মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতির শোকাবহ ১৫ আগস্ট সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যে আকুতি জানিয়েছেন তা আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে। আমি গভীরভাবে তার আকুতি কান পেতে শুনেছি। মনে হয়েছে টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মার ক্রন্দন সৈয়দ আশরাফের হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত হয়েছে।
গত মঙ্গলবার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সেচ্ছাসেবক লীগের আলোচনা সভায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেই পরিবেশ আবার সৃষ্টি না করার জন্য নেতাকর্মীদের ‘খাই খাই স্বভাব’ ছাড়তে হবে। খাই খাই করা, দল ও প্রধানমন্ত্রীকে খাটো করার স্বভাব ছাড়ার জন্য দলের নেতাকর্মীদের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেছেন, আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, ক্ষমতার স্বাদ ভবিষ্যতেও পাবেন। কিন্তু এই যে খাই খাই করা, দলকে খাটো করা, প্রধানমন্ত্রীকে খাটো করা, নিজেকে খাটো করা, –এই অভ্যাসগুলো ছাড়তে হবে।
সৈয়দ আশরাফ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল বলেই তাকে হত্যার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত হন, দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, নেতাকর্মীরা যেন এমন পরিবেশ সৃষ্টি না করেন। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, অনেক দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মত স্ত্রী-সন্তানসহ নির্বংশ করে দেওয়ার হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি। ৭৫ সালের ঘটনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সৈয়দ আশরাফ বলেন, আমরা বাঙালি জাতি কি ওই সময় ছিলাম না? বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা ছিল না? আমাদের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী কি ছিল না? আমাদের রাজনৈতিক দল ছিল না? ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ছিল না? সবাই কোথায় ছিলেন? এই ঘটনা ঘটতে পারে তা কি আন্দাজ করা যায় নি? গোয়েন্দা সংস্থাই বা কি করল? এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারত, তারা তথ্য নিতে পারত, নেয়নি। এটা গোয়েন্দা সংস্থা জানে না, পুলিশ জানে না, দেশের মানুষেরা জেনেছে। –এটা তো হাতে পারে না! আমি মনে করি, এর পেছনে একটা গভীর ষড়যন্ত্র আছে। তিনি এখানো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তি তৎতপর রয়েছে এই তথ্য জানিয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার, ঐক্যে থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, যখন আমাদের মধ্যে শৃঙ্খলা থাকে না, যখন আমরা আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখি না, তখনই কেবল এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি পরিষ্কার বলেন, আমি কোন দল, সংগঠন কিংবা গ্রুপকে ইঙ্গিত করে কথাগুলো বলছি না। আমি আপনাদের উদ্দেশ্য করেই বলছি।
আমাদের কি ১৫ আগস্ট ব্যর্থতা ছিল না? এতো বড় একটা দল আমরা তো বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারিনি। যদি আবার এ ধরনের ঘটনা ঘটে আমরা কি পারব? দ্বিতীয়বার এ ধরনের ঘটনার জন্য আমরা প্রস্তুত? আমার তো মনে হয় না। দল ক্ষমতায় থাকলে কিছু হবে না। ১৯৭৫ সালেও তো দল ক্ষমতায় ছিল। রক্ষা করতে পারছে ক্ষমতা? সুতরাং এখানে আমি আপনাদের আর একটু সজাগ থাকতে বলব। এখন আরেকটু সতর্ক হতে হবে। সৈয়দ আশরাফ তার বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে এবং অনুধাবন করতে কর্মীদের প্রতি গভীর আকুতি জানিয়েছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে আপনার দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে একটি অন্ধকার শক্তি সব সময় সক্রিয়। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও ৭১-এর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িতদের বিচার ও ফাঁসি কার্যকর করার মধ্যে দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে একটি রাজনৈতিক শক্তিকেই বিক্ষুব্দ করেননি। ৭১-এর পরাজিত পাকিস্তান ও তাদের মিত্র শক্তি তুরস্কের মত কিছু দেশের আত্মা আর্তনাদ করে ওঠেছে। বিশ্ব নন্দিত জাতীয়তাবাদী আন্দলোনের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসাবে আপনিও আপন মহিমায় বিশ্ব পরাশক্তির চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশকে উন্নয়নের নতুন যাত্রাপথের সন্ধান দিয়েছেন।
৮১ সালে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে সেনাশাসন কবলিত অন্ধকার সময়ে আপনি গণতন্ত্রের কুপি জ্বালিয়ে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, সেখানে বিপর্যয়ে পতিত আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবেই দাঁড় কারননি, দীর্ঘ ২১ বছর পর দুবার গণরায়ে একবার সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এনেছেন। কখনো ২১শের গ্রেনেড হামলা, কখনো পুলিশের গুলি বর্ষণ, কখনো অবরুদ্ধ, কখনো কারাজীবন, কখনো বা ব্যর্থ অভূত্থান চেষ্টার ষড়যন্ত্রের জাল চিন্ন করে দলের ভেতর-বাইরে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এগিয়ে চলছেন। আপনিসহ সবাই উপলব্দি করছেন, তাড়া করা বুলেট নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে আপনার রাজনৈতিক সাফল্য-ব্যর্থতা প্রশংসা-সমালোচনা ছড়ানো পথ অতিক্রম করছেন। দলের অভ্যন্তরে যারা আপনাকে মাইনাস করতে চেয়েছেন। দলের বাইরে যারা আপনার প্রাণনাশ করতে চেয়েছেন, তাদের অনেকেই আপনার করুণাশ্রিত ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ভোগ করছেন। আপনার রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে আপনার বড় অর্জন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের একক নেতৃত্ব হিসবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই অর্জনের নেপথ্যে আপনার প্রতি কর্মী-সমর্থকদের নি:শর্ত আস্থা, অকুণ্ঠ ভালবাসা, আবেগ যেমন শক্তি হয়ে কাজ করেছে, তেমনি মুজিব সরকারকে উৎখাত করা থেকে ৭৫ উত্তরকালেও বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী যে ছোট শক্তি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তাদের আস্থাও অর্জন করেছেন। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক ধারায় ধরে রাখতে আপনি যে শক্তিমান নেতৃত্ব সেটি বিশ্বের সন্ত্রাস বিরোধী গণতান্ত্রিক দুনিয়ার নেতৃত্বের সামনে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে যেভাবে দুর্বল করা হয়েছে, যেভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নড়বড়ে হয়েছে, জঙ্গিবাদের তৎতপরতা বেড়েছে, তাতে করে মানুষের মধ্যে একটা গুমোট অস্থিরতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে সারাদেশে সরকারি দলের সমন্বয়হীনতা, একাংশের উন্মাষিকতা রাতারাতি বিত্ত-বৈভব, গাড়ি-বাড়ি, ভোগ বিলাসি জীবনের উন্মত্ত নেশা, প্রশাসনকে ব্যবহার করা, সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করছে।
দেশের শেয়ার কেলেঙ্কারীর নায়কদের বিচার হয়নি। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অবৈধভাবে যারা দেশের বাইরে অর্থ পাচার করেছে, সম্পদ গড়েছে তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর কারণে আশার আলো জেগেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার প্রধান হিসাবে আপনার দল আওয়ামী লীগ যতটা বঙ্গবন্ধু ও আপনার নির্দেশিত মানব কল্যাণের ত্যাগবাদী আদর্শিক রাজনৈতিক ধারায় চলার কথা, তার থেকে অনেক বেশি বিচ্যুত এবং অসংগঠিত। আপনার অন্তরাত্মার ডাক শুনলেই জানতে পারবেন আপনার সরকারের কোন মন্ত্রি-আমলা, সরকারি কর্মকর্তা এবং দলের কোন এমপি, নেতা সৈয়দ আশরাফের ভাষায় খাই খাই স্বভাবে নিমজ্জিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্লোভ সততার রাজনীতির পাশে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম যেমন সততার ইমেজ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমনি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কতটা সফল তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার সততা দলের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে নূন্যতম প্রশ্ন কারো মধ্যে নেই। সৈয়দ আশরাফ যে আকুতি জানিয়েছেন, সেই আকুতি আওয়ামী লীগের লাখো লাখো নিবেদিত প্রাণ নেতাকর্মীর মনের আকুতি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পেশাদারিত্বের কারণে ক্ষমতার চারদেয়ালের ভেতর আমাদের বিচরণ সীমাবদ্দ নয়। প্রান্তিক থেকে উঠে আসা মানুষ হিসেবে নানা-শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করি। নিয়মিত গ্রামের বাড়ি যাই। আজ এই জেলায় তো কাল ওই জেলায় ঘুরি। বিদেশ গেলে প্রবাসীদের আতিথেয়তাও গ্রহণ করি। আপনি জানেন স্বাধীতা সংগ্রামের পথ হাঁটা বঙ্গবন্ধু জনগণের ঐক্য গড়েছিলেন বলেই, একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে আস্থা অর্জন করেছিলেন বলেই সামন্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বশীল মুসলীম লীগ আর পড়াশুনা করা উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বশীল, মস্কোপন্থি ন্যাপসহ বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটিয়েছিলেন তার নিজস্ব ইমেজের ওপর ভর করে। সাধারণ পরিবার থেকে ওঠে আসা স্কুল মাস্টার থেকে উকিল-মোক্তারদের ৭০ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দিলে তারা বঙ্গবন্ধুর ইমেজের ওপর জয়লাভ করে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সেই সব অনন্য সাধারণ সংগঠকরা প্রায় সবাই আমৃত্যু নির্লোভ সততার পথ হেঁটেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকেও বিচ্যুত হননি।
জন্মের শহর সুনাগঞ্জের রাজনৈতিক ঐতিহ্য সততা ও সম্প্রীতির। অতি সাধারণ পরিবারের একজন মানুষ থেকে থানার পুলিশ অফিসে ডায়েরি লেখার চাকরি করে উকিল হয়ে শহরে আসা যে ব্যক্তিটিকে বঙ্গবন্ধু মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদের কারণে দলের নেতৃত্ব ও ৭০-এর নির্বাচনে প্রাদেশিক সদস্য করেছিলেন তিনি সারা জীবনই সততার রাজনীতি করে ভদ্র বিনয়ী আচরণে মানুষের সম্মান কুড়িয়েছেন। তারই এক সন্তানকে সুনামগঞ্জের রাজনীতিতে আকস্মিক নেতা বানিয়ে পাঠালে দলের তৃণমূল আওয়ামী লীগই বিক্ষুব্দ ও ভিবক্ত হয়নি, দিন দুপরে সুনামগঞ্জে বিদুতের সাবস্টেশন বসাতে গিয়ে আপনার সরকার ৬ কোটি টাকায় যে জমি অধিগ্রহণ করেছে সেখানে ৫ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে জনমনে রয়েছে। দল ও মানুষের মধ্যে নিজের অবস্থান সুসংহৃত না করলেও সৎপিতার এই অসৎ সন্তান হাট-মাঠ-ঘাট, পাথর মহাল থেকে আদালতপাড়ায় তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে ঢাকা ও লন্ডনে বিত্ত-বৈভব গড়েছে।
আর কর্মীরা বলছে ঝাঁক দিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায়, নেতা বানানো যায় না। আপনি আপনার গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে বা আপনার নিজস্ব সোর্স কাজে লাগিয়ে অতীতে যেমন প্রার্থীদের ব্যাপারে খোঁজ নিতেন, তেমনি তদন্ত করলে দেখতে পাবেন একেকটি জেলায় কারা সৈয়দ আশরাফের ভাষায় খাই খাই স্বভাবের উন্মত্ত হয়ে আপনার সরকার ও দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একেকটি জেলায় দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠরাই বঙ্গবন্ধু ও আপনাকে ভালবেসে নিস্বার্থভাবে দল করে। মুষ্টিমেয় চেনা কয়েকটি মুখ জেলায় জেলায় দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কোন্দল, টেন্ডারবাজি, মনোনয়ন বাণিজ্যের দুর্গন্ধ গায়ে মেখে পথ হাঁটছে। আপনার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য নিয়ে আপনি কার্যকর পদক্ষেপ নিলে গণমুখী আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক দলটিকে এখনো আদর্শিক নেতৃত্ব নির্ভর সুশৃঙ্খল সংগঠনে পরিণত করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে খানিকটা হলেও শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে দলের অভ্যন্তরে গণবিচ্ছিন্ন বিতর্কিতদের তৃণমূল নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধু আমার নেতা, মানুষ আমার দল। পেশাদারিত্বের জায়গায় রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে যখন সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভাল করেন, তখন বাহবা দেই। যখন খারাপ করেন সমালোচনা করি। কোন ব্যক্তি বা দলের আনুগত্য নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করি।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যর পর বঙ্গন্ধুর শাসনামলের শেষ দিকে দলের উন্মাষিক নেতাকর্মীদের প্রতি পিতৃতূল্য হৃদয় নিয়ে যে আকুতি বার বার জানিয়েছেন, তা আমার বার বার মনে পড়ছে।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও তার ভাষণগুলো নিয়মিত পাঠ করে আমি যখন আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকাই তখন অসহায়ত্ববোধ করে হতশায় ভুগি। বঙ্গবন্ধু বার বার বলেছেন, আমি ফাঁসির দঁড়ি নিয়েছি, প্রধানমন্ত্রীত্ব নেইনি। বাংলাদেশের এমন কোন মহকুমা নেই, বাংলাদেশের এমন কোন থানা নেই, বাংলাদেশের এমন কোন জমি নেই, যার পথে আমি একদিনের জন্যও আন্দোলন করি নাই। আমার জীবন আর যৌবন কারাগারে দিয়ে দিয়েছি বাংলার মানুষের জন্য।
১৯৭৪ সালের ১৮ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলে দলের সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়ে বলেছেন, কোনদিন স্বার্থে অন্ধ হয়ে তোমাদের ডাক দেই নাই। কোনদিন লোভে অন্ধ হয়ে কোন শয়তানের কাছে মাথা নত করি নাই। কোনদিন ফাঁসির কাষ্ঠে বসেও বাংলার মানুষের সঙ্গে বেঈমানি করি নাই। আমি বিশ্বাস করি তোমরা আমার কথা শুনবা, তোমরা আত্মসমালোচনা কর, আত্মসংযম কর, তোমরা আত্মশুদ্ধি কর। দুই-চার-পাঁচজন অন্যায় করে, যার জন্য এতবড় প্রতিষ্ঠান– যে প্রতিষ্ঠান ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, যে প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা এনেছে, যে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ কর্মী জীবন দিয়েছে, যে প্রতিষ্ঠান ২৫ বছর ধরে ঐতিহাসিক সংগ্রাম করেছে– তার বদনাম হতে দেয়া যায় না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সেই কত বছর আগে ৭৪ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি যুব লীগের কংগ্রেসে তিনি গ্রামে গ্রামে গণআন্দোলন সৃষ্টি করার ডাক দেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে, স্মার্গলিংয়ের বিরুদ্ধে, বিদেশে অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে, বিদেশী এজেন্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেন। ৭৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রক্ষীবাহিনীর শিক্ষা সমাপনী ভাষণে তিনি বলেন, তোমরা কোন নিরাপরাধীর অত্যাচার করো না। দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থেকো। যেখানে যাবে মানুষকে ভালবাসবে। অন্যায়-অবিচার কঠোরভাবে দমন করবে। চোরাকারবারী, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ দেশের মানুষকে আজ অত্যাচার করছে। আমি এদেরে উৎখাত করতে চাই। আমার কথায় তোমরা জীবন দিয়েছো, সংগ্রাম করেছো, যুদ্ধ করেছো, হাঁসিমুখে মৃত্যুবরণ করেছো। তোমাদের কাছে আমার আদেশ রইল, হুকুম রইল, খবরদার অন্যায় করবে না, মুখ আমার উজ্জল করিও। দেশের মুখ উজ্জল করিও মানুষ তোমাদের ভালবাসবে।
বঙ্গবন্ধু পুলিশের সভায় বলেছেন, তোমরা ভাড়া করা বাহিনী নও দেশের সন্তান, সৎ থাকবে জুলুম করবে না। মানুষ যেন ভালবাসে, সম্মান করে, ভয় করে না। এমন কোন সভা নেই যেখানে তিনি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, দুর্নীতির বিরেুদ্ধে যুদ্ধ করতে, তিনি সঙ্গে আছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিও বিভিন্ন সভায় বলে থাকেন ভোগ-বিলাসের জীবন বিত্ত-বৈভব গড়ার নেশা দিয়ে মানুষের কল্যাণের রাজনীতি হয় না। আমার প্রশ্ন বঙ্গবন্ধুর নামে রাজনীতি করে, বঙ্গবন্ধুর নামে গরীবের দল আওয়ামী লীগ করে, দুর্নীতি ও চাঁদার টাকায় দেশ-বিদেশে কারা বিলাসী জীবন-যাপন করেন, বিত্ত-বৈভব গড়েন। তাদের খবর আপনার জানা থাকার কথা। যাদের খবর জানেন না, তাদের খবর নিতে আপনার একদিন সময় লাগবে।
সৈয়দ আশরাফের ভাষায় খাই খাই স্বভাবের উন্মাষিকদের হাত থেকে গণমুখী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে বের করলে আদর্শিক নেতকর্মীরাই সংগঠনকে শক্তিশালী করবে এবং রাজনীতির দূরে থাকা মানুষের ও নতুন প্রজন্মের সমর্থন পাবে। আশরাফ যথাযর্থই বলেছেন, ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকল সামরিক ও বেসামরিক শক্তির সঙ্গে জাতীয় বিপর্যয় প্রতিরোধে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্বও ব্যর্থ হয়েছে। ওয়ান ইলেভেনের বিপর্যয়ের চ্যালেঞ্জ আপনাকে একা মোকাবেলা করেই দলকে ক্ষমতায় আনতে হয়েছে। আজকে যারা খাই খাই স্বভাবের উন্মাষিক তারা ভুলেও ভাবেন না, আপনি কিভাবে ৫ই জানুয়ারির সংকট মোকাবেলা করে দলকে ক্ষমতায় এনেছেন। ক্ষমতার ইতিহাসটাই এমন, মসনদে থাকলেই চারদিকে যতদূর তাকানো যায় শুধু নিজের লোক সমর্থক দেখা যায়। যেন শাসক দল ছাড়া কোন দলই খুঁজে পাওয়া যায় না। ক্ষমতায় না থাকলে যতদূর চোখ যায় ধূ-ধূ বালুচর সবকিছু শূণ্য-ফাঁকা। ইতিহাসের অনেক উত্থান-পতন দেখে এমন অভিজ্ঞতার তালিম আজকের রাজনীতিতে আপনার চেয়ে বেশি কেউ অর্জন করেননি।
লেখক, প্রধান সম্পদক: পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন