কারাগার যতোই সুরম্য হোক সে এক বন্দিশালা।তার ভেতরে যতোই ডিভিশন দেয়া হোক, ফুলের বাগান, তাসের আড্ডা, বাড়ির পাঠানো খাবার, কিংবা ছবি দেখা ও বই পড়ার সুযোগ ঘটুক না কেন, কোনো নাগরিকের জন্যই সেটি সুখের নিবাস নয়। ফ্রি খাবার জুটলেও কার্যত সে এক শাস্তি নিবাস।
সমাজ বিরোধী, আইন বিরোধী, দুর্নীতিবাজ, চোর-ডাকাত, সন্ত্রাসী, খুনি, ধর্ষক, এক কথায় অপরাধীদের বাধ্যতামূলক মেহমানখানা, যেখানে কেউ যেতে চান না।
কারাগারে মর্যাদার নায়োকোচিত বাসিন্দারা হলেন রাজনীতিবিদ, যারা রাজনৈতিক কারণে কারাভোগ করেন। তারা মানুষের অধিকার আদায়, সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ড কিংবা বিপ্লব বা সমাজ পরিবর্তনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার সংগ্রাম করেন। কারারক্ষী মিয়াসাহেব থেকে জেলের দাগি কয়েদি ও কর্তাব্যক্তিরা সবাই তাকে সম্মান ও সমীহ করেন।
সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে রাজনীতি এতোটাই বন্ধা ও গতিপথহারা হয়েছে যে এখানে রাজনীতির অভিধান থেকে জননেতা, রাজবন্দি শব্দটি নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছে। যদিও রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতার কাছাকাছি বাস করে কারাগার। একদা কারাগার ছিলো গৌরবের। সেটি মহান স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের সুবর্ণকাল।
রোববার বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতু থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঢাকা মাওয়া সড়কের বাঁ পাশে কেরাণীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে নতুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার উদ্বোধন হয়েছে। উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা।
এটি উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারটি দুইশতাধিক বছরের কালের ইতিহাস হয়ে গেছে। ১৭৮৮ সালে ব্রিটিশ শাসকদের নির্মিত এই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হয়ে উঠেছে দীর্ঘ ইতিহাসের জীবন্তসাক্ষী।
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের কারানির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন এখানে রয়েছে। আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিবেদিত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, লেখক, ছাত্রনেতাদের বারবার এখানে যেতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের বারবার গ্রেফতার করে এখানেই রাখা হয় মাসের পরমাস। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই কেবল করাচিতে ছয়মাস বিশ দিন জেল খেটেছেন। জেলখানাই ছিলো বঙ্গবন্ধুর জন্য স্থায়ী ঠিকানা। এছাড়াও মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানি, টাঙ্গাইলের শামসুল হক, বাম রাজনীতির প্রাণপুরুষ কমরেড মণি সিং, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী এই কারাগারে বন্দিদশা কাটিয়েছেন। সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া দীর্ঘ কারাভোগের পর মুক্ত হয়ে অকালেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের বীর উত্তমের সামরিক শাসনের প্রহসনের বিচারে দেওয়া ফাঁসির রায় এখানেই কার্যকর হয়েছে। ষাটের ছাত্রনেতাদের প্রায় সবাই এখানে কারাভোগ করেছেন দিনের পরদিন। সামরিক শাসন কবলিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্য দেশের অন্যান্য কারাগারের সঙ্গে এই কেন্দ্রীয় কারাগারই দীর্ঘ ঠিকানা হয়েছিলো। পচাত্তর সালের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তিন নভেম্বর রাতের অন্ধকারে খুনিচক্র এই কারাগারেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলো সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করে।
আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের গৌরবময় স্মৃতিবিজড়িত কালের সাক্ষী হয়ে থাকা দুই শতাধিক বছরের পুরোনো নাজিম উদ্দিন রোডের কারাগারটি সরকার স্মৃতির যাদুঘরে পরিণত করছে। এই উদ্যোগের জন্য মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা সরকারকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।একই সঙ্গে ২ হাজার ৮শ’ ছাব্বিশজন বন্দির ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন পুরোনো সেকেলে এইকারাগারটিতে তিনগুণ বেশি কয়েদি রাখা হতো।যাছিলো বন্দির প্রতি অমানবিক ও কারাকর্তৃপক্ষের প্রতি বাড়তি চাপ। এই কারাগারের সাবেক ডিআইজি প্রিজন ছিলেন মেজর অব. শামসুল হায়দার চৌধুরী, একজন মিডিয়া বান্ধব কর্মকর্তা। অন্যদিকে ছিলেন কয়েদিদের প্রতি মানবিক। বাড়তি কয়েদি, স্বল্প সুযোগ-সুবিধার মধ্যে সবাইকে আনন্দে রাখতে কারাগারের ভেতরে গানের আসর বসিয়েছিলেন। এজন্য বিতর্কের মুখে তাকে বিদায় নিতে হয়েছিলো। এমবিবিএস মুন্না ভাই সিনেমা দর্শক নন্দিত হয়েছে। সিনেমাটি বার্তা ছিলো বিনোদনে রোগীর সুস্থতা। শামসুল হায়দার চৌধুরী বিনোদনে জেল কয়েদিদের স্বস্তি ও সুখে রাখতে চেয়েছেন।
কেরাণীগঞ্জের নতুন কারাগার সাড়ে ৪ হাজার বন্দি ধারণ ক্ষমতা রাখে। ১শ’ ৯৪ দশমিক ৪১ একর জমির ওপর নির্মিত কারাগারটির ব্যয় হয়েছে ৪শ’ ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কারাগারের ভবনগুলোর নাম নদী ও ফুলের নামে রাখা হয়েছে। পদ্মা, যমুনা, বকুল, শাপলা, করতোয়া, চম্পাকলির নামে। ভিআইপি বন্দিদের জন্য ষাটজনের একটি ভবন হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনকালে বলেছেন, এটি শুধু কারাগার নয়, এটি একটি শোধনাগারও।পাশে যতোই নদী থাকুক, কারাবাসীর হৃদয় তার কলোধ্বনি স্পর্শ করে না।ফুল ও নদীর নামে যতোই সুরম্যভবন থাক, সেখানে ফুলের সৌরভ চিত্ত প্রফুল্ল করে না। বন্দিশালায় মুক্তির আকুলতা নিয়ে বন্দিদের হৃদয় থাকে বিষাদগ্রস্ত। কারাগারের আরামের শয্যার চেয়ে মধুর মুক্ত মানুষের কাশবন, সবুজঘাস, পাখিরকুজন, ভাঙ্গাচালায় বসে দেখা শুক্লপক্ষের চাঁদের রূপ।
যতোই সুরম্য ভবন হোক সে এক বন্দিশিবির যেখানে বুক ভরে শ্বাস নিলে সুখ পাওয়া যায়না।বাইরে আকাশে বাধা দিগন্তে এক বিস্তীর্ণ মুক্তশিবির যেখানে বুক ভরে শ্বাস নেয় স্বাধীন মানুষ। কারাগারের সুরম্য ভবনে তিনবেলা পেট পুরে খাবারের চেয়ে বাইরে ভাঙা চালায় আধপেট খেয়ে থাকা অনেক সুখের। যতো সৃজনশীল, মেধাবী, দক্ষ হোক না কেন, অনেক রূপবতী নারীরই সব তলিয়ে যায় রূপের প্রশংসায়। রূপের দেমাগ কাউকে অন্ধ করে দেয়, শুনতে চায় চার দিকে তার রূপের প্রশংসা। তেমনি যতোই গণতন্ত্রের কথা বলুন না কেন, রাজনীতিবিদদের অনেকেও তেমনি সমালোচনা সইতে পারেন না। স্তুতিবাক্যে ডুবে অন্ধ মোসাহেবদের গুণকীর্তনে ভেতরে ভেতরে অহঙ্কারি হয়ে ওঠে। ক্ষমতার দম্ভে ভুলে যান মসনদ থেকে কাশিমপুর বাকেরাণীগঞ্জের কারাগার বেশি দূরে নয়। রাজনীতিবিদরাই বলেন, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন না।
ক্ষমতায় থাকলে অনেকের দম্ভ, উন্নাসিকতা, সমালোচনা সইতে না পারার ক্ষমতা বেড়ে যায়। ক্ষমতাচ্যুতির পর মামলায় মামলায় আদালত-কারাগার ঘুরে ঘুরে নিরীহ গণতন্ত্রীর চেহারা ধারণ করেন। ক্ষমতায় দাম্ভিক বিরোধীদলে বিনয়ী, এই চেহারার সঙ্গে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ক্ষমতায় থাকলে একের পর এক ভুল, বিরোধী দলে গেলে কথার ফুলঝুড়িতে স্বপ্নে ফেরিওয়ালা হয়ে ওঠেন। আমাদের রাজনৈতিক পূর্বসুরীদের রাজনৈতিক জীবন ছিলো মানুষের আস্থায় প্রস্ফুটিত শিশির ভেজা গোলাপের মতো সতেজ। মানবকল্যাণে আদর্শিক রাজনীতির পথ হেঁটে জনতার হৃদয়ে ঠাঁই নিয়ে রাজবন্দির খেতাব পড়ে কারাগারে যেতেন। মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ফুলের মালা গলায় দিয়ে বের হয়ে আসতেন সগৌরবে।
পাকিস্তানের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে আসা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে শাসক গোষ্ঠী সামান্য কিছু টাকার দুর্নীতির মামলা দিয়েছিল। বহুবার সোহরাওয়ার্দি শেখ মুজিবের জন্য আইনি লড়াই করেছেন। সেই মামলায় আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘মুজিব যদি করাপ্ট হন পৃথিবীর তাবত মানুষ করাপ্ট।’ এ কালের রাজনীতিবিদ হয়ে বড় বড় আইনজীবী লড়েন, কিন্তু এমন কথা বলতে পারেন না।
বঙ্গবন্ধুর মতো সেকালের রাজনীতিবিদদের অনেকের নির্লোভ, সাদামাটা ত্যাগী চরিত্র মানুষের মধ্যে ছিল পরিষ্কার। এ কালে অনেকের চরিত্রই ঝাপসা। কারো বা প্রশ্নবিদ্ধ। সেকালে রাজনীতি করতেন রাজনীতিবিদরা। এ কালে হাইব্রিডরা উড়ে এসে রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ক্ষমতাই নয়, বিত্ত-বৈভব গড়ার বাহনে পরিণত করেছেন। সেকালের রাজনীতিবিদরা একুশের গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র, গ্রেনেড বোমা সন্ত্রাসের ষড়যন্ত্রে জড়াতেন না।
এ কালে এইসব নৃশংস ও ষড়যন্ত্রের পথ হেঁটে রাজনীতির নিয়ন্ত্রকদের অনেকেই জেলে পচছেন, দিনেরপর দিন রিমান্ডে যাচ্ছেন। সেকালে রাজনীতিবিদদের ছায়ায় শেয়ার কেলেঙ্কারিও ব্যাংক লুটের মতো ঘটনা ঘটেনি। এ কালের রাজনীতি লুটেরাদের পাহারা দেয়, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। ভোগ-বিলাসের পথ হেঁটে হারায় মানুষের আস্থা- সম্মান। এক সময় রাজনীতি ছিল কর্মী ও জনগণনির্ভর। এ কালে হয়ে উঠেছে টাকা ও কর্মীনির্ভর।
প্রধানমন্ত্রীর পারিবারিক ঐতিহ্য ও দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতায় এই পথ পরিক্রমায় উত্থান পতনের দৃশ্য খুব কাছে থেকে দেখেছেন। নতুন কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতার সুর ধরে বলতেই পারি, কারাভোগী ও দণ্ডিতদের জন্য এই কারাগার আত্মবিশ্লেষণের পথে সংশোধনের। আর আমরা যারা বাইরে আছি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি তাদের জন্য আত্মসমালোচনা ও আত্মসংযমের পথে ক্ষমতার ভেতরে বাইরে এমনভাবে হাঁটা যাতে করে ওই কারাজীবন ভোগ করতে না হয়।
দিনে দিনে আদর্শিক ত্যাগবাদী রাজনীতিকে কলুষিতই করা হয়নি, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধারায় অসুস্থ রাজনীতির পথে মানুষের আস্থার জায়গাটি শেষ করে দিয়েছেন এক সময় তারা ছিলেন রাজনীতিবিদ, এখন এরা অনেকেই রাজনীতিজীবী। কারাগারের ভয়ে হলেও রাজনীতিবিদদেরকেই পূর্বসূরীদের উত্তরাধীকারিত্বের পথে চলমান এই অসুস্থ বৃত্ত ভাঙতে হবে। রাজনৈতিক কারণে কারাভোগ গৌরবের হলেও ব্যক্তিগত লাভের পাল্লায় চড়ে কারাগারে যাওয়া তো অমর্যাদাকর।
রাজনীতিবিদরা বলেন, সামরিক শাসকরা রাজনীতিকে নষ্ট করে গেছেন। সেটি সত্য হলেও ইতিহাসের দায়বদ্ধতায় আজকের বাস্তবতায় তা মেরামত ও সংস্কারের দায়িত্ব রাজনীতিবিদদেরকেই নিতে হবে।
সম্প্রতি এক খবরে জানা গেছে, পৃথিবীর একটি দেশে কয়েদির অভাবে কারাগার বন্ধ হয়ে গেছে। আসুন আয়নায় সবাই চেহারা দেখি। সংবিধান, আইন মেনে কারাগার থেকে দূরে থাকি।
প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডিডটকম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন