|
পীর হাবিবুর রহমান
|
|
বিশ্বাসঘাতকতার দৃশ্য বঙ্গবন্ধু দেখেননি, শেখ হাসিনা দেখেছেন
02 September 2016, Friday
বিশ্বাসঘাতকতার বীভৎস দৃশ্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখে যাননি। দেখার সুযোগ হয়েছে মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার। দেখেছেন তার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সেনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পথে পরিবার পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যা করার পর বিশ্বাসঘাতকতার টুপি পরে ইতিহাসের কলঙ্কিত মীরজাফর ও অন্যতম রাজনৈতিক সহচর মোশতাক কিভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে খুনিদের সঙ্গে আঁতাত করে রাষ্ট্রপতি হয়ে বঙ্গভবনে বসেছিলো। কিভাবে দলের একটি অংশ খুনিদের সঙ্গে, মীরজাফর, মোশতাকদের সঙ্গে বঙ্গভবনে শপথ নিয়েছিলো। কিভাবে মহানায়কের লাশ ধানমন্ডির বাড়িতে অবহেলা অনাদরে ফেলে রেখে শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হয়েছিল। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের ঠিকানা তখনো রক্তাক্ত নিথর দেহ পরে আছে সিঁড়িতে। আর এদিকে খুনি মোশতাক বিশ্বাসঘাতকতার রক্তের সিঁড়িপথে কিভাবে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সতীর্থদের, কর্মীদের নিয়েই ক্ষমতায় আরোহণ করলো তা আর দেখে যেতে পারলেননা।
দেখে যেতে পারলেন না বারবার টেলিফোন করার পরও সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ থেকে সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিভাবে ব্যর্থ হলেন। কিভাবে খুনীচক্রকে প্রতিরোধের বদলে উল্টো তাদের প্রতি আনুগত্যের নির্লজ্জতার চিত্র। দেখে যেতে পারেননি কিভাবে দলের কর্মীরা দিশেহারা বিভ্রান্ত স্তম্ভিত হলেও নেতাদের কাছ থেকে কোন প্রতিবাদ প্রতিরোধের ডাক এলোনা। রাজনৈতিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা রক্ষীবাহিনীকে যেমন নির্দেশ দানে ব্যর্থ হয়ে কাপুরুষের মতোন নির্যাতন ভোগ করলেন, গ্রেফতার হলেন, তেমনি নেতৃত্বহীন এ বাহিনী এক পর্যায়ে আত্মসমর্পণ করলো। রাজনৈতিক কর্মীরা কেউ গেলো সশস্ত্র প্রতিবাদ যুদ্ধে। আর কেউ গোপনে সংগঠিত হতে। বড় অংশই জেল নির্যাতনের যন্ত্রণা ভোগ করলেন। আপসহীনরা জেল হত্যার শিকার হলেন। দীর্ঘদিন কারাভোগ করলেন। দেশের বাইরে থাকায় এইসব দৃশ্য কেবল জানতে আর দেখতে পারলেন বুকে পাথর বেঁধে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা। বাকরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও কষ্ট বুকে নিয়ে গোটা পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড সয়ে, কোন বিচার চাওয়া-পাওয়া দূরে থাক জীবন যৌবন উৎসর্গ করা সংগ্রামে জেল জুলুম ফাঁসির মঞ্চ আলিঙ্গন করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা মুছে ফেলার নির্লজ্জ চেষ্টা। তারা দেখলেন যারা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে থাকতেন। যারা একজন উদার গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী নেতাকে দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাকশাল করে দলের সাইনবোর্ড খুলে বিলীন হয়েছিলেন। সেই বামরা ও সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের খালকাটা বিপ্লবে শরীক হয়ে গেলেন। কোদাল হাতে নেমে গেলেন ফৌজি-শাসকদের সঙ্গে।
তারা আরও দেখলেন, স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দলের যারা দুর্নীতি, ক্ষমতার দম্ভে উন্নাসিক হয়েছিলেন তারা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে একক রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত আওয়ামী লীগকে কতটা জনবিচ্ছিন্ন করেছেন। কতটা জনপ্রিয়তার শেষ তলানিতে নিয়ে গেছেন। আদর্শবান নেতা-কর্মীরা সংগঠিত হলেও নেতৃত্বের কোন্দলেই দল ব্রাকেটবন্দি। ভাঙনে কবলিত। জনগণকে সঙ্গে আনতে পারছেন নেতারা। এমনি পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ইডেন কাউন্সিলে ভারতে নির্বাসিত শেখ হাসিনা দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরে গণতন্ত্রের সংগ্রাম শুরু করলেন। দীর্ঘ সংগ্রামে তাকে বহুবার জীবনের ঝুঁকির মুখে পরতে হয়েছে। মৃত্যুভয়কে ভয় করে হাঁটা সংগ্রামে তিনি দলের নেতা-কর্মীদের তার সঙ্গে সংগঠিত করে ঐক্যের রাজনীতির সংগ্রামের পথে আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় করে গণরায় নিয়ে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আনেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে তার কর্মীদের ওপর যে হামলা, মামলা, জেল নির্যাতন নেমে আসে তা তিনি একাই সামলে নেন। কর্মীদের সাহায্যে সাবেক মন্ত্রীরা নন, তিনিই এগিয়ে আসেন। এক সময় তাকে খতম করে দিতে একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাও চালানো হয়। তবু তিনি দমে যাননি। বাম ঘরণার দলগুলো নিয়ে ১৪ দল ও এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে রেখে মহাজোট গঠনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের পথে ১/১১র বিপর্যয়, জেল, নির্বাসনের পাঠানোর চেষ্টাসহ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসেন আওয়ামী লীগ ও শরীকদের। বঙ্গবন্ধুর খুনী আর একাত্তরের মনবতা বিরোধী অপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলান।
১/১১এর চ্যালেঞ্জটা শেখ হাসিনাকে এককভাবেই নিতে হয়। দলের সিনিয়র নেতারা এবং তার কাছে রাখা বিশ্বস্তদের অনেকেই তখন তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে নানা তৎপরতা ও বৈঠক শুরু করন। কঠিন বিপর্যয়ের মুখে দলের অভ্যন্তর থেকে সেনা সমর্থিত ১/১১ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে সংস্কারের নামে কার্যত দল ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করে দেওয়ার মতো ফর্মুলা বা প্রস্তাবনা দেন। শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে নির্বাচনের দাবিকে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তারা নাকচ করে দিতে সক্ষম হন।
এমনকি তাকে কারাগারে নেওয়ার পর দলের সিনিয়র নেতারা প্রায় প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেন, তাকে রেখে সংস্কার সম্ভব নয়। কারাগারে যাবার আগে দলের প্রবীন নেতা জিল্লুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হলে তিনি কর্মী-সমর্থকদের ওপর ভর করে হাল ধরেন। কিন্তু সিনিয়র নেতাদের তিন জন যে সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করেন তাতে দলের সভাপতি পদে দুই বারের বেশি কেউ নির্বাচিত হতে পারবেন না। সরকার প্রধানও দু’বারের বেশি নয়। এমন সব বিধান প্রণয়নের প্রস্তাব আনেন। দলের ওয়ার্কিং কমিটির অনেক নেতাই এর সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। বিএনপির একগুঁয়েমির পথে এক তরফা নির্বাচনে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের লগি বৈঠা সহিংস অবরোধে দেশ কার্যত অচল হয়ে যাওয়ায় ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করে দেশে জরুরী অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে আন্তর্জাতিক শক্তি জড়িত ছিল। কুটনৈতিক তৎপরতার মুখেই এটি ঘটে।
দেশের মানুষ সে সময় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেও তাদের ভ্রান্ত নীতি, রাজনীতিবিদ ব্যবসায়ীদের ওপর ব্যপক হারে দমন নির্যাতন, দেশব্যাপী পাকড়াও ও উচ্ছেদ অভিযান এবং কারও কারও বাড়াবাড়ি জনসমর্থন হারিয়েই ফেলেনি বিএনপির একটি বড় অংশ সুসংগঠিত ভাবে ওই সরকারের সঙ্গে আঁতাতের সংস্কারে ঢেও তুললেও আওয়ামী লীগের নেতারা বড় ধরণের ঝাঁকুনি খান। কারাবন্দী শেখ হাসিনা দলের অভ্যন্তরে নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতার রূপ নিজ চোখে দেখতে পান, শুনতে পান। এমনকি যতোদূর জানা যায় সেই সরকারের লোকজনের সঙ্গে দলের নেতারা যেসব কথাবার্তা বলেছিলেন মুক্তির আগে তাও শেখ হাসিনার হাতে চলে আসে। মুক্তি লাভের মধ্য দিয়ে নির্বাচনে দল ও সরকারের নেতৃত্বে আসার পথ রুদ্ধ করতে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনকারী নেতাদের এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকা অনেককেই তিনি মনোনয়ন দেন। তিনি বলেন, ক্ষমা করে দিলেও তাদের কর্মকাণ্ড ভুলেননি।
এমনকি দলের প্রেসিডিয়াম ও ওয়ার্কিং কমিটি থেকে এদের বড় অংশকেই বাদ দেন। ২০০৮ সালের সেই নির্বাচনে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনকারী ও এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দানকারী নেতাদের অনেককে সংসদে ও মন্ত্রীসভায় ঠাই দেওয়া হলেও অধ্যাপক আবু সাঈদ, মুকুল বোস, সুলতান মো. মনসুর আহমদ, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ অনেককে মনোনয়ন বঞ্চিতই করা হয়নি দলেও ঠাই দেওয়া হয়নি!
এমনকি সংস্কারের নামে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে ওই সরকারের সঙ্গে গভীর আঁতাতে লিপ্ত নেতাদের জেনে শুনে মন্ত্রীসভায় ঠাই দেওয়া হলেও সেই সময়ে কারা নির্যাতিত মরহুম আব্দুল জলিলকে করুণভাবে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বিদায় করা হয়। মন্ত্রীতো করা হয় নি দলেও সম্মানজনক পদ দেওয়া হয়নি। এমনিভাবে সেই সময়ে কারা নির্যাতিত শেখ ফজলুল করিম সেলিমকেও মন্ত্রীসভায় জায়গা দেওয়া হয়নি। এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ক্ষীণ প্রশ্নের রেখা জাগিয়ে রেখেছে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংস্কারের নামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা সংসদ ও মন্ত্রীসভায় ঠাই পেলেও অনুসারীরা কেন দলে বা সংসদে ঠাই পাননি, সেই রহস্য এখনও অমীমাংসিত। হয়তো কারণটি শেখ হাসিনা নিজেই জানেন। যা অদূর ভবিষ্যতে তিনিই জানাতে পারেন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট মানব সভ্যতার ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে পরিবার পরিজনসহ নিহত হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেনে যাননি কারা তার রক্তের ওপর বিশ্বাসঘাতকতা করে অবৈধ ক্ষমতায় বসেছিলেন। কিন্তু ১/১১র চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিজয়ী হওয়ায় শেখ হাসিনা দেখলেন দলীয় রাজনীতির বিশ্বাসঘাতকতার রূপ। কিভাবে, কারা তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে সংস্কারের নামে রাজনীতি থেকেই বিদায় জানাতে চেয়েছিলেন। ১/১১ কারা, কেন এনেছিলেন, কেনইবা রাজনৈতিক শক্তিকে অবিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতার রোডম্যাপে ফেলে দুর্বল করেছেন। কেনইবা বড় দলগুলোকে আস্থা, বিশ্বাস ও গণতন্ত্রের সংকট বাড়িয়ে দেশের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে রিমান্ড নির্যাতন জেলই নয় অনেককে নির্বাচনে পাঠিয়েও দুর্নীতির বরপুত্র বানিয়েছিলেন? ইতিহাস একদিন সকল সত্যকেই উন্মোচিত করবে। বঙ্গবন্ধু দেখে যাননি, কারা কাদের দিয়ে তাকে হত্যা করে কাদের বসিয়েছিল ক্ষমতায়। শেখ হাসিনা বেঁচে ও জিতে গিয়ে দেখেছেন কারা কাদের দিয়ে তাকে সরিয়ে কাদের বসাতে চেয়েছিল। এমন গুঞ্জনও আছে, সেদিন শেখ হাসিনার জন্য মায়া কান্না করে যারা জিল্লুর রহমানের পাশে দাঁড়াতেন তাদের কেউ কেউ স্বপ্ন দেখেছিলেন শেখ হাসিনা মাইনাস হলে তারাই হবেন ক্ষমতাধর। অদূর ভবিষ্যৎ নিশ্চয় অমীমাংসিত সকল সত্য উদ্ঘাটন করবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন