এক. এবার আওয়ামী লীগের এক এমপির হাতেই চরমভাবে অসম্মানিত হতে হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিকে। বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার অভিযোগে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফকে ‘পাকিস্তানের প্রেতাত্মা’ বলে দাবি করেছে আওয়ামী লীগ। এই এমপির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার হুঁশিয়ারি দিয়ে তার ছবিতে জুতা ও থুথু নিক্ষেপ করেছেন আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। এম এ লতিফের সংসদ সদস্যপদ খারিজের দাবিতে তারা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন। লতিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিজের ছবির ওপর বঙ্গবন্ধুর মাথা প্রতিস্থাপন করে নগরে অসংখ্য ফেস্টুন ও ব্যানার টাঙিয়ে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীকে চট্টগ্রাম সফরে অভিনন্দন জানান। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক কাঠামো বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি, সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অভিযোগÑ ‘ফেস্টুনের ওই ছবির মাথার অংশ বঙ্গবন্ধুর। কিন্তু মাথা থেকে পা পর্যন্ত শারীরিক কাঠামো সংসদ সদস্য লতিফের। ... এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। জাতির পিতাকে নিয়ে লতিফ ঠাট্টা-মশকারা করেছে।’ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বলেন, ‘এম এ লতিফ আমাদের দলের এমপি... তবে তিনি জামায়াতের অনুসারী। ... তিনি পাকিস্তানের পোশাক পরিধান করেন। তিনি সেই পোশাকেই বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেছেন।’ আওয়ামী লীগের আরেক নেতা হাসান মনসুর বলেন, ‘লতিফ পাকিস্তানি ভাবধারায় বঙ্গবন্ধুকে পরিচিত করার চেষ্টা করে সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন।’ অন্য দিকে, ছবি বিকৃত করার অভিযোগ সম্পর্কে এমপি লতিফ পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি ও সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তারই লোকজন বঙ্গবন্ধুর বিকৃত ছবি দিয়ে আমাকে হেয় করার চেষ্টা করছেন।’
বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ দুটোই এখন আওয়ামী লীগেরই দুই নেতার বিরুদ্ধে। আর অভিযোগকারী দু’জনও আওয়ামী লীগেরই নেতা। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এ দুই সৈনিকের যিনিই এ কাজটি করেছেন, তা নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর প্রতি চরম অবমাননাকর। একজন বিনা ভোটের অবৈধ এমপির শরীরের ওপর বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করে এবং তার শরীরে পাকিস্তানি কাবুলি ও সালোয়ার পরিয়ে খোদ আওয়ামী লীগ তো বটেই, পুরো বাঙালি জাতিকেও চরম অসম্মানিত করেছেন। মাঝখান থেকে, সব দোষ জামায়াতের কাঁধে ঠেলে দিয়ে এমপি লতিফকে ‘জামায়াতের অনুসারী’ বলে এবং তার বিরুদ্ধে ‘জামায়াত সংশ্লিষ্টতার’ অভিযোগ এনে তাকে দল ও সংসদ থেকে বহিষ্কারের দাবি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে যে-ই যখন দুই নম্বরি করুক না কেন, ধরা খেলেই সে হয়ে যায় ‘জামায়াত অনুসারী’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’! আর আওয়ামী লীগের মধ্যে জামায়াতের এত অনুসারী ও অনুপ্রবেশকারী যদি থাকে, তাহলে তাদের চিহ্নিত করে মুখোশ উন্মোচন করা হয় না কেন? তা না হলে তো সেই বিখ্যাত উক্তিটি আবারো প্রমাণিত হবে, ‘আওয়ামী লীগ এমন এক আজব মেশিন, যার এক দিক দিয়ে রাজাকার ঢুকাবে, আরেক পাশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বের হয়ে আসবে।’ আর এখন এ ঘটনার পর তো দেখি- উল্টা ঘটনাও ঘটছে, ‘এক দিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ঢুকাবেন, আরেক পাশ দিয়ে রাজাকার বের হয়ে আসবে।’
দুই. সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সাথে অত্যন্ত নাজুক এক পরিস্থিতি পাড়ি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্বর পাকিস্তানিদের ক্রমাগত কটাক্ষ যখন চরমে, ঠিক তখনই ঢাকায় পাকিস্তানি দূতাবাসের পলিটিক্যাল সেক্রেটারিকে গত মাসে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সাথে সাথে ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সিলরকেও পাকিস্তানিরা সে দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে। ক’দিন আগে পাকিস্তানি দূতাবাসের এক জুনিয়র অফিসারকে আমাদের পুলিশ গ্রেফতার করে দূতাবাসের কাছে হস্তান্তর করেছে। সাথে সাথে পাকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক জুনিয়র কর্মকর্তা নিখোঁজ হয়ে পরে ফিরে আসেন। এ নিয়ে চরম এক অবস্থা! যেন কূটনৈতিক ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ ভাব। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শরীরে সেই হানাদার পাকিস্তানিদের পোশাক কাবুলি ও সালোয়ার পরিয়ে ছবি বিকৃত করে সড়ক-মহাসড়কে টাঙিয়ে দেয়া হলো খোদ আওয়ামী লীগ থেকেই? তাও আবার এই বিকৃত ছবির ফেস্টুন ও ব্যানার টাঙিয়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকন্যাকেই অভিনন্দন জানানো হয়েছে। অথচ এর অণু পরিমাণ ‘অপরাধ’-এর অভিযোগও যদি দেশের কোনো সাধারণ মানুষ কিংবা কোনো ছাত্র, শিক্ষক কিংবা বিরোধী দলের কোনো কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে উঠত, তাহলে দেশে এতক্ষণে ঠিকই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিতেন ক্ষমতাসীন দলের গুণগ্রাহীরা। রাজনৈতিক সমালোচনাকে নিমেষের মধ্যেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহে’ রূপান্তর ঘটিয়ে ডিজিটাল গতিতে একাধিক রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়ে যেত দেশের একাধিক জেলায়। শিক্ষক হলে তিনি পরক্ষণেই চাকরি হারাতেন। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে ধরে নিয়ে আসা হতো। সিন্ডিকেট জরুরি সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করত। ছাত্র হলে তাকে চিরতরে ছাত্রত্ব হারাতে হতো। বিরোধী দলের নেতাকর্মী হলে তার বাড়ি পর্যন্ত ঘেরাও করা হতো। সবশেষে বিনা চিকিৎসায় অনন্তকাল ধরে জেলের ভাত খেতে হতো। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর সুবিধাভোগীরাই যেন তার অসম্মান করার একমাত্র হকদার। তাই তাদের আবার বিচার কিসের? আর এমপি হলে তো নির্বোধ শিশুকে পর্যন্ত পাখি শিকারের মতো গুলি করলেও কোনো সমস্যা হয় না। এখন এ নিয়ে দলীয় কোন্দল আর পাল্টাপাল্টি যত অভিযোগই আসুক না কেন, দিন শেষে কিন্তু এটাও যথারীতি হয়ে যাবে ‘সাত খুন মাফ।’
তিন. প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান করার অপরাধে গত বছর এক তরুণকে জরিমানাসহ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আসামি তন্ময় মজুমদারের অপরাধ, সে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি গান রচনা করে তা প্রচার করেছে; যা তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে মারাত্মক অপরাধ। এখন আবার এ ধরনের অপরাধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সংশোধন করে ন্যূনতম সাত বছর এবং সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। তা ছাড়া ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে সংবিধানে ৭(ক) নামক নতুন এক অনুচ্ছেদ যোগ করে এ ধরনের অপরাধকে রাষ্ট্রদ্রোহ নামকরণ করে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব কঠিন আইন আর তার কঠিনতম শাস্তিগুলোর প্রয়োগ যেন শুধু সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়া সমালোচকদের জন্যই বরাদ্দ! আর যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিত্যদিন বাণিজ্য করে, তার নাম বিক্রি করে সংসার চালায়, যারা বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করার পরিবর্তে উল্টা তাঁকেই নিজের শরীরে ধারণ করায়, তারাই বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অবমাননাকারী নয় কি? মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করে যারা নিত্যদিন বাণিজ্যিক প্রসারে ব্যস্ত তারাই আজ তাকে অতি মানব বানাতে গিয়ে পাকিস্তানি কাবলি পরিয়ে ছেড়েছে। এই অবিবেচকেরাই বঙ্গবন্ধুকে তার শারীরিক কাঠামো আর মুজিব কোটে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। মনে রাখতে হবে, তিনি এসব চেতনাব্যবসায়ী ছাড়াই ইতিহাসের মহানায়ক হয়েছিলেন। আর স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় তার ব্যর্থতা নিয়ে তার সমালোচনা করাকে যারা ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলে ভয় দেখায় তারাও অবমাননাকারী। বঙ্গবন্ধুর শারীরিক কাঠামো পরিবর্তন কিংবা তার রাজনৈতিক জীবনের সমালোচনা করলে তার মতো নেতা কখনো খাটো হওয়ার নন। বঙ্গবন্ধু তার শারীরিক কাঠামো বা তার সমালোচকদের চেয়ে অনেক বিশাল।
চার. আমাদের দেশে প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের মারাত্মক একটি অস্ত্রের নাম হচ্ছে, মিথ্যা মামলা। আর এ ক্ষেত্রে যে আইন যত বেশি কঠোর, তার অপব্যবহারও তত বেশিই প্রকট। বিগত সময়ে এ দেশে নারী নির্যাতন আইনের জামিন অযোগ্যতা ও শাস্তির কঠোরতা এত বেশি ছিল যে, সমাজে এই আইনে মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের বহু অভিযোগ রয়েছে। আর এ দেশে ক্রসফায়ারের ভয়ে তো প্রতিপক্ষকে সর্বস্ব দিয়ে দিতেও কেউ কুণ্ঠাবোধ করে না। তবে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননার ভীতি। বর্তমানে এ দেশে একে অন্যকে ঘায়েল করতে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু বা প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননা করে উড়ো চিঠি বা লিফলেট ছেড়ে দিলেই কাজ হয়ে যায়। ফেসবুকে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এরকম ভুয়া পোস্ট দেয়ার অনেক ঘটনার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এখন এটা এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দলীয় পদ-পদবি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কান ভারী করার জন্য এখন এটাই যেন শ্রেষ্ঠতম অস্ত্র। কোনোভাবে কাউকে এই তকমা দিতে পারলেই যেন কেল্লা ফতে। আর এগুলোর অপব্যবহার এমন একপর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তা থেকে দলের মন্ত্রী-এমপিরাও নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না। রাজনীতির ময়দানে প্রতিপক্ষকে পরাস্থ করতে না পারলে চেতনা অবমাননার অভিযোগে ‘থুথু নিক্ষেপ’ থেকে শুরু করে ‘জুতাপেটা’ করাও এখন সম্ভব। এ এক আজব আবেগি খেলা! আর অদ্ভুত এক আগুনের খেলা! প্রতিপক্ষের ঘরে নিত্যদিন আগুন লাগাতে লাগাতে সেই আগুনেই এখন পুড়ছে ক্ষমতাসীনদের হাত। এই লেলিহান খেলা বন্ধ করতে হবে নিজেদের স্বার্থেই। বঙ্গবন্ধুর শারীরিক কাঠামো বিকৃতির অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার চাওয়ার সাথে সাথে দেশের গণতন্ত্র বিকৃতির দায়ে নিজেদের কৃতকর্মকে স্মরণ করতে হবে।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
e-mail :
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন