আ মার লজ্জা লজ্জা লাগে, তাদের তবু শরম লাগে না। মানুষ অবাক হয়, মানুষ বিস্মিত হয়, মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়, মানুষ লজ্জায় মুখ ঢাকে; তবুও তাদের এতটুকুন লজ্জা লাগে না। শরমের বালাই নেই। ক্ষমতা গর্বিত অভিষেকে তারা হাসে। তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটে। শরমের চিহ্নটুকু চেহারায় ফোটে না। আমার কেন এত লজ্জা লাগে, মানুষের কেন এত শরম লাগে, অথচ তারা নির্লজ্জ বেহায়ার মতো বীরদর্পে বুক ফুলিয়ে হাঁটে। এতটাই নির্লজ্জ হয় মানুষ! আমি এর কারণ খুঁজে পাই না।
মূল্যবোধের অবক্ষয়ে গোটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যানসার বসত গেড়েছে। লাজলজ্জা নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? তবে কি তারা মানুষ নয়। রাজনীতির দেবতা বলে তাদের সাতখুন মাফ। লাজলজ্জা মানুষের থাকলেও তাদের থাকতে নেই? তারা মানে সব রাজনীতিবিদ নন। তারা মানে অল্প কিছু হাতেগোনা। তারা মানে সবাই নন। তারা মানে কেউ কেউ। তারা মানেই গরিবের দল করেন। গরিবের কথা বলেন। শুধু গরিব থেকে নিরাপদ দূরত্বে বাস করেন। গরিবের জন্য হাত উঁচিয়ে মঞ্চ কাঁপানো অভিনেতার মতো মেহনতি সংলাপ পাঠ করেন। মঞ্চ কাঁপিয়ে জনস্রোত ঠেলে আলিশান গাড়িতে চড়ে কালো গ্লাস উঠিয়ে নিজেকে আড়াল করেন। তারা বিত্তশালীদের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরেন। গরিব মানুষের রাজনীতি করলেও ধনাঢ্যদের তদবির করেন।
নির্বাচন থেকে রাজনৈতিক সমাবেশ ছাড়াও নিয়মিত নজরানা পান। তারা মানুষকে আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করলেও নিজেরা ভোগবিলাসের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। তারা মানুষকে স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করলেও নিজেরা পরিবার-পরিজনসহ ভোগবিলাসী জীবনেই ভাসেন না, বিদেশের উন্নত চিকিৎসা ও ফাইভস্টার হোটেলের আতিথেয়েতায় গ্রহণ করেন না; বিশ্বনন্দিত ব্র্যান্ডের পোশাক-আশাকে কেতাদুরস্ত হয়ে ওঠেন। তারা আমাদের রাজনীতির গৌরবময় পূর্বসূরিদের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করেন না। জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করলেও তারা হৃদয় দিয়ে, চেতনা দিয়ে লালন ও ধারণ করেন না। বঙ্গবন্ধুর নির্লোভ, নিরাবরণ, সাদামাটা জীবনের মধ্য থেকে মানুষের কল্যাণে রাজনীতির পথকে অনুসরণ করেন না।
গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও কৃষকের বন্ধু শেরেবাংলা একে ফজলুক হক গণমুখী রাজনীতির যে চেহারা নিয়ে ইতিহাসের ক্যানভাসে উদ্ভাসিত, মানুষের কল্যাণের জন্য নিরন্তর কর্মমুখর জীবনের যে ধারা প্রবর্তন করে গেছেন তার আলোয় আলোকিত হতে পারেননি তারা। জনগণের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি, পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের কথাই তারা বেশি ভাবেন। তাই তারা ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ামাত্রই পরিবার-পরিজনদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মহান ব্রত নিয়ে কাজ করেন। তাদের এতে লজ্জা হয় না। তারা মানুষকে গরিবের কল্যাণে কাজ করতে বলেন। সততার বুলি দেন। কর্মীদের পিঠ চাপড়ান। কিন্তু পুত্র, কন্যা, আত্মীয়স্বজনদের চাকরি-বাকরি থেকে স্বজনপ্রীতির পথে যতটা টেনে নেন, কর্মীদের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য সহযোগিতার সেই হাত বাড়ান না। সাধারণের কথা ভুলে গিয়ে টাকার কাছে দাসত্ব করেন। করুণাস্রিত ক্ষমতার গ্লানিতে ডুবে থেকে এলাকায় তারা পরিবার পরিবার করেন। মানুষকে দূরে সরিয়ে দেন। তবু তারা মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেন। রাজনীতি, দল ও কর্মী এরা বোঝেন না। দল ও কর্মীদের আশ্রয়ের ঠিকানা কোন জায়গায় সেটিও মানুষ জানে। তবুও তাদের লজ্জা হয় না। কারণ তারা ক্ষমতায় বাস করে পুত্র, কন্যা, আত্মীয়, পরিজন নিয়ে ভোগবিলাসের জীবনযাপনে সুখেই আছেন। রাজনীতি থেকে অনেকেই সম্পদ বাড়াচ্ছেন। বিদেশে বাড়ি কিনছেন, কেউ বা টাকা পাচার করছেন। মানুষের কল্যাণের রাজনীতির কথা বলে, এসব করতে তাদের গায়ে লাগে না।
তাদের চারপাশে কী রমণী, কী পুরুষ, তদবিরবাজরা ঘুরঘুর করেন। আমুদে হেসেই কথা বলেন না, কমিশন সংস্কৃতির যুগে কাজও করে দেন। মাঠ প্রশাসন থেকে সচিবালয়ের একদল আমলা ও সরকারি কর্মচারী এই সিন্ডিকেট দ্বারা প্রভাবিত। এদের সংখ্যা বেশি নয়। অল্পস্বল্প সরকারি কর্মকর্তা লাজলজ্জা হারিয়ে রাজনৈতিক তদবির বাণিজ্যের পথে নিজেদের ভাগেরটা বুঝে নিতে বিলম্ব করেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলো একদা ছিল জ্ঞানের মন্দির। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল অন্য উচ্চতায়। শিক্ষকরা ছিলেন আত্মমর্যাদা, ব্যক্তিত্বের দ্যুতিতে উজ্জ্বল বর্ণময়। ছাত্ররা ছিলেন আদর্শিক। সেখানে এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার উন্নাসিক সেতুবন্ধই রচিত হয়নি; দলীয় রাজনীতির প্রতি কে কতটা অন্ধ ও অনুগত তার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা চলছে। আমাদের লজ্জা হয়, মানুষের শরম শরম লাগে, তাদের চেহারায় লজ্জার লেশমাত্র নেই। তারা প্রশাসনের কর্তৃত্ব নিতে জ্ঞানের আলোর পথ ছেড়ে রাজনৈতিক অন্ধত্বের ক্ষমতার পথেই তৎপর। যে মুহূর্তে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে, যে মুহূর্তে নারীর সমধিকারের কথা হচ্ছে, বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে, মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ রাষ্ট্র নিতে যাচ্ছে; সর্বত্র সৃজনশীল, মেধাবী, দক্ষ নারী নেতৃত্বের উপস্থিতি বাড়ছে সেই সময়ে সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছেন, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে একই অপরাধে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। বসন্ত জাগ্রত হোক, কোকিলের ডাকে প্রাণ আকুল হোক। কাউকে ভালো লাগলে প্রেম নিবেদন করো। ব্ল্যাকমেইল করা, যৌন হয়রানি করাÑ এ নারীর লজ্জা নয়। এ বিকৃত পুরুষের লজ্জা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মননশীলতা ও মুক্তচিন্তার মন্দিরে যদি যৌনবিকৃত শিক্ষকের কামলিপ্সার শিকার হতে হয় একজন ছাত্রীকে, তাহলে অনগ্রসর সমাজের চিত্র কত ভয়ঙ্কর। অনেকে প্রতিবাদ করেন, অভিযোগ করেন, অনেকে পরিবার, সমাজের কথা ভেবে, লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টি গোপন করে ফেলেন। যেন এ নারীর লজ্জা। যেন ছাত্রটির লজ্জা, শিক্ষকের কোনো লজ্জা নেই। লজ্জা সব আমাদের, সাধারণ মানুষের। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাঙ্গন হয়ে মাদ্রাসা, সরকারি-বেসরকারি কর্মক্ষেত্র থেকে হাসপাতাল, চিকিৎসকের চেম্বার কোথাও নারী নিরাপদ নয়। সমাজের এই অশ্লীলতা নিয়ে, পুরুষের এই লজ্জাহীনতা নিয়ে প্রথাবিরোধী লেখক তসলিমা নাসরিন কলম ধরেছিলেন, মুখ খুলেছিলেন। তার ঢেউ অনেকটাই ছড়িয়েছে। অনেকে এখন প্রতিবাদ করতে জানেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সেই চিত্র উঠে আসে। নারীকে আরও জাগতে হবে। লজ্জাহীনদের চেহারা চিহ্নিত করতে হবে। রিজভী নামের এক নিউরোলজিস্ট তার বন্ধুপতœী চেম্বারে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে গেলে বিকৃত লালসায় আক্রমণ করতে গিয়ে থাপ্পড় খেয়েছিলেন। সেই রমণী বের হয়ে আসার পর লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে বলেননি। লজ্জা যেন সেই ধর্ষণকামী পুরুষ চিকিৎসকের ছিল না, লজ্জা যেন ছিল অসহায় নারীটির।
আমার লজ্জা লজ্জা লাগে, আমার শরম শরম লাগে। সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াদের যুগ বাসি হয়ে গেছে সেই কবে। লেখক সাংবাদিকরা বিভক্ত রাজনীতির সীমারেখায় যার যার দলে এতটাই অন্ধ, পেশাদারিত্বের জায়গায় বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন। দলকানা দলদাসের সংখ্যা নানা পেশা ও শ্রেণিতে এতটাই বাড়ছে যখন যেখানে যাচ্ছেন গুণকীর্তন করছেন, মুসাহেবি করছেন। মুসাহেবদের কোনো লাজলজ্জা নেই। সর্বত্র মতলববাজ, তদবিরবাজ, চাটুকারদের দৌরাত্ম্য। এদের সংখ্যা কম, কিন্তু চোখে পড়ার মতো। তাদের লজ্জা নেই, লজ্জা সব মানুষের। মানুষরা দেখে, মুখ লুকায়। নির্লজ্জ বেহায়ারা নিজের পেশাদারিত্বের মর্যাদার জায়গা থেকে স্বার্থান্ধ হয়ে সরে যায়। রাষ্ট্রীয় পদক এক সময় গুণীজনদের তাদের অবদানের জন্য খুঁজে এসে সসম্মানে শ্রদ্ধার সঙ্গে গলায় তুলে দিতেন। এখন যারা যেখানে দায়িত্ব পান, নিজেদের লোক খোঁজেন। অতীতের বিতর্ক পর্যন্ত ভুলে গিয়ে গলায় পদকমাল্য তুলে দিচ্ছেন। লাজলজ্জা তাদের হয় না। লজ্জা মানুষের, মানুষরাই লজ্জা পায়। কাঙাল গুণীজনদের লজ্জা নেই। সমাজে দীর্ঘদিন থেকে পদক বাণিজ্যের রমরমা আসর বসেছে। মাদার তেরেসা পদক, মহাত্মা গান্ধির নামে পদক ব্যবসায়ীরা সমাজপতিদের পদক দিয়ে বেড়ায়। অবসরপ্রাপ্ত বিচারক থেকে রাজনীতিকপাড়ার মন্ত্রীও এসব পদক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন নেন। নির্লজ্জ বেহায়ারা গোপন অর্থদানের মাধ্যমে পদক নিয়ে ফটোসেশন করেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেন। আমাদের লজ্জা-শরম লাগে। ওদের লাজলজ্জা কিছুই লাগে না। ড্রয়িংরুমের শোকেসে এসব বামুনের হাত থেকে নেওয়া বাণিজ্যিক পদক শোভা পায়।
লাখো লাখো বিনিয়োগকারী রিক্ত-নিঃস্ব হয়। তাদের তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের অভিশাপে বাতাস ভারী হয়। তবুও শেয়ার কেলেঙ্কারির লুটেরাদের কদর সমাজে কমে না। তাদের সঙ্গে উঠবোস, জুয়াড়িদের সঙ্গে চলাফেরা লজ্জাহীনদের স্ট্যাটাস বাড়ায়। সামাজিক মর্যাদায় রিক্ত, নিঃস্ব সাধারণ মানুষরা বেকুব হিসেবে লোকসানের পাল্লায় চড়ে লজ্জিত হয়। লুটেরারা বিত্তশালী হয়, সম্পদশালী হয়। সমাজপতিরা তাদের চেয়ার ছেড়ে দেন। তাদের লজ্জা লাগে না। লুটেরাদের তো লজ্জা নেই, আমাদের কেবল লজ্জা-লজ্জা লাগে।
ব্যাংকিং খাত লুটপাট হয়, ব্যাংকঋণ বাড়তে থাকে। লুটেরা ও ঋণখেলাপিদের লাজলজ্জা কিছুই হয় না। মাঝখানে সমাজে কদর বাড়ে ব্যাংকলুটেরা হিসেবে, মর্যাদা বাড়ে। লুটেরাদের সঙ্গে সব মহলের ঊঠবোস চলে। ওপর মহলে, লুটেরা মহলে লাজলজ্জা থাকতে নেই। ওদের লজ্জা হয়, লজ্জা সব মানুষের ভূষণ। সাধারণ মানুষরা লজ্জিত হয়। জনগণের সম্পদ লুট হয়ে যায়। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়ে যায়। একজন ড. আতিউর রহমান আদর্শিক মানুষ হিসেবে বিবেকের তাড়নায় অশ্রুজলে পদত্যাগ করে বিদায় নেন। কিন্তু অপরাধীদের সাজাও হয় না, লজ্জায় মুখও লাল হয় না।
মনোনয়ন বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য রমরমা অবস্থা নিয়েছে। মুনাফা লুটছে বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতরা। এত নির্লজ্জতা, সাদাকালো যুগে কল্পনারও অতীত ছিল। ঘাতক চালকরা তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরের মতো দেশের কীর্তিমান সন্তানদের প্রাণ কেড়ে নেয়। আদালতে সাজা হয়। নির্লজ্জ খুনিরা লজ্জা পায় না। পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়। তাদের কোনো লজ্জা হয় না, লজ্জা সব মানুষের। আমাদের লজ্জা লজ্জা লাগে, আমাদের শরম-শরম লাগে। তারা সবাই লাজলজ্জার ঊর্ধ্বে। নির্লজ্জদের আবার লজ্জা কিসের? নির্লজ্জ হলেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা যায়। লজ্জা-শরম না থাকলেই প্রতারক হওয়া যায়। লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, মতলববাজ, তদবিরবাজ, চাঁদাবাজ এমনকি ধর্ষক হওয়া যায়। লজ্জা না থাকলে সমাজে দাপটের সঙ্গে এসব পরিচয়ে দাবড়ে বেড়ানো যায়। তাদের দেখে আমাদের কেবল লজ্জা লজ্জা লাগে।
পীর হাবিবুর রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন