বিদেশে স্বদেশের ব্যথা
04 October 2015, Sunday
আমার প্রতিটি বিদেশ ভ্রমণেই রয়েছে আমার মেধাবী ছাত্রদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অবদান। এবারের ভ্রমণ হচ্ছে অধ্যাপক সোহেল রহমানের সৌজন্যে ব্রিটিশ কাউন্সিলের অর্থায়নে ইন্সপায়ার প্রকল্পের অংশ হিসেবে। আন্তর্জাতিক জার্নালে সোহেলের প্রকাশনার সংখ্যা বয়সের দ্বিগুণ এবং তার বয়স চল্লিশ হতে ঢের বাকি।
এক. ইতিহাদের ফ্লাইট যাত্রীতে ঠাসা। তা-ও বেশির ভাগ বাংলাদেশি যাত্রী। ঘোষণাগুলো আসছে আরবি ও ইংরেজি ভাষায়। বাংলায় হলে এই যাত্রীরা না জানি কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। আবুধাবি বিমানবন্দরের টার্মিনাল দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ। এর আগেও এসেছিলাম, এমন আহামরি কিছুই ছিল না। আমি নিশ্চিত এই বিমানবন্দর তেলের টাকায় তৈরি হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে স্বল্প বেতনে কর্মরত বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের যাতায়াত ভাড়া থেকে এই বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল। আমাদের বিমান যদি দক্ষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতো, এর কর্মকর্তাদের মধ্যে যদি দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটা থাকত, তাহলে আমাদের দেশের যাত্রীদের টাকায় শুধু ঢাকা বিমানবন্দরকে যে চাকচিক্যময় করা যেত, তা-ই নয়; গোটা দেশের উন্নয়নে বিমানের প্রশংসনীয় অবদান থাকতে পারত। অবশ্য বিমানের উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপই হওয়া উচিত জনগণের অর্থে সব ভ্রমণই বিমানে করাটা বাধ্যতামূলক করা।
দুই. বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই সোহেল হিসাব করা শুরু করল, কীভাবে ১ নম্বর জোন এড়িয়ে যাওয়া যায়। কারণ, সকালের ব্যস্ততম সময়ে ১ নম্বর জোনে ঢুকলেই ভাড়া হিসেবে অনেক টাকা জরিমানা গুনতে হবে, তা ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা পাবলিক যানবাহন হোক। আমাদের দেশে যানজটে যতই পিষ্ট হই না কেন, যানগুলোকে যানবহুল রাস্তায় নিরুৎসাহিত করার কোনো উপায় নেই। এই সীমিত সম্পদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা যত খুশি খরচ করে যেকোনো ব্যক্তি যত খুশি গাড়ি আমদানি করতে পারে। লন্ডনের মতো শহরে যেখানে যানজটের জন্য স্থান-কালভেদে বাস, রেল কিংবা মেট্রোর ভাড়া কমে–বাড়ে, যানজটপিষ্ট ঢাকা শহরে তা আশাতীত।
খোদ কিংস কলেজে সেমিনারের ব্যবস্থা। সেমিনারের সভাপতি ম্যাক্সিম ক্রকেমরে জানিয়ে দিলেন, ১২টা থেকে ১টার মধ্যেই সেমিনার শেষ করতে হবে। ব্রিটিশদের এই কৃচ্ছ্রসাধন কিন্তু সর্বত্র অনুশীলন করা হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকারের উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডিতে কর্মরত আমার এক বন্ধু জানাল, কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে সভাগুলোতে চা বাদ দিয়ে শুধু গরম পানি সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা নিজেদের মহানুভবতার পরিচয়ই দিয়েছে।
তিন. বারবার বিদেশকে ভালো আর দেশকে খারাপ বলতে আর ভালো লাগে না। এবার অন্য রকম উদাহরণ টানি। সুবিখ্যাত কিংস কলেজ লন্ডনের এক অধ্যাপকের বাসায় হঠাৎ একটি বিড়াল এল। যতক্ষণ সে দয়া করে না যাচ্ছে, তার ভাবনায় অধ্যাপক সাহেবের নাভিশ্বাস অবস্থা। করতে হলো ইনস্যুরেন্স, তা-ও আবার হাজার পাউন্ড দিয়ে; পাছে ওকে ডাক্তারখানায় নিয়ে অধ্যাপকের দুই হাজার পাউন্ড খরচ হয়ে যায়। এর মধ্যে মালিক এলে অধ্যাপক তো আনন্দে আটখানা। কিন্তু বিড়াল সাহেব ফিরে যেতে নারাজ। এবার তার শুধু সম্ভাব্য অসুখের চিকিৎসার জন্যই নয়, তার চিত্তবিনোদনের জন্য হাজার পাউন্ড খরচ করে ক্যাটাগরিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হলো। এদিকে সিরিয়ার দ্বিপদ প্রাণীরা প্রাণ বাঁচাতে যেকোনো ডিঙি নৌকায় উঠে পড়ছে মহাসাগর পার হওয়ার আশায়। সভ্যতার সূতিকাগার ইউরোপ দিচ্ছে দরজা বন্ধ করে। কেবল জেগে রয়েছে একসময়ের হিটলার শাসিত জার্মানি। লাখ লাখ শরণার্থীর কেবল ছিটেফোঁটা নিতে নিমরাজি ফ্রান্স সম্ভবত লজ্জায় পড়ে। জনমানবশূন্য অস্ট্রেলিয়া এশীয়দের নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে চায় না, ইউরোপের সাত খুনের আসামি হলেও নাহয় বিবেচনা করতে পারত। আর রাজকীয় যুক্তরাজ্য আপাতত বিড়ালের সম্ভাব্য চিকিৎসার জন্য ইনস্যুরেন্স ও চিত্তবিনোদনের জন্য ক্যাটাগরি নিয়ে ব্যস্ত। আমি জানি না এমন কোনো ধর্ম আছে কি না, যেখানে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর অগ্রাধিকার এত কম।
চার. বেলফাস্টের কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবনে ঢুকেই ধ্যানমগ্ন গ্যালিলিওর মূর্তি দেখে খুবই ভালো লাগল। বিশ্ববিদ্যালয় হলো চিন্তা গবেষণার স্থান, যা প্রতিদিনই মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বেলফাস্টের যে ডকইয়ার্ডে টাইটানিক তৈরি করা হয়েছিল, সেখানেও গেলাম। সমান আকারের একটি অবকাঠামো তৈরি রয়েছে, যার অগ্রভাগে টাইটানিকের আদলে ভেতরে মৃত্যুবরণকারী যাত্রীদের নাম। এর মধ্যে জনা ছয়েকের নাম থেকে তাঁদের মুসলমান মনে হচ্ছিল। বলা হয়, আইরিশরা টাইটানিক তৈরি করেছে আর ইংরেজরা ডুবিয়েছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের বিমানবন্দরে প্রতিদিন ছয়-সাতটি ফ্লাইট চলে, যার প্রতিটিতে গড়ে ২০০ যাত্রী। আমাদের চার কোটি মানুষের দক্ষিণবঙ্গের একমাত্র বিমানবন্দর যশোর থেকে দিনে নিশ্চয়ই শ দেড়েক যাত্রীর বেশি যাত্রা করে না।
পাঁচ. কিংস কলেজ লন্ডন তার স্নাতকদের নিয়ে গর্বিত। ডেসমন্ড টুটু, সমারসেট মম, পিটার হিগস, জন কিটস, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, সরোজিনি নাইডু কিংবা গ্যারি লিনেকারদের ছবি গর্বের সঙ্গে টাঙিয়ে রেখেছে। ছোট-বড় নানা পরিসরে লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তিদের স্মৃতি সংরক্ষণের অভিনব পদ্ধতি। কখনো শুধু বেঞ্চে নাম খোদাই করা রয়েছে। আমাদের দেশে এমনটি আর চোখে পড়ে না। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের স্মৃতিময় স্থান শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্ষত রেখে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। আমাদের দেশে কখন এমন সংস্কৃতি হবে, যখন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা হুঙমায়ূন আহমেদকে নিয়ে গর্ববোধ করবে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় গর্ব করবে বিশ্বজয়ী স্থপতি এফ আর খান কিংবা আমেরিকান প্রেসিডেন্টের ঊর্ধ্বতন পরামর্শক ড. ফজলে হুসেনকে নিয়ে।
আমাদের দেশের সীমিত সম্পদ আর অফুরন্ত চাহিদার কথা মনে রেখে যেন আমরা সাশ্রয়ী হই, আবার দেশে মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হতে আমাদের লব্ধপ্রতিষ্ঠ গুণী ব্যক্তিদের নিয়ে গর্ব করতে যেন কার্পণ্য না করি।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বুয়েট। ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন