বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষোভ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভ্যাট নিয়ে অসন্তোষ আর নগরীর যাতায়াতে স্থবির অবস্থার প্রতিটি ইস্যুই সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বেতন কমিশন হয়েছে, যার কোনোটিতেই বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ধাপে কত বেতন ইত্যাদি ছাড়াও বিভিন্ন পদ-পদবির কর্মকর্তারা কেন পে-স্কেলের ওপরের ধাপে থাকবেন, নিচের ধাপে নয়, দেশ ও জাতির কল্যাণ সামনে রেখে তার একটি দার্শনিক, যৌক্তিক ভিত্তি থাকা অপরিহার্য। অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট নানা ওয়েবসাইট ভ্রমণ করে তেমন কিছু বের করতে পারলাম না।
অবশ্যই একটি যুক্তি হতে পারে, এর আগের পে-স্কেলের অবস্থানকে অনুসরণ করা হয়েছে কিংবা কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করা হয়েছে। এই কিঞ্চিৎ পরিবর্তনও কিন্তু আবার একটি যৌক্তিক, দার্শনিক ভিত্তির দাবিদার। যেমন হতে পারে দেশের কল্যাণে সচিব, পুলিশ কমিশনার অথবা অধ্যাপকের কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী তাঁদের ধাপ সাজানো।
সে ক্ষেত্রে এই গুরুত্বের বিষয়টি নিরূপণ করতে পারেন আমাদের জনপ্রতিনিধি কিংবা সমাজবিদ্যাবিশারদেরা। পিএইচডি গবেষণার সময় এক ডাকসাইটে অধ্যাপককে (পরবর্তী সময়ে যিনি প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন) দেখতাম সকালে করিডর ঝাড়ু দেওয়া এক অশীতিপর বৃদ্ধার সঙ্গে লম্বা সময় নিয়মিতভাবে খোশগল্প করতে। পরস্পরের পছন্দের আলাপের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বললেন, এই বৃদ্ধা প্রত্যুষে করিডরটি ঝাড়ু না দিলে এই ভবনে আমাদের কাজ করা অসম্ভব হয়ে যাবে।
এই পৃথিবীতে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই প্রয়োজন, কোনো পেশাকেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। তদানীন্তন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে সদ্য পাস করা এক প্রকৌশলীর চেয়ে একজন সাধারণ শ্রমিক মোটেই কম বেতন পেতেন না। আমাদের সমাজে তো আর এ রকমটি নয়। ফলে গুরুত্ব নির্ধারণের বিষয়টিও সহজ নয়। আমরা যেমন বলি যে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, আর সেই মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করার জন্য শিক্ষকদের আলাদা বেতনকাঠামো কিংবা বেশি বেতন দিতে হবে, মর্যাদা দিতে হবে (আমাদের মেরুদণ্ডটি নাকি ভারতের চেয়ে ছয় গুণ দুর্বল আর পাকিস্তানের চেয়ে দুই গুণ)।
একইভাবে একজন সচিব বলবেন, আমাদের সমাজের সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের ভাগ্যোন্নয়নে তাঁরা অবদান রাখছেন, তাঁদের কাজটিও দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ; পুলিশ বলবে, সমাজে আইনশৃঙ্খলার অভাব, সুতরাং তার কাজটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এই পথে নৈর্ব্যক্তিক, নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তে আসা সহজ নয়। আরেকটি হতে পারে, যেহেতু উন্নয়নের মাপকাঠিতে আমরা বেশ পিছিয়ে, যদিও অতিসম্প্রতি নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশে অন্তর্ভুক্তি আমাদের সবাইকে কিছুটা আত্মবিশ্বাসী করেছে। প্রকৃত কথা হলো, একসময় উন্নয়নের মাপকাঠিতে আমাদের সমকাতারে অবস্থান করা কোরিয়া, মালয়েশিয়া এমনকি বিশাল জনগোষ্ঠীর ভারতও প্রশংসনীয় অগ্রগতি করেছে। তাদের বেতন কমিশন নিয়েও বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে ভারতের আর্থসামাজিক দিকগুলোর সঙ্গে আমাদের মিল থাকায় তাদের বেতন কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে গবেষণা করা এবং তা থেকে চিন্তা-চেতনায় নিজেদের সমৃদ্ধ করে আমাদের বেতন কমিশন প্রতিবেদন প্রণয়ন করা জরুরি বলে মনে করি।
আরেকটি উপায় হলো, আমাদের নানা পদ-পদবিতে যাঁরা অধিষ্ঠিত আছেন, তাঁদের মেধার গড় মান বের করা। অবশ্য বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন, মেধা বলে কিছু নেই, সবই কঠোর পরিশ্রম। আইনস্টাইনও বলেছেন, তিনি চৌকস নন বরং একই সমস্যা নিয়ে লম্বা সময় লেগে থাকতে পারেন। তারপরও আমরা সবাই একটি বয়স পর্যন্ত একই লেখাপড়া করেছি, একই পরীক্ষা দিয়েছি, একই শিক্ষক আমাদের নম্বর দিয়েছেন। সবাই আমরা এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে পড়েছি, কেউ চিকিৎসক–ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন, সেখানে মূল্যায়ন হয়েছে। এসব মূল্যায়নের একটি গড় পেশা অনুযায়ী আমরা করতেই পারি। দীর্ঘদিনের এই গড় অবস্থানের একটি যৌক্তিক ভিত্তি আছে। কাজটি এখনো করার সময় আছে। কিছুদিনের মধ্যেই কেরানি থেকে সচিব পর্যন্ত সব স্তরের চাকরিজীবীরাই জিপিএ-৫ হয়ে যাবেন, তখন তাঁদের মধ্যে গ্রেড দিয়ে মেধার ব্যবধান করা সম্ভব হবে না। প্রত্যেক চাকরিজীবীর শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সনদ প্রতি অফিসেই আছে, সম্ভবত তা ডেটাবেইসেও সংরক্ষিত আছে, তা থেকে এই গড় বের করা মোটেই কঠিন হবে না। আমরা জানি, নম্বর আর গ্রেড দিয়ে সবার মূল্যায়ন যথাযথ হয় না। আইনস্টাইন আর নিউটনও জীবনে ভালো গ্রেড পাননি। তারপরও এর থেকে শ্রেয়তর মাপকাঠি পাওয়া দুষ্কর। তবে আমরা যদি এর থেকেও গ্রহণযোগ্য একটি নৈর্ব্যক্তিক মাপকাঠি বের করতে পারি, তা আমাদের সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করা যেতে পারে।
দুই.
ভ্যাটের বিরুদ্ধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শক্ত অবস্থান প্রকাশ করেছেন। গণমাধ্যমে দেখতে পেলাম, সরকার এই ভ্যাট পরিশোধের জন্য ছাত্র নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশের বিলম্বিত প্রকাশ জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। এ সিদ্ধান্ত থেকে কি ধরে নেওয়া যায় যে সরকারের মনে হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রদের জন্য যে ফি ধার্য করছে, প্রকৃত শিক্ষাব্যয় তার তুলনায় অনেক কম? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে উন্নয়ন হচ্ছে, তা এই ছাত্রদের জোগানো অর্থ থেকে। আর এই উন্নয়ন যদি তাঁদের অর্থেই হয়, উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ যদি প্রশংসনীয় না হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোগুলোয় তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি খোদাই করে রাখা যেতে পারে; যেমন ভবনের চতুর্থ তলা ২০১৪ ব্যাচের ছাত্রদের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত ইত্যাদি। আবার তাঁরা উন্নয়নের মাত্রা কমিয়ে তাঁদের পিতা-মাতার ওপর থেকে অর্থের বোঝা কমানোকেই শ্রেয়তর মনে করতে পারেন।
তিন.
যানজটে নাকাল রাজধানী। মুঠোফোনের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি, সঙ্গে দৃঢ় হচ্ছে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। কিন্তু তাই বলে কোনোভাবেই যানজট কমছে না, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছেই। ইন্টারনেট আর মুঠোফোনের সৃজনশীল ব্যবহার নিয়ে আমাদের গবেষণা জোরদার করতে হবে, যাতে এই যোগাযোগমাধ্যমে যানজট কিছুটা হলেও কমে। সীমিত রাস্তা ও যানজটের কথা বিবেচনায় এনে নতুন নতুন গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের গণতান্ত্রিক অধিকার কী মাত্রায় নিশ্চিত করা উচিত, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন, বিশেষ করে সীমিত সম্পদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে গাড়ি কিনে তাকে যদি রাস্তায় চালানোর মতো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারে, তাহলে দেশের সম্পদ গাড়ি কেনার নামে বিদেশে পাচার করে আমাদের লাভ কী?
তবে মনে হয়, আমাদের যানজটকে সহনশীল সীমার মধ্যে আনতে সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হবে দেশের সব নাগরিক যানজট সমানভাবে উপভোগ কিংবা এর দুর্ভোগ ভাগাভাগি করে নেওয়া। প্রকৃতপক্ষে উন্নত দেশের নেতা-নেত্রীরা সেখানে শ্রেয়তর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পরও অতিরিক্ত অধিকার ভোগ না করে সাধারণ মানুষের কাতারে থেকেই সব সেবা গ্রহণ করে থাকেন। আমাদের দেশে এমনটি হলে যানজটের উপশম হবে। নেতাদের কাজই হলো দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে আমজনতাকে উজ্জীবিত করা, উৎসাহিত করা, উদ্বুদ্ধ করা। নেতারা এই কাজটি করতে পারেন ভোগে নয়, ত্যাগে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন, আয়েশি জীবনের পরিবর্তে দুর্ভোগের জীবন গ্রহণ করেছিলেন। আমাদের নেতারাও এমনটি হলে শুধু যানজট নয়, অনেক সমস্যার সমাধান দোরগোড়ায়।
নীতিনির্ধারকেরা অশান্ত বিশ্বাদ্যালয়কে শান্ত এবং অচল নগরকে সচল করতে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন