তরুণদের সঙ্গে সময় কাটাতে আমি বরাবর আনন্দ পাই। অর্ধেক জীবন পার হয়ে এলেও মনের তারুণ্য আমি কখনো হারাই না। তারুণ্যকে আমি সব সময় অদম্য শক্তিই মনে করি। যুগে যুগে সব বিপ্লব ও পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়েছে তারুণ্য। তরুণরাই আমাদের ভাষার সংগ্রাম থেকে স্বাধিকার, স্বাধীনতার পথ ধরে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলনে বিজয় অর্জন করেছে। ভেঙেচুরে পরিবর্তনের জন্য তারুণ্যের চেয়ে কোনো শক্তি নেই। যেমন বিশ্বাস করি, জনগণের শক্তির চেয়ে পারমাণবিক অস্ত্রের শক্তি বড় নয়। কিছু দিন আগে সিলেট গিয়েছিলাম রোটারেট ডিস্ট্রিক কনফারেন্সের সমাপনী অধিবেশনে অতিথি হয়ে। রোটারিয়ানদের এ যুব সংগঠনে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সের তরুণরাই যুক্ত থাকেন। খুবই সুশৃঙ্খল, উৎসবমুখর, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এ কাউন্সিলে সারা দেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিলেন। আর্ট থেকে নেতৃত্ব, বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অনেকগুলো সেশনে রোটারেটরা বক্তব্য রেখেছেন।
আমার সঙ্গে অভিনেত্রী, চিত্রনির্মাতা রোকেয়া প্রাচীও ছিলেন। একেকটি সেশন আলোচকরা যুক্তিনির্ভর, নাটকীয়তায় ভরপুর, হৃদয় স্পর্শ করা বাগ্মিতায় মুগ্ধ করেছেন। প্রোগ্রাম চেয়ারম্যান ইমরান চৌধুরীর আমন্ত্রণে সেখানে না গেলে আমি বুঝতে পারতাম না, এ দেশের তারুণ্য কতটা সৃজনশীল, মেধাবী, স্মার্ট ও নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করেছে। এর আগে সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. ফরাস উদ্দিন, মোফাজ্জল করিম ও গ্রীণ ডেল্টার ফারজানা চৌধুরীদের সঙ্গে উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা করতে গিয়েও তরুণদের প্রশ্নোত্তর পর্বে অভিভূত হয়েছি। রোটারেট ক্লাবের এ অনুষ্ঠান দেখে আমার মনে হয়েছে যারা সংসদ সদস্য, তরুণ রাজনীতিবিদ তাদের মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে দর্শকসারিতে বসা উচিত। বসলেই তারা বুঝতে পারবেন, আধুনিক ধ্যান-ধারণায় এ সময়ের তারুণ্য কতটা অগ্রসর আর তাদের সঙ্গে চিন্তাভাবনা, চলনে-বলনে কতটা ফারাক রয়েছে। রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, রাষ্ট্রের উন্নয়নে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু এ ধরনের মেধাবী তারুণ্যকে বাইরে রেখে তারা কতটা লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন এ প্রশ্ন আমার মাথার ভিতরে ঢুকেছিল, এখনো বের হয়নি। রোটারেটদের সেই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিলেট শহরের রিকাবী বাজারের কবি কাজী নজরুল অডিটরিয়ামে। সিলেটের উন্নয়নে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখা মরহুম এম সাইফুর রহমানের নামে এটির নামকরণ হয়েছিল। তিনি ক্ষমতায় থাকতেই তার নামে নামকরণ হয়। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আওয়ামী লীগ শাসনামলে সেই নাম পাল্টে দিয়ে জাতীয় কবি নজরুল অডিটরিয়াম করা হয়। সাইফুর রহমানের উন্নয়নকে অর্থমন্ত্রী মুহিত বরাবর কসমেটিক উন্নয়ন বলেছেন। তিনি তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার, ‘আলোকিত সিলেট চাই’ সেই স্বপ্ন কতদূর বাস্তবায়ন করেছেন সেটির মূল্যায়ন সিলেটবাসীই করবেন। তবে আমার মনে হয়েছে, এ নাম পরিবর্তনে সাইফুর রহমান অসম্মানিত হয়েছেন কিনা জানি না, তবে বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল কি সম্মানিত হয়েছেন?
সর্বশেষ শনিবার হৃদয়ে একাত্তর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান উজ্জল চৌধুরীর আমন্ত্রণে সিলেট গিয়েছিলাম তাদের পাঠচক্র ও প্রতিনিধি সভায় অতিথি হয়ে। এ ফাউন্ডেশনের পরিচালক প্রাণবন্ত তরুণ ইব্রাহিম মোহাম্মদ জেসী উপস্থাপনা করেছিলেন। মুসলিম সাহিত্য সংসদ অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত এ সভায় সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক জাকির হোসেনও ছিলেন। ’৯০-এর ছাত্র আন্দোলনে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। আদর্শিক রাজনীতির পথ থেকে কলঙ্ক তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিন শতাধিক নিয়মিত ছাত্রের এ সভা আমাকে অভিভূত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনের অঙ্গীকার নিয়ে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে বুকে নিয়ে ৩৮টি জেলায় তারা এ সংগঠনকে বিস্তৃত করেছে। উজ্জল চৌধুরী ভদ্র ও বিনয়ী একজন সুবক্তাও। সাহিত্যের সুললিত ধারার ঝংকার ওঠে তার বক্তব্যে। তারা নিয়মিত বই পড়েন এবং প্রতি সপ্তাহে একটি বই নিয়ে পাঠচক্রে মিলিত হন।
যেখানেই যাই তরুণদের সামনে বলার চেষ্টা করি, বাঙালির মহত্তম নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী হৃদয় দিয়ে পাঠ করতে। দেশ ও মানুষের জন্য নির্লোভ, অমিত সাহস, নিরাবরণ, সাদামাঠা জীবনের রাজনীতি নিয়ে কীভাবে টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে এসে আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বারবার জেল-জুলুম, ফাঁসির মঞ্চে বিচলিত না হয়ে লক্ষ্য অর্জনের পথে কীভাবে একটি জাতির আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন, কীভাবে একটি নিরস্ত্র জাতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ ধরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে একমোহনায় মিলিত করেছিলেন। দেহে, কণ্ঠে, বাগ্মিতায় পৌরুষদীপ্ত চেহারার দ্যুতিতে অসীম সাহসিকতায় তিনি বাঙালি জাতিকে অনেক উচ্চতায় তুলে এনেছিলেন। সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি, মোটা ফ্রেমের কালো চশমা, মেরিন মোড়ের ধোঁয়া ওঠা পাইপ হাতে শুধু এটুকু বিলাসিতা দিয়ে সৎ রাজনীতির আভিজাত্যকে আলোকিত করেছিলেন। এমন কর্মীবান্ধব, এমন দেশদরদি, এমন উদার রাজনৈতিক সংস্কৃতির মহানায়ক বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর আসেননি। দুনিয়ার সেরা রাজনীতিবিদদের মধ্যে আলোচিত বক্তৃতার একটি হলো তার। একাত্তরের উত্তাল ৭ মার্চ, রেসকোর্স ময়দানে গোটা জাতিকে সেদিন অপরাহ্নে তিনি একমোহনায় মিলিত করে শুনিয়েছিলেন সেই স্বাধীনতার মন্ত্রমুগ্ধ ডাক। তার সেই তর্জনীর পর যেন উপমহাদেশই নয়; বিশ্ব রাজনীতিতে আর কারও আঙ্গুল মানুষকে এতটা আকর্ষণ করেনি।
তরুণদের এ উদ্দীপনাই দেওয়ার চেষ্টা করি, সবাইকে রাজনীতিবিদ হতে হবে এমন কোনো কথা নয়। সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে সেই চিন্তাধারার যুগ অনেক আগেই বাসি হয়ে গেছে। যার মন যে বিষয়ে বেশি টানে, যেটাতে বেশি আনন্দ পাওয়া যায়; সেটিতেই মন দিয়ে একাগ্রতার সঙ্গে লক্ষ্য অর্জন করার চেষ্টা করা উচিত এবং প্রতিটি কাজকে ইবাদতের মতো নিয়ে আমাদের রাজনীতি ও জগৎ সেরা পূর্বসূরিদের জীবনকে, চিন্তাকে, কর্মকে গভীরভাবে পাঠ ও বিশ্লেষণ করার মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করা জরুরি। মানুষের কল্যাণ ও দেশপ্রেম যে কোনো জায়গা থেকেই সম্ভব। পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী আলবার্ট আইনস্টাইন বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় যে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, সেখানে সাহিত্যে তেমনি শেকসপিয়ার। ব্রিটিশ গণতন্ত্রের জনক উইনস্টন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবল থেকে ইংরেজদের রক্ষা করলেও পরের নির্বাচনে হেরে যান। পরবর্তীতে তিনিই আবার প্রধানমন্ত্রী হন। বাগ্মিতায় এতটাই অসাধারণ ছিলেন যে, হিটলারের বুলেটের বিরুদ্ধে চোয়ালের যুদ্ধকেই শক্তিশালী রূপ দিয়েছিলেন। তিনিও নোবেল পেয়েছিলেন, কিন্তু রাজনীতিতে নয়; সাহিত্যে। বিশ্বনন্দিত বিপ্লবী চে গুয়েবারা একজন চিকিৎসক হলেও মানবমুক্তির পথই তাকে টেনেছিল। সেখানে আত্মোৎসর্গ করে ইতিহাসে অমরত্ব পেয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি রমণী মোহনই ছিলেন, বাগ্মিতায় ছিলেন তুখোড়। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন, গরিব হয়ে জন্মানো অপরাধ নয়, গরিব হয়ে মৃত্যুবরণ করাটাই অপরাধ। তিনি আরও বলেন, স্বপ্ন সেটি নয়, যেটি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখা যায়। স্বপ্ন সেটিই, যেটি ঘুমাতে দেয় না। তিনি নিজেও শিশুকাল থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে উঠলেও জ্ঞান আহরণ, মেধার বিকাশ ও লক্ষ্য অর্জনে কখনো বিচ্যুত হননি।
আমি তরুণদের এভাবে বলার চেষ্টা করি, কোনো অপ্সরা সুন্দরী রমণী যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, তুমি এত বেটে কেন? তাকে জবাব দিতে চেষ্টা করি নেপোলিয়ান বেনাপোটের উচ্চতা কতটুকু? এমনকি দরিদ্রতার চেহারাই যদি ফ্যাক্টর হতো, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো আলোর প্রভাব নিয়ে থাকা আততায়ীর হাতে নিহত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন জগিবখ্যাত হতেন না। তাকে দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। ভূমি অফিসে চাকরি খুঁজেও হতাশ হতে হয়েছে। একের পর এক নির্বাচনে পরাজয়ের পর ৫২ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন রিপাবলিকান দল থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়াত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে যারা ২৭ বছর বন্দী করে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে, আন্দোলন-সংগ্রামে জয়ী হয়ে তিনি তাদের ক্ষমাই করেননি, ক্ষমতার অংশীদারিত্বও দিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছেন, আমি মহাত্মা গান্ধীর ভক্ত। কিন্তু নেহেরু আমার আদর্শ। এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু ও আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদার গণতন্ত্রীই ছিলেন না, দুজনই ছিলেন বিশ্বকবি রবিঠাকুরের অনুরাগী। তরুণদের সামনে এখনো আদর্শ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে কোনো বড় নেতা আমাদের সামনে নেই। এখনো তাদের সামনে কৃষকের বন্ধু শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর মতো জনদরদি রাজনীতিবিদ উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন। আমাদের তরুণদের মধ্য থেকেই তাদের আদর্শিক উত্তরসূরিরা বের হয়ে আসবেন এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
সিলেটে হৃদয়ে একাত্তর ফাউন্ডেশন একটি অরাজনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে পথচলা সংগঠনে একজন তরুণকে দেখলাম, কোরআনে হাফেজ হলেও সে গান করে, কবিতা আবৃত্তি করে।
আদর্শিক ছাত্র রাজনীতির অনুপস্থিতির কারণে আমাদের তরুণদের একটি অংশ যেমন বিপথগামী হচ্ছে, ইয়াবার আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে, তেমনি আলোর পথ তারা বের করে নিচ্ছে। তাই রোটারেক্ট ক্লাবে বা হৃদয়ে একাত্তর ফাউন্ডেশনে মেধাবী সৃজনশীল, মুক্তমনা তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তরুণরা সঠিক গাইড পেলে দেশপ্রেমের মন্ত্রে নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পাবে।
সিলেটের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে আলাপকালে দেখেছি, জাতীয় রাজনীতিতে একসময় এ অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্বের ইতি ঘটায় এক ধরনের বেদনা কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর আবদুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, দেশের অর্থনীতির সংস্কারক বিএনপির সাবেক মন্ত্রী সাইফুর রহমান চিরনিদ্রায় শায়িত। সবশেষে চলে গেলেন সংসদীয় রাজনীতির নক্ষত্র সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তারও আগে বর্ণাঢ্য কূটনৈতিক জীবনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে এসে চিরনিদ্রা দিয়েছেন স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। দেশের আরেক মেধাবী সন্তান অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়া বিএনপি জমানায় বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন। অনেকে আশা করেছিলেন তাদের উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবেন সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। ওয়ান-ইলেভেন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বিপর্যয় ঘটালেও সিলেটে তার সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সিলেটে আলোচিত হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে অবসরে যাচ্ছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে জাতিসংঘের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ছোট ভাই ড. আবুল মোমেন সিলেট সদরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হচ্ছেন। অনেকে রসিকতা করে বলছেন, সিলেটে এখন রাজনীতিতে এক টিকিটে দুই ছবি চলছে। অর্থাৎ যে কোনো অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রীকে অতিথি করলে তার ভাই আবুল মোমেনকেও ফ্রি পাওয়া যায়। এখনো অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগের জন্য সুলতান মনসুর অনেক শক্তিশালী প্রার্থী। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে আলোচিত হচ্ছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার লন্ডনে নির্বাসিত পুত্রবধূ ডা. জোবায়দা রহমান ও সদরের বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম খন্দকার আবদুল মালিকের পুত্র খন্দকার আবদুল মোক্তাদিরের নাম।
কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রামের প্রতিনিধি সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছে। নেতা-কর্মীদের সতর্ক করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, দল ক্ষমতায় না থাকলে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে, টাকা-পয়সা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে। ওবায়দুল কাদের অতীত অভিজ্ঞতা বিশেষ করে ওয়ান-ইলেভেনের নির্মমতা সামনে নিয়ে যে কথা বলেছেন, তাতে মানুষের মনের কথা উঠে এসেছে। তিনি নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণের হৃদয় জয় করার তাগিদ দিতে গিয়েই এ কথা বলেছেন। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ বক্তব্যকে রাজনৈতিকভাবে ক্যাশ করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ এখন পালানোর চিন্তা করছে। বসে থাকেননি ওবায়দুল কাদের। তিনিও বলেছেন, আওয়ামী লীগ নয়; বিএনপিই দেশ ছেড়ে পালায়। মানুষ মনে করে, ক্ষমতার অপব্যবহার, দম্ভ, উন্মাসিকতা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিতে যারা নিমজ্জিত হন তাদের পরিণতি সুখকর হয় না, অতীতে পতিত শাসকদেরও হয়নি। রাজনীতিবিদরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বললেও ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে, সেখান থেকে কেউ শিক্ষা নেন না। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছিলেন, সেই লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাকর্মযজ্ঞ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে পশ্চিমারাও বলছেন, বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার বাঘ। দেশ অগ্রসর হলেও গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে নানা মত-পথের সহাবস্থান, পরমতসহিষ্ণু মনোভাব থেকে রাজনীতি কতটা পিছিয়েছে, সেটি বিচার-বিশ্লেষণ করার এবং সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে। সেনাশাসক এরশাদের পতন ঘটিয়ে যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন জনগণকে দেখানো হয়েছিল, সেখান থেকে আমরা কী অনেক দূরে সরে গেছি? সেনাশাসক এরশাদ জমানায় গণতন্ত্রের আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছিলেন, তাদের নাম এখনো মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু সেনাশাসন অবসানের পর গত ২৬ বছর যারা ক্ষমতায় তাদের হাতে প্রতিপক্ষ দলের নেতা-কর্মী ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে কতজন প্রাণ হারিয়েছেন তার হিসাব নেই। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ক্ষমতার দম্ভে যারা উন্মাসিক হয়েছিলেন তাদের করুণ পরিণতি সবার জানা। ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর নির্বাচন সামনে রেখে সাংগঠনিক তত্পরতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। কঠিন কিছু কথা তাকে বলতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় পরিষ্কার বলেছেন, বিগত নির্বাচনের মতো তিনি কারও দায়িত্ব আগামীতে নেবেন না। জরিপে যারা জনপ্রিয় হিসেবে উঠে আসবেন, তাদেরই মনোনয়ন দেওয়া হবে। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। বিএনপি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এরশাদও নাম না জানা অসংখ্য দল নিয়ে জোট করেছেন। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরাই দেশ পরিচালনা করবেন এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় আসবেন, বিরোধী দলে বসবেন। সরকার ও বিরোধী দল শক্তিশালী হবে, সংসদ কার্যকর হবে, জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা ও সুশাসনের পথ ধরে দেশ উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে হাঁটা অব্যাহত রাখবে। বাজেট-পূর্ব এক বৈঠকে ব্যবসায়ীরা ভ্যাট বাড়ালে আন্দোলনে নামার কথা বলেছেন। এটা তাদের আবেগ-অনুভূতির কথা, কিন্তু অর্থমন্ত্রীর মতো একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সৃজনশীল মানুষ যখন কঠোর হস্তে দমনের কথা বলেন, তখন হতাশ হতে হয়। রাজনীতিতে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের আবেগ-অনুভূতি, চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দিতে হয়। বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীও সুন্দর সমাধানের অভিজ্ঞতা রেখেছেন। সবশেষে একটাই অনুরোধ দেশের কল্যাণে দেশের সন্তানরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। মানুষের কল্যাণে যদি সেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথে রাজনীতি করে থাকেন, নির্লোভ, নিরহংকারী হয়ে মানুষের জন্য কাজ করে থাকেন, ন্যায় বিচারক হয়ে থাকেন, তাহলে ক্ষমতা থেকে সরলে পালাবেন কেন? পালাবেন কোথায়, সিনেমা হয়। সেলুলয়েডের সেই দৃশ্য রাজনীতিতে অতীতে দেখেছি, ভবিষ্যতে মানুষ দেখতে চায় না। রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের আদর্শিক পথে পরিচালিত হলে কাউকে পালাতে হবে না, কেন পালাবেন?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
উৎসঃ বিডি-প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন