আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মোজাফফর হোসেন পল্টু দলের উপদেষ্টাম-লীতে ঠাঁই পেয়েছেন। দলের আরেক নেতা মুকুল বোস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য পদে ঠাঁই পাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীরা তাদের দলের সভাপতি শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানাননি, নানা আলোচনায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন। অনেকে বলছেন, আওয়ামী লীগে জীবনের পড়ন্তবেলায় হলেও নিবেদিতপ্রাণ নেতা মোজাফফর হোসেন পল্টু সম্মান পেয়েছেন। এক সময়ের মাঠের পরিশ্রমী সংগঠক মুকুল বোসও ক্ষমা লাভের মধ্য দিয়ে তার সভাপতির কাছ থেকে ওয়ার্কিং কমিটিতে কাজ করার মতো স্বীকৃতি ও জায়গা পেয়েছেন। অনেক জায়গায় আলোচনা হচ্ছে, পল্টু ফিরেছেন, মুকুল ফুটছে, সুলতানদের ভাগ্যে কী হবে? অনেকেই আশাবাদী অভিশপ্ত ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনায় দলের সংস্কারপন্থি নেতাদের অনুসরণ করার কারণে যারা এখনো দলীয় সভাপতির কাছ থেকে মানসিক দ-মুক্তি পাচ্ছেন না, তারাও আগামীতে পেয়ে যাবেন।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে, মানসিক উদারতায় সবাইকে এক পতাকাতলে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে দলটিকে বটবৃক্ষের মতো তৃণমূল পর্যন্ত শিকড় বিস্তৃত করে যে বিশাল সাংগঠনিক শক্তিকে সুসংহত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেখানে সর্বশেষ কাউন্সিলে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও তার সহকর্মীরা টিম ওয়ার্কের মধ্য দিয়ে গতি সঞ্চালন করেছেন। ওয়ার্কিং কমিটি দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সার্বক্ষণিক গাইডে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধভাবে কাজ শুরু করেছে। সংগঠনের মাঠ পর্যায়ের দুর্বলতা, বিভেদ, দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের ব্যর্থতা চিহ্নিতকরণ ও তার সমাধানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই শক্তিশালী ঐক্যের জায়গায় নিয়ে আসতে চাইছেন; যেখানে দাঁড়িয়ে তারা বলছেনÑ আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হলে আর কোনো শক্তি কী রাজপথে, কী নির্বাচনে সামনে দাঁড়াতে পারে না।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীতে ঠাঁই পাওয়া মোজাফফর হোসেন পল্টুর রাজনৈতিক অতীত বর্ণাঢ্য। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে কমলাপুর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়ে রাজনীতিতে আসা পল্টু স্বাধীনতা-উত্তর গাজী গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে গঠিত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের ক্রান্তিকালে সেনাশাসনকবলিত বাংলাদেশে যখন দেশে ফিরে দলের হাল ধরেছিলেন, তখন একদিকে দলের ভাঙা-গড়া, অন্যদিকে কারো কারো সেনাশাসক এরশাদের সঙ্গে চলে গিয়েও না যাওয়ার হতাশায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির হাল ধরেছিলেন পল্টু। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রচার সম্পাদক থেকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন। কর্মী অন্তঃপ্রাণ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি সর্বদা অনুগত মোজাফফর হোসেন পল্টু দলের দুঃসময়ে সব আন্দোলন, সংগ্রামে অগ্রভাগে থেকেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির অন্যতম দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তিনি। দলের পরাজয়ের পর মোজাফফর হোসেন পল্টু, ন্যাপ রাজনীতি থেকে আসা মোনায়েম সরকার ও জাতীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সহপ্রচার সম্পাদক নুরুল ফজল বুলবুলসহ সাতজনকে ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। বাদ দেওয়ার কারণ জানা না গেলেও আজীবন বঙ্গবন্ধু অন্তঃপ্রাণ মোজাফফর হোসেন পল্টু, নুরুল ফজল বুলবুলরা আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য রেখেই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। কিন্তু বুকভরা বেদনা নিয়েও মোজাফফর হোসেন পল্টু বঙ্গবন্ধু থেকে জাতীয় চার নেতা যেখানেই স্মরণসভা, সেখানেই তিনি বিভিন্ন ব্যানারে তৎপর থাকেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে নৌকা সমর্থক গোষ্ঠীর ব্যানারেও কথা বলতে থাকেন। অবশেষে জীবনের পড়ন্তবেলায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা তাকে উপদেষ্টাম-লীতে ঠাঁই দেওয়ায় তিনি খুশিই হননি; আওয়ামী লীগ পরিবারেও প্রশংসিত হয়েছেন।
একাত্তরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে ভাই হারানোর বেদনা নিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে পরিশ্রমী সংগঠক হিসেবে আবির্ভূত হওয়া মুকুল বোসকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ধরে নিয়ে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন করে জেলজীবন দিয়েছে। কারামুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে তিনি আরও কর্মীবান্ধব চরিত্র নিয়ে নিজেকে নিবেদিত করেন। ’৯৩ সালে আওয়ামী লীগ ঐক্যের মোহনায় মিলিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাকে স্নেহছায়া দিয়ে দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য থেকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত নির্বাচিত করেন। ওয়ান-ইলেভেনে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর একদিকে ক্ষমতাসীনদের চাপ, অন্যদিকে সংস্কারপন্থি নেতাদের কবলে পতিত সহজ সরল মুকুল বোসের বেফাঁস বক্তব্য দলীয় সভাপতি ও নেতাকর্মীদের ব্যথিতই করেনি, ক্ষুব্ধও করে। কিন্তু মুকুল বোস বরাবরই শেখ হাসিনার প্রতি ছিলেন অনুগত। স্পোকম্যান হিসেবে কখনই অতীতে দায়িত্ব পালন করেননি। তাই তার মন্তব্য যে বিড়ম্বনায় ফেলে তাতে ওয়ান-ইলেভেনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে রাজনীতি ও ক্ষমতায় বিজয়ীর বেশে আসার পর সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে তাকেও আর দলে জায়গা দেননি। দিনে দিনে মানসিক যন্ত্রণায় শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েন মুকুল বোস। আওয়ামী লীগে ঠাঁই পাওয়ার নিরন্তর আকুলতা ও ব্যাকুলতা নিয়ে তার নেত্রীর দিকে বারবার এগিয়ে গেলে বিগত ঢাকার মেয়র নির্বাচনের আগে তাকে দলে কাজ করার অনুমতি দেন। ঢাকা দক্ষিণ মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকনের পক্ষে তিনি কাজে নামেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে তিনি ঠাঁই পাচ্ছেনÑ এমন সম্ভাবনা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হলেও তিনি আর ঠাঁই পাননি। সম্প্রতি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াকে উপদপ্তর সম্পাদক করায় খালি হওয়া ওই পদটি মুকুল বোসকে দেওয়ার কথা বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। মুকুল বোস এতে নিজেও আবেগ আপ্লুত হন। তাকে অভিনন্দন জানাতে যাওয়া কর্মী-স্বজনদের সামনে দলীয় সভাপতির প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখের অশ্রু ফেলেন। খুব শিগগিরই ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য করার চিঠি তিনি পাবেন বলে জানা যায়।
আওয়ামী লীগের যে নেতারা ওয়ান-ইলেভেনে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, দুই টার্মের বেশি দলের সভাপতি পদে না থাকা, দুই টার্মের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, প্রধানমন্ত্রী হলে দলের সভাপতি না থাকার বিধান করার সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তারা দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য থেকে মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। কিন্তু সেই সময় যারা তাদের সঙ্গে কেবল যুক্ত ছিলেন তাদের অনেককেই তার খড়গ বহন করতে হয়। ভোগ করতে হয় রাজনৈতিক ও মানসিক দ-। সেই অনুসারীদের মধ্যে আবদুল মান্নান দুবার সংসদে এসেছেন। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সংসদ সদস্য হয়েছেন, বিগত নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েও পরাজিত হয়েছেন। সর্বশেষ তাকে বিএমএর সভাপতি করা হয়েছে। খ ম জাহাঙ্গীর ২০০৮ সালে মনোনয়ন না পেলেও এবার সংসদে আছেন।
ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না সেনাশাসক জিয়া-এরশাদের মন্ত্রিত্ব নেননি। বাড়ি বিএনপির ঘাঁটি বগুড়া হলেও যাননি বিএনপিতে। বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটুকু আওয়ামী লীগেই আছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রতিও তার শ্রদ্ধাবোধ ছিল এবং আছে। যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে। মনোনয়ন নিয়ে পরাজিত হলেও সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কার তাকেও দল থেকে ছিটকে ফেলে দেয়। তিনিও বসে থাকেননি। নাগরিক ঐক্য গঠন করে সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। ২২ মাস কারাভেগের পর অসুস্থ অবস্থায় মুক্তি পেয়েছেন।
ডাকসুর সাবেক ভিপি আখতারুজ্জামান মনোনয়নবঞ্চিত হলেও গাজীপুরের জেলা পরিষদের প্রশাসক এবং এবার চেয়ারম্যান হয়েছেন। দুবার ওয়ার্কিং কমিটিতে ঠাঁই পেলেও এবার বাদ পড়েছেন। সাবের হোসেন চৌধুরী খুব দ্রুত শেখ হাসিনার আস্থা ও স্নেহে ১ নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক, রাজনৈতিক সচিব রীতিমতো দক্ষিণহস্ত হয়ে উঠেছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ পড়লেও সংসদে ঠাঁই পেয়েছেন বরাবর। সর্বশেষ ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। দলে বা সংসদে ঠাঁই পাননি সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়ীদ। ষাটের দশকে রাকসুর জিএস-ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। ’৭০-এ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, ’৭৩-এ সংসদ সদস্য ও ’৭৫-এ বাকশালের গভর্নর নিযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর খুনি মোশতাকের বঙ্গভবনে এমপিদের ডাকা বৈঠক প্রতিরোধ করতেই নয়, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সংগঠিত করতে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখেন। গবেষণা, লেখালেখি, পড়াশোনা, রাজনীতিতে নিবেদিতপ্রাণ অধ্যাপক আবু সাইয়ীদ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদকই নন; শেখ হাসিনার আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। হয়েছিলেন ’৯৬ সালে তথ্য প্রতিমন্ত্রী। ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারের অপরাধে রাজনৈতিক দ-ের ক্ষমা লাভ এখনো তার ভাগ্যে জোটেনি।
ষাটের দশকে স্কুলজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ জাতীয় রাজনীতিতে উঠে এসেছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর সিলেট এমসি এবং মদনমোহন কলেজের নির্বাচিত ভিপি সুলতান মনসুর এইচএসসিতে মেধাতালিকায় স্থান অর্জন করেছিলেন। রক্ত ও অস্থিমজ্জায় বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও দেশপ্রেমের মহিমায় নিজেকে রাজনীতির জন্যই উৎসর্গ করেছিলেন। সব ভোগ-বিলাস, ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দ, বাসনা, বিলাসিতা নির্বাসনে নিয়ে রাজনীতির আদর্শিক পুরুষদের জীবনযাত্রাকে অনুসরণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ব্যানারে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। খেয়ে না খেয়ে, মানবেতর জীবনযাপন করে ’৭৯ সালে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সিলেট অঞ্চলই নয়, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সাংগঠনিক দক্ষতায় নিজেকে নিবেদিত করেন। মরহুম জাতীয় নেতা আবদুস সামাদ আজাদ তার উত্থানে যেমন ভূমিকা রাখেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বোনের স্নেহ দিয়ে ভাইয়ের মতো কাছে টানেন। ছাত্রলীগের সভাপতিই নয়; তোফায়েল আহমেদের পর সেনাশাসন জমানায় প্রথম এই সংগঠন থেকে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর জাতির মহানায়কের প্রতি ২১ বছর যে রাষ্ট্রীয় অবিচার হয়েছে তার প্রতিবাদে তিনি ডাকসু ভবনে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানিয়ে কিছু কিছু রাজনৈতিক শক্তির বৈরিতার মুখে পড়েন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে আবদুস সামাদ আজাদেরও বিরাগভাজন হন। সুলতান মনসুরের পরিণত বয়সে চেহারায় বঙ্গবন্ধুর অবয়ব ফুটে ওঠে। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা তাকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করেছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনে সংস্কারপন্থি নেতাদের কারো কারো সঙ্গে বাহাস করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষে থাকায় তিনিও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দ-ভোগ করেন, যা তার ভাষায় রাজনৈতিক কারাগার। প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঠাঁই না পাওয়ার অন্তহীন বেদনা তাকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। আপনজনদের আত্মবিশ্লেষণের পথে তিনি বলছেন, ‘শেখ হাসিনা ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেছিলেন। রাজনীতিতে সুযোগ পেলে ৮ বছরে কত মানুষের উপকার করতে পারতেন।’ সিলেট বিভাগের মাটি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে উঠে আসা আবদুস সামাদ আজাদ, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, সাইফুর রহমান ইন্তেকাল করেছেন। শাহ এএমএস কিবরিয়া বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন। সিলেটবাসীর প্রত্যাশা ছিল এদের পর সুলতানই জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্ব করবেন। তারা এখনো আশা করেন সুলতানকে শেখ হাসিনা একদিন দলে ফিরিয়ে নেবেন। সুলতান বরাবরই বলছেন, বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শের বাইরে তিনি রাজনীতি করবেন না।
বাহালুল মজনুন চুন্নু পঁচাত্তর-উত্তর দুঃসময়ে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মিষ্টি ব্যবহার ও সাংগঠনিক দক্ষতায় ছাত্রলীগকে শক্তিশালী করতে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সদস্য চুন্নু বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি নিবেদিত হলেও দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে বা সংসদে তিন দশকেও ঠাঁই পাননি। হাবিবুর রহমান খান পঁচাত্তর-উত্তর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। ছিলেন আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের নেতাকর্মীরা যেখানে প্রাপ্য মর্যাদা পান না, সেখানে ৫ জানুয়ারির ভোটে হেরেও আবদুল মান্নান খানদের প্রেসিডিয়ামে ঠাঁই হয়ে যায়।
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর বাঙালি জাতির ইতিহাসের ঠিকানা ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িটি তখনো রক্তবন্যায় ভাসছে। আওয়ামী লীগের প্রাণ ও জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বুলেটবিদ্ধ নিথর দেহ অনাদর, অবহেলায় সিঁড়িতে পড়ে রয়েছে। তেমনি সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ও দলের নেতাদের একটি অংশ অসাংবিধানিকভাবে বিশ্বাসঘাতক খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নিয়েছিলেন।
ষাটের দশক থেকে মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা রাখা ’৭৫-উত্তর সাহসী ভূমিকাই নয়; বঙ্গবন্ধুকন্যাকে দলের নেতৃত্বে ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা মোস্তফা মহসীন মন্টুদের আওয়ামী লীগ করা হলো না। সেনাশাসক জিয়ার খালকাটা বিপ্লবের আদর্শচ্যুত, গণসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ বামরা এসে এমপি, মন্ত্রী, নেতা হলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে রক্তের ওপর দিয়ে মন্ত্রিসভায় যাওয়া নেতারা যদি আওয়ামী লীগের নেতা-এমপি হয়ে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করা সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনকারী নেতারা যদি মন্ত্রী হতে পারেন; তাহলে দলের জন্য এত ভূমিকা রাখা সংস্কারের অভিযোগে রাজনৈতিক দ-ভোগী সুলতান মনসুর থেকে মেহেরপুরের অধ্যাপক আবদুল মান্নানরা কেন বঙ্গবন্ধুকন্যার ক্ষমা লাভ করতে পারবেন না? এটি বুঝতে পারি না। বঙ্গবন্ধুকন্যার বেদনা থাকাই স্বাভাবিক। তিনি যখন মূল নায়কদের ক্ষমা করতে পেরেছেন, নিশ্চয়ই তাদের অনুসারীদেরও ক্ষমা করে দলে টেনে নিতে পারেন। আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একটি টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে যে কাজ শুরু করেছেন তাতে মাঠের নেতাকর্মীরা ধানম-ির কার্যালয়ে নিয়মিত এসে তাদের পাচ্ছেন। ওবায়দুল কাদের নিয়মিত কার্যালয়ে বসছেন, ওয়ার্কিং কমিটির অন্য নেতারাও থাকছেন। এতে কর্মীদের পদচারণায়, আনাগোনায় দলীয় কার্যালয় সরগরম হয়ে উঠেছে। সারা দেশের মাঠকর্মীরা নিয়মিত দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে যেমন যোগাযোগ রাখছেন, নেতারাও তেমনি সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করছেন। শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে স্থানীয় নেতাকর্মীদের আইভীর পক্ষে যেভাবে এক মোহনায় মিলিত করেছিলেন, সেটি এখন আওয়ামী লীগের মাঠের রাজনীতির সামনে মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে ওবায়দুল কাদেরসহ সবাই স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা রেখেছেন। কাউন্সিলোত্তর আওয়ামী লীগে একটি স্বতঃস্ফূর্ত কর্মোদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। দলকে জনপ্রিয় করতে বিতর্কিত হাইব্রিড, সুবিধাবাদী, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে বলেছিলেন ওবায়দুল কাদের। সেটি কতদূর হয়েছে জানি না। তবে প্রশ্ন জাগে, মুজিব অন্তঃপ্রাণ আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য হৃদয়ের তলানিতে গভীর ক্রন্দন নিয়ে দলের মধ্যে সারা দেশে যারা উপেক্ষিত, দলের বাইরে ছোট ছোট দলে আশ্রয় নেওয়া, দুর্দিনের সাথীদের দলের পতাকাতলে না টেনে বিভিন্ন অঞ্চলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের কেন টানা হচ্ছে- সেটি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ শীর্ষ নেতারা বিবেচনা করবেন কিনা এ প্রশ্ন থেকেই যায়। দলের ভুল করা, অভিমানে দল ছেড়ে চলে যাওয়া ভাইদের মুজিব কন্যার দলে টানা উত্তম নাকি চাঁপাইনবাবগঞ্জের এমপির ৮ শতাধিক জামায়াত-বিএনপির মামলা খাওয়া নেতাকর্মীদের দলে টানা উত্তম। সেটি ভাবার সময় এখন।
পীর হাবিবুর রহমান, প্রধান সম্পাদক পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন