন্ত্রের জন্য প্রথম শর্তই হচ্ছে, মানুষের অবাধ ভোটাধিকার। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে মতার পরিবর্তনের পথ নিশ্চিত করা আমাদের সংসদে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই মন্ত্রীদের বদলে এমপিদের স্থায়ী কমিটির সভাপতি করেছিলেন। ওয়েস্টমিনিস্টার ডেমেক্রোসির ধাঁচে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব চালু করেছিলেন। কিন্তু এমন সংসদ এখনো গড়তে পারিনি, যেখানে সব আলোচনার ঢেউ উঠবে। তুমুল বিতর্কের মধ্য দিয়ে সব ইস্যুতে সমাধানে পৌঁছবে। যেখানে সরকার ও বিরোধী দল হবে শক্তিশালী। ভারতের লোকসভায় বিগত নির্বাচনে কংগ্রেস এতটাই শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে যে, বিরোধী দলের স্বীকৃতিটাও পায়নি। তবুও সংখ্যাগুরু বিজেপি সরকারের ঘাম ঝরাতে হাতেগোনা কয়েকজনই যথেষ্ট।
আমাদের সংসদও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথা না-ই বললাম, সেনাশাসন-উত্তর গণতন্ত্রের নবযাত্রায় জাতীয় ইস্যুতে তুমুল বিতর্ক ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। সংসদ বর্জনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পা না দিলে সংসদ কার্যকর হয়ে যেত। এমনকি গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধে না গেলে মতায় না-ই আসুক বিএনপি সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হতো। এতে করে সরকার চাপের মধ্যেই থাকত না, পাইপাই জবাবদিহি দিতে হতো।
আমাদের জাতীয় জীবনে পরীা-নিরীা অনেক হয়েছে। একদলীয় শাসনব্যবস্থা, ফৌজি সেনাশাসন, এমনকি সেনাসমর্থিত তথাকথিত সুশীলের সরকারও দেখা গেছে। কোনোটাই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। জাতীয়ভাবে কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি। এই জাতির আজীবনের আরাধনা গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রের জন্য সংসদীয় শাসনব্যবস্থাই উত্তম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। উত্তম শাসনব্যবস্থা সংসদীয় গণতন্ত্রকে সাংবিধানিকভাবে ব্যক্তির নিরঙ্কুশ মতা নিশ্চিত না করে সমষ্টির মতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার বিষয়টি ভাবার সময় এসেছে। সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্বের জায়গা। সংসদ জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের জায়গা। সেই সংসদকে শক্তিশালী, প্রাণবন্ত, বিতর্ক, আলোচনা, নীতিনির্ধারণ ও আইন প্রণয়নের উত্তম জায়গাই নয়; প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রবল হয়ে উঠেছে। ওয়েস্টমিনিস্টার ডেমোক্রেসি বা সংসদীয় গণতন্ত্র কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোয়ই বিদ্যমান রয়েছে। সেসব দেশে বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা বা বিচারপতি অপসারণের মতা কোথায়, সেটি বিবেচনায় নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধের পথ পরিহার করে একটি সমঝোতায় যাওয়ার রাস্তা বের করতে হবে। সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীই নয়, দলীয়করণমুক্ত প্রশাসন আদর্শিক রাজনীতির ধারায় দেশকে প্রত্যাবর্তনই নয়, সংসদে যোগ্য, মেধাবী আইনপ্রণেতাদের নিয়ে আসার উদারতা সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে বিবেচনা করতে হবে। এখানে অর্থ আর পেশিশক্তিনির্ভর প্রার্থীর দিকে না তাকিয়ে রাজনীতি ও সংসদে জনগণের জন্য মেধা ও সৃজনশীলতার স্বার রাখতে পারবেনÑ এমন প্রতিনিধিকে মনোনয়ন দেওয়া জরুরি। খরাকবলিত রাজনীতির এই সময়ে দলে দলে আদর্শিক কর্মী তৈরির বন্ধ্যত্ব গোছাতে সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে মতাশালী ওয়েস্টমিনিস্টার ডেমোক্রেসির ধাঁচেই সংসদ সদস্যদের কাজের পরিধি নির্ধারণ করে দিতে হবে। জনগণ আর কোনো ষড়যন্ত্রের আঘাত দেখতে চায় না; জনগণ চায় একটি উত্তম গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। সেখানে দেশ যেভাবে উন্নয়নের পথে হাঁটছে সেই ধারা অব্যাহত থাকবে। তবে সুশাসন ও আইনের শাসন নিশ্চিত হবে, একটি শক্তিশালী সংসদ হবে সব কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা হবে। সংবিধান, আইন, বিধিবিধান থেকে কারো হাত বড় হতে পারবে না।
পীর হাবিবুর রহমান : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন