বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে কেন এই বিষোদগার?
11 July 2017, Tuesday
এক. ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু প্রমুখ সংসদ সদস্যরা বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে অনেকটা হুমকি-ধমকির সুরে বক্তব্য দেন। উচ্চ আদালতের কোনো রায় নিয়ে অনেকেরই দ্বিমত থাকতে পারে। তবে এ ব্যাপারে সংসদ সদস্যদের যুক্তিনির্ভর হওয়াই প্রাধান্য পাওয়া উচিত। কারো বিরুদ্ধে হুমকির সুরে কথা বলা কখনো কাক্সিক্ষত হতে পারে না। বিশেষ করে প্রসঙ্গটি যদি বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে হয়। সংসদ সদস্যদের অবশ্যই সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি মানার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
দুই. দেশের স্বার্থেই বিচার বিভাগ ও সংসদ- এ দুই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, বিচার বিভাগ ও সংসদের মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ দেখা দিলে তা হবে দেশের জন্য অশনিসঙ্কেত।
তিন. এমপিরা আইন প্রণয়ন করেন; অন্য দিকে আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের। ব্যাখ্যার নিরিখে বিচার বিচারকের। আইনপ্রণেতারা বিচারক হতে পারেন না। বিচারিক ক্ষমতা সংবিধান এমপিদের দেয়নি। অথচ আমাদের সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদের অজুহাতে আইনপ্রণেতারা সংসদে যা খুশি তাই বলতে পারেন না। সমানে বিচার বিভাগ ও বিচারপতিদের বিষয়ে কটাক্ষ করা সমীচীন হবে না।
এমপিরা তাদের বক্তব্যে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে নানা আকারে-প্রকারে হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছেন! কিন্তু বিচারকদের তো আর সে সুযোগ নেই। তারা আদালতের বাইরে একেবারেই বোবা! এজলাসে বসে তাদের গায়ের জোড়ে নয়, বরং প্রতিটি রায় দিতে হয় প্রচুর পড়াশোনা করে, নির্মোহ ও পক্ষপাতহীনভাবে।
চার. সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ২৭০(১) ও (৩) ধারা অনুযায়ী উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের প্রতি ব্যক্তিগত কটাক্ষ-সমতুল্য বক্তব্য দেয়া যাবে না। কিন্তু সরকারদলীয় এমপিরা বিচারপতিদের নাম নিয়ে বিষোদগার করেছেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন নিয়ে কটাক্ষ করেন। এটা সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এতে বিচার বিভাগ ও সংসদ দু’টিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পাঁচ. আজ সংসদে দাঁড়িয়ে আওয়ামী এমপিরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের জন্য জিয়াউর রহমানকে দায়ী করছেন। অথচ বিগত আওয়ামী সরকারের আমলেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী হয়েছে। এতে বিচারপতিদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাকে রাখা হয়। তখন কেন আওয়ামী লীগের এমপিরা মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন?
ছয়. আসলে আমাদের শাসন কাঠামো নিয়ে এমপি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা প্রায়ই গোলমাল বাধিয়ে ফেলেন। মূলত আমাদের সরকারের কাঠামো হচ্ছে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিনস্টার সিস্টেমের মতো। ইংল্যান্ডের সংসদ হচ্ছে সুপ্রিম। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে সুপ্রিম। সেখানে আদালত সংসদের যেকোনো আইনকে তদারক ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর বাংলাদেশে সরকারের কাঠামো হচ্ছে ওই দুই দেশের সংমিশ্রণ। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে এই প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এর বাইরেও আমাদের সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে আইন প্রণয়নের অন্যতম একটি উৎস।
ব্রিটিশ সংবিধানে সংসদের সুপ্রিমেসি রয়েছে। সংসদ সদস্যরা সেখানে যা খুশি তা-ই করতে পারেন। তবে ব্রিটিশ আদালত সংসদের কোনো আইন বাতিল বা অসাংবিধানিক বলতে পারেন না। কিন্তু আইনের ব্যাখ্যা করার ক্ষমতায়নের কারণে তারা সংসদের প্রণীত আইনের অবৈধ ও অবাস্তব উপাদানগুলো বাদ দিতে পারেন।
সাত. আমাদের উচ্চ আদালতের মতো অসাংবিধানিক আইন বাতিল করার অধিকার ব্রিটিশ কোর্টের নেই। আমাদের এখানে সংবিধানের সার্বভৌমত্ব রয়েছে, সংসদের নয়। এটি বুঝতে হবে। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী সংসদ যেকোনো আইনই প্রণয়ন করুক না কেন তা সংবিধান অনুযায়ী করতে হবে। ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এমপিদের যেকোনো প্রণীত আইন যদি সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে সেই আইন বাতিল হয়ে যাবে। আমাদের সুপ্রিম কোর্টকে জুডিশিয়াল রিভিউ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যাতে সংসদ কখনো সংবিধানকে টপকে যেতে না পারে।
আট. আমাদের সংবিধানের অভিভাবক হচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট যখন সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিমেসি ভোগ করছেন তখন কিন্তু রাষ্ট্রের একক অঙ্গ হিসেবে সেই ক্ষমতা ভোগ করছেন না। এ জায়গায় একটি সূক্ষ্ম ভুল বোঝাবুঝি আমাদের সবার মধ্যেই রয়েছে। ক্ষমতার পৃথকীকরণ নিয়ে ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু বলেছেন, ‘ক্ষমতা সব সময় একটি ভয়াবহ বিষয়, যা একটি স্বৈরশাসনের জন্ম দেয়। এ স্বৈরতন্ত্রকে ঠেকানোর জন্যই রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। এ ক্ষমতার ভারসাম্য সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।’ মন্টেস্কু আরো বলছেন, “এ তিনটি অঙ্গের মধ্যে যেকোনো দু’টি অঙ্গের ক্ষমতা যদি একজনের কাছে চলে যায়, তাহলে ভয়াবহ বিপর্যয় হবে। জনগণের স্বাধীনতা হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে।” ইংলিশ জুরিস্ট ব্ল্যাকস্টোন এ ক্ষেত্রে বলেন, ‘আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের স্বাধীনতা যদি একই ব্যক্তির কাছে থাকে, তাহলে জনগণের স্বাধীনতা বলতে আর কোনো জিনিস থাকে না।’
নয়. আমাদের দেশে যেটা দেখা যাচ্ছে তা হলো আমাদের অধস্তন আদালত আমরা যতই বলি পৃথকীকরণ হয়ে গেছে, কিন্তু বাস্তবিক আমাদের বিচার বিভাগ এখনো স্বাধীন হয়নি। আমাদের এমপিদের ঔপনিবেশিক মনোভাব এখনো যায়নি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে তারা মানতে একেবারেই নারাজ।
দশ. বর্তমানে ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সংসদে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে, তাতে সংসদীয় রীতিনীতি মানা হচ্ছে না। আমাদের বিচার বিভাগ এমনিতেই হুমকির মুখে। বিচারকেরা এখানে রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছায় বদলি হতে পারেন। চাকরি চলে যেতে পারে। এ রাজনৈতিক ভীতির কারণে নিম্ন আদালতের কোনো স্বাধীনতা নেই।
এগারো. তবে উচ্চ আদালতে রাজনৈতিক নিয়োগ পাওয়ার পরও অল্প কিছু স্বাধীনচেতা বিচারক বিভিন্ন সময় গণমানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য যুগান্তকারী রায় দিচ্ছেন। সেটি যদি এসব আওয়ামী লীগ এমপিদের স্বার্থের ওপর কিংবা রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের ওপর আঘাত হানে, তখনই বিচার বিভাগকে সংবিধানের ৭৮-এর ১ অনুচ্ছেদের সুবিধা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করছেন এসব এমপিরা। মাসদার হোসেন মামলার যুগান্তকারী রায়ে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা বিজয়ী হয়েছি বটে। কিন্তু সংবিধানে ৭৮(১) অনুচ্ছেদের যথেচ্ছ অপব্যবহারের কারণে উচ্চ আদালতের স্বাধীনতার জন্য কি আমাদের নতুন লড়াই শুরু করতে হবে। সত্যি এটি আতঙ্কিত বিষয় বটে!
বারো. ‘যিনি রাজা তিনিই ঋষি’- এটা তো হতে পারে না। এটি ছিল একটি প্রাগৈতিহাসিক বিষয়। কিন্তু আমাদের সংসদ সদস্যরা এটা একেবারেই মানতে নারাজ। তারা মুকুটহীন সম্রাট হতে চান। তারা ভুলে যান, সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। ক্ষমতার দম্ভে এসব এমপি সংসদকে বিচার বিভাগকে হামলার জায়গা বানিয়ে ফেললেন! তাই সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদের এ রকম অপব্যবহার রোধকল্পে এ বিধানটি বাতিলের দাবি এখন খুব বেশি আকারে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ, সংবিধানবিশেষজ্ঞ
উৎসঃ dailynayadiganta
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন