হিংস্র, ক্ষ্যাপাটে, কসাই ’বদ’ বদরুল ইসলামের চাপাতির কোপে ক্ষত-বিক্ষত, মৃত্যুশয্যায় শায়িত সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসের পাশে গোটা বাংলাদেশ দাঁড়িয়েছে। এই পাশে দাঁড়ানো মানে দানবশক্তির বিরুদ্ধে, মানবিক শক্তির পক্ষে সংহতি জানানো। খাদিজা নার্গিসের পাশে গভীর সহানুভূতি ও ভালোবাসা নিয়ে পাশে দাঁড়ানো ও অন্যদিকে পাশবিক শক্তি নিয়ে বন্যপশুর মতো হত্যার উন্মত্ততায় হামলে পড়া বদরুলের বিরুদ্ধে নিন্দা, ক্ষোভ আর ঘেন্নার সঙ্গে ক্রসফায়ারে দেয়ার মতো যে দাবি উঠেছে, তাতে এই সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে যে অস্থির, অশান্ত, অসুস্থ, নষ্ট রাজনীতির ক্ষমতার উন্মত্ততায় কুলষিত সমাজের বুক চিড়ে যার যার অবস্থান থেকে নানা শ্রেণীপেশার মানুষ মানবিক শক্তির পক্ষে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে।
এই বর্বোরোচিত ঘটনার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা মানুষেরা যে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে, খাদিজা নার্গিসের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য স্রষ্টার কাছে যে আকুতি জানাচ্ছে, তা কার্যত নারীর প্রতি জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ণ, ইভটিজিং, অশোভন আচরণের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ। এই খাদিজা নার্গিসের প্রতি গভীর সহানুভূতি আর বদরুলের প্রতি ঘৃণা, ধিক্কার ও ফাঁসির দাবি কার্যত শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর অমানুষের বর্বর আক্রমণ ও সংগঠিত যেকোনো অন্যায়, অপরাধ, জুলুমের বিরুদ্ধে তেজোদ্দীপ্ত প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ তনু হত্যার পর হয়েছে। এই প্রতিবাদ ইয়াসমিন হত্যার পর দেখা গেছে। এই প্রতিবাদের আগুন উইলস লিটলস ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে এক দর্জির ছুরিকাঘাতে হত্যার পর ঘটেছে। ১৯৭৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী নীহার বানুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ পুতে রাখার প্রতিবাদে ঘটেছে।
তনু-ইয়াসমিন যৌন লালসার শিকার হয়েছিল। নীহার বানু হয়েছিল সহপাঠী বাবুর প্রেম প্রত্যাখান করার কারণে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি বাবু জার্মানিতে পলাতক ছিল। দীর্ঘ ৪০ বছরেও তার সাজা কার্যকর হয়নি। উইলস লিটলস ফ্লাওয়ার স্কুলের মেয়েটিও একটা দর্জির প্রেম-কাম প্রত্যাখান করার কারণে জীবন দিয়েছে। তুমুল ঝড় উঠেছে খাদিজা নার্গিসের ওপর হামলার প্রতিবাদে।
সিলেট এমজি কলেজ এলাকায় পরীক্ষা থেকে বের হয়ে আসার পথে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত বদরুল চাপাতি দিয়ে শরীর ও মাথায় যেভাবে কুপিয়েছে, মোবাইল ফোনে ধারণকৃত নৃশংসতার এমন দৃশ্য কসাইদের হাতে পশু জবাইয়ের দৃশ্যকেও হার মানিয়েছে। এই নৃশংসতার চিত্র ধর্ম, বর্ণ, দল মত নির্বিশেষে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সকল মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে মানুষের ঘুমন্ত চেতনাকে এক ধাক্কায় জাগিয়ে দিয়েছে।
গ্রামীণ জনপদে বেড়ে ওঠা বদরুল একসময় খাদিজা নার্গিসের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল। থাকা-খাওয়ার কৃতজ্ঞতার বদলে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হত্যার উন্মত্ত নেশায় বিভৎস খুনির চেহারায় এই হামলা চালিয়েছে। দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বদরুল ইসলামকে ‘বদ’ বদরুল বলেই সবাই চিনতো। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ তাকে সিনিয়র সহ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিল।
ছাত্রলীগ ঘটনার পর তাদের সংগঠনের কেউ নয় বলে দাবি করে বসে। অস্বীকার করে, সে ছাত্রলীগের কেউ নয়। এমনকি আওয়ামী লীগের অতিকথনে পারদর্শী ড. হাছান মাহমুদ যখন বলেছেন, ’বদরুল ছাত্রলীগের কেউ নয়, শিবির হতে পারে।’ তখন মানুষ বিস্মিত হয়েছে। হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারেনি। ছাত্রলীগ কাউকে কোনো ছাত্রীর ওপর কেন, কোনো মানুষের ওপরই নির্দয় অত্যাচার, আক্রমণের শিক্ষা দেয়নি। তবুও যখন অসুস্থ রাজনীতির চলমান ধারবাহিকতায় ক্ষমতার উন্নাসিকতায় ও দম্ভ প্রকাশ্য রূপ নেয়, তখন বদরুলরা বেপোরোয়া হয়ে উঠে।
ছাত্রলীগ শুরুতেই তাকে বহিষ্কার করে বিচার দাবি করতে পারতো। যা একদিন পর করেছে। আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদও বলতে পারতেন, ‘সন্ত্রাসীদের কোন দল নেই, আমরা তার শাস্তি চাই।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদিজা নার্গিসের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। নারীর ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে বরাবরই তিনি সোচ্চার। আর সবসময় বলেন, ‘সন্ত্রাসীর কোনো দল নেই।’ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছাত্রলীগের বেপোরোয়া একদল উন্নাসিক কর্মীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে বলেছিলেন, ‘সংগঠনে ছাত্র শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মানুষ এটা আমলে নেয়নি।’
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সেতু মন্ত্রী এবং ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের ওষুধ নয়, অপারেশন প্রয়োজন।’ মানুষের মনের কথাই বলেছেন। এই ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের সভাপতির পদ থেকে দায়িত্ব শেষে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন। বাংলার বাণীর সহকারী সম্পাদকই ছিলেন না, বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও দৈনিকে কলাম লিখে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন একটি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হলেই গাড়ি ও বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে যান। ছাত্রলীগের একজন সাধারণ সম্পাদক ক্ষমতার ছায়ায় থেকে লন্ডনে বসতি গড়েছেন। এই বিষয়গুলো দলকে আজ উপলব্ধি করতে হবে।
একদিকে আদর্শের রাজনীতির অনুপস্থিতি, অন্যদিকে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, আরেকদিকে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ করে ছাত্র রাজনীতির সৃজনশীল নেতৃত্ব ও কর্মতৎপরতার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে যে বন্ধ্যাত্ব তৈরি হয়েছে, তাতে গোটা ছাত্ররাজনীতিই এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। অথচ সুষ্ঠুধারার দুয়ার খুলে দিলে দেশপ্রেমিক তরুণরা আদর্শবোধ নিয়ে অতীতের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে দিত। যে সংকট একদিনে তৈরি হয়নি, দিনে দিনে যে সংকট সমাজ জীবনে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে তার অবসানও একদিনে সম্ভব নয়। কিন্তু যেখানেই অন্যায়, যেখানেই বাড়াবাড়ি, যেখানেই উন্মত্ততা, যেখানেই বেআইনি কর্মকাণ্ড সেখানেই কে কোন দল, সেটি বিবেচনায় না নিয়ে আইনের প্রয়োগ সকল অপরাধীর জন্য সমানভাবে কার্যকর করে দিলেই এটি কমে আসবে।
সরকারি দলের লোকজনের জন্য এক আইন, বিরুদ্ধ মতবাদীদের জন্য অন্য আইন; সমাজ জীবনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে না। ছাত্রলীগ নিয়মিত ছাত্রদের সংগঠনে পরিণত করতে হলে গঠণতন্ত্র অনুসারে পরিচালনা, নিয়মিত সম্মেলন ও টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে গেলেই সাংগঠনিক ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের নজির স্থাপন করতে হবে।
বদরুলের নৃশংসতায় মানুষের হৃদয়ই কেঁপে উঠেনি, যেন আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে। বুকে পাথর বেঁধে লজ্জ্বা, অপমান ও ঘৃণায় তার গর্ভধারিণী মা বলেছেন, ‘এমন কুলাঙ্গার আমার সন্তানের মা আমি নই, ওর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সমাজ জীবনে সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন; এর কার্যকরিতা প্রতিষ্ঠার সময় এখন। চারদিকে শত বদরুলের আবির্ভাব ঘটার আগেই এই দানবীয়তা রুখতে হলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আদর্শিক রাজনীতি, সুশাসন, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রয়োগ বড় প্রয়োজন।
প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যে তরুণ বা পুরুষ প্রতিহিংসায়, খুনির চেহারায় তরুণী বা নারীর ওপর পাশবিক আক্রমণ চালায়; সে কখনোই প্রেমিক হওয়া দূরে খাক, মানুষই হতে পারেনি। একজন প্রকৃত প্রেমিককে আগে মানুষ হতে হয়। তারপর প্রেমিক হতে হয়। প্রেম সাধনার মধ্য দিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকার জন্ম দেয়। বদরুলরা মানুষ হবার পাঠ পায়নি পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। অসুস্থ রাজনীতি, ইয়াবার মত ড্রাগের আগ্রাসন, অস্ত্র, সন্ত্রাস ও পেশীশক্তিনির্ভর নষ্ট রাজনীতির দাম্ভিক উন্নাসিকতা এদেরকে অন্ধকার পথে ঠেলে দিয়ে দানবে পরিণত করেছে। মানব হতে পারছে না। এরা হৃদয় দিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠ করলে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে খুনির চেহারায় আবির্ভূত হতো না। বিরহের যাতনাবোধ করতো। এরা কবি নজরুলকে পাঠ করতে শিখেনি। যদি শিখতো তাহলে হৃদয়ের গভীর আকুতি থেকে মন দিয়েই খাদিজা নার্গিসকে জয় করতে চাইতো। এরা কাহলিল জিব্রানের নাম শোনেনি; পাঠ করা তো দূরে থাক। যুক্তরাষ্ট্রে ঠাঁই নেয়া লেবানিস এ কবি কাহলিল জিব্রান যার সঙ্গে প্রেমে বাধা পড়েছিলেন আমৃত্যু তার দর্শন পাননি। চীনের কবি লি পাই জোছনা রাতে নদীর জলে প্রেয়সীর মুখ দেখতে দেখতে ঝাঁপ দিয়ে সলীল সমাধি বরণ করেছেন।
বদরুলরা প্রেমিক হতে পারেনি, মানুষ হতে পারেনি। এর দায়ও রাষ্ট্র-সমাজ এড়িয়ে যেতে পারে না। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির জন্য এ প্রবল ঝাঁকুনি। তার মানে এই নয়, এমন নৃশংসতার পর বদরুল আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবে। কয়েকদিন পর ধীরে ধীরে তনু হত্যার মতো খাদিজা নার্গিসের ওপর সংগঠিত নৃশংসতার প্রতিবাদ স্তিমিত হয়ে আসবে। প্রভাবশালীদের কেউ কেই আইনের ফাঁক গলে বদরুলকে বের করে সমাজে সন্ত্রাসের মুকুট পড়িয়ে আরো বেশি দানবীয় রূপে আবির্ভূত করবেন। এই জানোয়ারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এ কারণেই হওয়া প্রয়োজন, যাতে আর কোনো প্রেমিকের বেশে দানবের আর্বিভাব না ঘটে।
থাদিজার প্রবাসী বাবা-ভাই ফিরে এসেছেন। দাবি করছেন, দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। সেটিই এখন মানুষের প্রত্যাশা। সুস্থ হয়ে খাদিজা ফিরে আসুক তার স্বপ্নের জীবনে। তার প্রতি বাংলাদেশের হৃদয় যেভাবে জেগেছে, মানুষ যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে তা থেকে সকলের উপলব্ধি প্রয়োজন, মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল, আছে এবং থাকবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন