একটা ঝড়োহাওয়া বইছে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক গুমোট হাওয়ার মধ্য দিয়ে হঠাৎ ঝড়োহাওয়া বইতে শুরু করেছে। সব কিছুই ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের আশা ছেড়ে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ইয়া নফসি ইয়া নফসি নির্বাচন সামনে রেখে দল ও প্রার্থী গোছানোর কাজ শুরু করেছিল অনেকটা ঘরোয়া রাজনীতির মেজাজে। রামপাল ইস্যুতে যারা বিরোধিতা করছিলেন, তারা ঢেউ তুলতে পারেননি। শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে দুই দেশের মধ্যে উষ্ণতার হিমেল হাওয়া বইছিল। দিল্লিও খুশি, ঢাকাও সন্তুষ্ট। মমতা যত বাগড়াই দিন না কেন? যত প্যাঁচ খেলুন না কেন? শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদি যখন বললেনÑ আমাদের সময়েই তিস্তা চুক্তি হবে; তখন সরকারবিরোধীরা যাই বলুন না কেন? শাসকজোট আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুরই তুলল।
রাজনীতিতে আলোচনা বইছিল, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলার রায় তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি হয় তা নিয়ে। কেউ বলছেন, দ-িত হলেও উচ্চ আদালতে আপিল করার মাধ্যমে তিনি নির্বাচন করবেন। কেউ বলছেন, তিনি জেলে যাবেন এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হবেন। আবার কেউ বলছেন, ভোটের ময়দানে তিনিই দলের হাল ধরবেন। সব কিছুই অনিশ্চিয়তা, জল্পনা, কল্পনা, হিসাব-নিকাশের পাল্লায় ঝুলছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন- অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে সামনে।
অন্যদিকে ব্যাপক আলোচনা বইছিল আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসবে, পর্দার অন্তরালে হিসাব চলছে বিএনপিকে বিরোধী দলের আসনে দেওয়া হবে কিনা? দিলেও কতটি আসন ছেড়ে দেওয়া হবে? যদিও কোনোটিরই হিসাব-নিকাশ দৃশ্যমান হচ্ছে না। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ অচেনা দল নিয়ে মোটা আকারের জোট করে মাঠে নেমেও নামছেন না। কেবলই রাজনীতির অন্দরমহলে হিসাব কষা হচ্ছে, আর দৃশ্যপটে সরকারি দল সাংগঠনিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড; সেই সঙ্গে মাঠপর্যায়ের অভ্যন্তরীণ কোন্দল যেমন বাড়ছে, তেমনি তা নিরসনের চেষ্টাও চলছে।
গোটা দেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল আগামী জাতীয় নির্বাচনের গতিপথের দিকে। হঠাৎ করে সব আলোচনা ছাপিয়ে সরগরম হয়ে উঠল সুপ্রিমকোর্টের সামনে মানচিত্র আড়াল করে দেওয়া বহুল বিতর্কিত ভাস্কর মৃণাল হকের গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে শাড়ি পরিহিতা রমণীর ভাস্কর্য বসানো ঘিরে। কওমি মাদ্রাসার ও হেফাজতের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে এই বিষয়টি তারা নজরে আনেন। তাদের আপত্তির কথা জানান ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি ঘিরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেন, এটা তার পছন্দ নয়। তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপ করে একটি ব্যবস্থা করবেন, এমন আশ্বাস দিলে হেফাজত নেতারাও শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলেন।
সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টের সামনে থেকে এই ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে গেলে একদিকে ভাস্কর মৃণাল হক কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তার মায়ের মৃত্যুতেও এতটা কাঁদেননি তিনি। অন্যদিকে শাহবাগের সেই গণজাগরণ মঞ্চের ইমরান এইচ সরকার যিনি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সরকার ও শাসকজোটের ছায়ায়, আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, সমর্থনে, খেয়েপরে আন্দোলনে উত্তাল করেছিলেন; সেই তিনিও হুট করে বেরিয়ে এলেন ফের রাজপথে। ইতোমধ্যে তিনি সরকারের শিক্ষামন্ত্রী, এককালের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হিযরত করে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া নুরুল ইসলাম নাহিদ শুধু এমপি, মন্ত্রীই নন; আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যও হন। আর এদিকে ইমরান এইচ সরকার একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করতে করতে শাহবাগ মঞ্চে বিভক্তি ও রণেভঙ্গ দেখা দিলে নিজেও কান্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তার আন্দোলন যেমন ব্যর্থ হয়নি, তেমনি তিনি নিজেও হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হননি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কন্যাকে প্রেমের বাঁধনে জড়িয়ে বরমাল্য গ্রহণ করেন। বিয়ে করে মন্ত্রী শ্বশুরের সরকারি বাসভবনে আরাম-আয়েশে দিনযাপন করছিলেন।
কিন্তু ভাস্কর্য সরাতে না সরাতেই তাকে প্রতিবাদ মিছিলে ফের নামতে হয়েছে। সেই মিছিল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সেøাগান উঠলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ছাত্রলীগের কেউ কেউ তাকে কুত্তার মতো পেটানোর জন্য ঘোষণা দেন। সরকারি দলের মহিলা এমপিরাও প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে ইমরান সরকারকে হেনস্তার অনুমতি চান। কিন্তু শেখ হাসিনা ইমরানকে আশ্রয় ও প্রটেকশন ঘটনা স্মরণ করিয়ে বেদনার সঙ্গে বলতে ভোলেননিÑ ‘আজ সে আমার বিরুদ্ধে কথা বলে।’ তিনি দলের মহিলা এমপিদের তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে নিভৃত করেন।
এদিকে ভাস্কর্য বিতর্ক নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের বক্তব্যকে বিকৃত করে হেফাজতের নেতাকর্মীরা সরকারের কাছে তাকে গ্রেপ্তার অথবা তসলিমা নাসরিনের মতো দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার আলটিমেটাম দেন। সেই টকশোর ভিডিও কিপ বারবার আমি শুনেছি। অনেকের সঙ্গে আলাপ করেছি। কিন্তু এটাই সত্য, ধর্মীয় উম্মাদনা ঘটিয়ে মানুষের ধর্মীয় আবেগ, অনুভূতিকে স্পর্শ করে সুলতানা কামালের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। সুলতানা কামাল তার যুক্তিনির্ভর বক্তব্যে হেফাজত নেতার সঙ্গেই অভিন্ন সুরে যেটি বলতে চেয়েছেন, সেটি হলো- এই দেশ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এখানে সব ধর্মের মানুষের ধর্মপালনের সমান স্বাধীনতা রয়েছে। এখানে মন্দিরও থাকবে, মসজিদও থাকবে। যে যে ধর্মে বিশ্বাস করে, তিনি সেখানে গিয়ে তা পালন করবেন। তার বক্তব্যের চেতনাগত জায়গাই ছিল এমনটি। কিন্তু বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর ছিল যে, হেফাজতের একদল নেতাকর্মী সেই ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দিয়ে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালকে বিতর্ক ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের তার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক প্রতিথযশা সম্মানিত ব্যক্তিকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করেছেন। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্নের বাংলাদেশ লাখো শহীদের দেখেছিলেন, গোটা জাতি সশস্ত্রযুদ্ধ করেছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেটি হোঁচট খেয়েছে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষের স্বাধীন জীবনযাপনের পারস্পরিক সৌহার্দ, শ্রদ্ধা, আবেগ, অনুভূতি লালন করার সম্প্রীতির জায়গা থেকে চেতনাগতভাবে সরে যায়নি। এখানে বর্ষবরণের উৎসবে বাঙালির জনস্রোতে যেমন উৎসবের মহাপ্লাবন ঘটে যায়, তেমনি তুরাগের তীরে লাখো মুসল্লির ঢল নামে বিশ্ব ইশতেমায়। প্রতি শুক্রবার জুমআর নামাজে মসজিদে মসজিদে ঠাঁই হয় না মুমিন-মুসলামানদের। একই সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের শারদীয় দুর্গা উৎসবের মহাকর্মযজ্ঞে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন। স্বাধীনভাবে মন্দিরে মন্দিরে প্রার্থনা করেন। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বড়দিনের উৎসব তাদের জীবনে বয়ে আনে সুখ ও শান্তি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও বৌদ্ধপূর্ণিমার উৎসবে তাদের ধর্মীয়রীতি অনুযায়ী সকল আচার অনুষ্ঠান করে থাকেন। ধর্ম যার যার হলেও দেশটি আমাদের সবার।
সুমহান মুক্তিযুদ্ধে সকল ধর্মবর্ণের মানুষরাই এই স্বাধীন আবাসভূমির জন্য জীবন দিয়েছেন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দান। শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখা। আমাদের জাতীয় জীবনে নানা সময়ে রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে এনে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে, যা মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধনে ছন্দপতনই ঘটায়নি; হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। জাতীয় জীবনে দগদগে ক্ষতের যন্ত্রণা সৃষ্টি করেছে।
বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা ঘিরে বাংলাদেশেও দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। তেমনিভাবে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন ও প্রশ্রয়ে ঢাকার শাপলা চত্বর ঘিরে হেফাজতে ইসলাম যে মহাপ্রলয় ঘটিয়েছিল তা দুঃখজনকই নয়; জাতীয় জীবনে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বালিয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভোটের রাজনীতির হিসেবেই হোক আর শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থেই হোক যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেটি অবশ্যই ইতিবাচক ও প্রশংসিত। তিনি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার পথ বের করেছিলেন। বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অতিবিপ্লবীদের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা অতিপ্রগতিশীল ও কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী একটি গোষ্ঠী মাঠে নেমে গেল। যাদের জনসমর্থন নেই, কিন্তু সরকারি প্রটেকশনে রণহুংকার ও স্থিতিশীল পরিবেশ অশান্ত করার ক্ষমতা রয়েছে। তারা তাদের মতো কাজটি করলেন আর হেফাজতিরাও দেশের একজন সম্মানিত নাগরিক সুলতানা কামালকে আক্রমণ করে বসলেন। এতে করে যা শুরু হয়েছে তা রীতিমতো আগুন নিয়ে খেলা। আগুনের খেলা বড়ই ভয়ঙ্কর। ঝড়ো বাতাস কখন কোন দিন দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেয়, কখন কি পুড়িয়ে নিয়ে যায়, তার ঠিক নেই। এই দেশ, এই মাটি ধর্মান্ধ কিংবা অতিবিপ্লবী সাম্যবাদীদের কখনো গ্রহণ করেনি। জনগণ বরাবর গণতান্ত্রিক শক্তিকেই সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু আগুনের খেলা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সর্বনাশ ঘটানোর রক্তাক্ত অধ্যায়ের অভিশপ্ত স্মৃতি রয়েছে অতীত ইতিহাসে। উগ্র ও হটকারী পথ কারো জন্যই শুভ ও কল্যাণ বয়ে আনে না। একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সকল মত-পথের মানুষের চিন্তা ও কথা বলার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। সরকারের কাছে দাবি জানানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাতারাতি অগ্নিগর্ভ করার, পরিস্থিতি নাজুক ও ঘোলাটে করার অধিকার কারো নেই।
একজন মানুষ তার ধর্মের প্রতি, তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস-আনুগত্য নিয়ে গভীর ইবাদতে মগ্ন হতেই পারেন। একজন নাস্তিক কোনো ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নাও হতে পারেন। কিন্তু কোনো পক্ষ অন্যপক্ষের আবেগ অনুভূতিতে আঘাত হেনে সমাজে অশান্তির আগুন জ্বালাতে পারেন না। বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিকভাবে তো বটেই ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে সমকামিতার অধিকার পৃথিবীর অনেক দেশের মতো এখানেও নেই। সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের ঊর্ধ্বে কেউ নন। এসব দিক বিবেচনায় রেখে সবাই নির্বাচনী গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যে সর্বনাশার পথগ্রহণ করেছেন, তা থেকে বিরত হওয়ার এখনই সময়।
পীর হাবিবুর রহমান : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন