কৃচ্ছ্রসাধন এবং আমরা
30 August 2014, Saturday
পৃথিবীর এক-সহস্রাংশেরও কম ভূমিতে আমাদের ২৪ সহস্রাংশ মানুষের বাস। অর্থাৎ পৃথিবীর একটি শিশু গড়ে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে বড় হয়, বাংলাদেশে একটি শিশু পায় তার ২৪ গুণ কম। স্বভাবতই সম্পদের ব্যবহারে আমাদের অবশ্যই মিতব্যয়ী হওয়া উচিত। একজন মানুষের জন্য সাকল্যে বরাদ্দ ৭৮৩ বর্গমিটার, যা শহর-দেশগুলো বাদ দিলে প্রায় সর্বোচ্চ শুধু মালদ্বীপের জন্য সংখ্যাটি ৭৫৭। যেসব দেশ আমাদের থেকে শ্রেয়তর প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, যেসব দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রকৌশলের শক্তিতে আমাদের থেকে অনেক বেশি বলীয়ান, তাদের দিকে একবার তাকাই।
১. ২০১৪ সালের প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের আগে ও পরে রাশিয়ার ইকেটেরেনবুর্গ শহরের কোনো ছোট হোটেলে থাকতে হবে। খুঁজতে গিয়ে একটি বড় হোটেলের পাঁচ মিনিট দূরত্বে পেয়েও গেলাম। ভেতরে ঢুকতেই হতবাক। দেশের চতুর্থ বৃহত্তম শহরে ১০ X ২০ ফুট মাপের একটি বাসায় চারটি খাটের ওপর আরও চারটি খাট বসিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং তাতে থাকে সেই দেশের নাগরিকেরা, যে দেশ আয়তনে পৃথিবীর বৃহত্তম, যে দেশের মাথাপিছু জায়গা বরাদ্দ ১ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার। পক্ষান্তরে আমাদের মাথাপিছু বরাদ্দ কেবল ১৫০ গুণ কম! আমাদের নিশ্চয়ই তাহলে এক খাটের ওপর চার-পাঁচটি খাট বসিয়ে বড় বড় হোটেলে থাকা উচিত!
২. ভারতে ট্রেনে শুধু সাধারণ কামরায়ই নয়, এমনকি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরায় একটি বেঞ্চাকার সিটের ওপর আরও দুটি বসিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ভারতের থেকে আমাদের জনঘনত্ব কমপক্ষে তিন গুণ, তাহলে আমাদের কয়টি বসানো উচিত? এমনকি ভারতের মতো তিনখানাও তো দেখলাম না। ভারতে এমনকি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরায় আরও সাশ্রয়ীভাবে যাওয়ার সুযোগ আছে, যাকে বলে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (সাশ্রয়ী)। ভারতের মাথাপিছু আয় এখন আমাদের দুই গুণ, জনঘনত্ব তিন গুণ কম। একবার আমাদের একজন সম্পাদকের কাছে শুনেছিলাম যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকসাইটে এক সচিব অবসরে যাওয়ার পর দুই কামরার বাসায় থাকছেন। আমরা নিশ্চয়ই তাঁকে কঞ্জুস বলে নিজেদের ভোগের মাহাত্ম্যে গর্বের ঢেকুর তুলব।
৩. চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনে কুনমিং থেকে তাইপেই প্রায় ১০ হাজার ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশের থেকে ৪০ হাজার ডলার আয়ের দেশের ঘটনা। দ্বিতীয়বার ফলের রস খাওয়ার জন্য আগে দেওয়া ফেলনাযোগ্য গ্লাসটি চাইতে আমি তো রীতিমতো অবাক। যতক্ষণ পারো ব্যবহার করো, তারপর তার রিসাইক্লিং করো, তাও ফেলে দেবে না। তাইওয়ানে তারা আরেক কাঠি সরেস। পানি খেতে যেতে দেখি কোনাকৃতি হালকা কাগজের পাত্র। ফেলেই যখন দিতে হবে তা তৈরিতে এত কাঠখড়ি পোড়াব কেন? আকারেও যেন ছোট হয়, দামেও যাতে সস্তা হয়। কৃচ্ছ্রসাধন সর্বত্র, যদিও মাথাপিছু আয় আমাদের থেকে ২০ গুণ বেশি।
৪. এসিএম আইসিপিসির আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় কানপুর গিয়েছি। আগের বছর ঢাকা সাইটের পুরস্কার বিতরণী এবং সান্ধ্যভোজ আমরা হোটেল শেরাটনে করেছিলাম। গিয়ে দেখি হলগুলোর পাশে শামিয়ানা টানিয়ে সেখানেই সান্ধ্যভোজের ব্যবস্থা, যদিও মাথাপিছু আয় আমাদের দ্বিগুণ! কলকাতা শহরে একটি দোকান খুঁজছিলাম, যেখান থেকে দেশে একটি ই-মেইল করতে পারি। আলো-আঁধারিতে এক দোকান, ভেতরে কয়েকটি মান্ধাতার আমলের কম্পিউটার, কি–বোর্ডের বর্ণগুলো দেখা যায় না, মাউস নাড়ালে কোনো উত্তর নেই। সেই কম্পিউটার বাসায় নয়, ব্যবসার জন্য ব্যবহার করছে। প্রতি ১৫ মিনিট কিংবা তার অংশবিশেষের জন্য ১০ রুপি।
৫. পার্শ্ববর্তী দেশে তথ্যপ্রযুক্তির জয়জয়কার দেখে দেশে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কত উচ্চবাচ্য করছি কিন্তু কাজের কাজটি সম্ভবত এখনো হচ্ছে না। কোনোভাবেই সরকারি কোনো বাহিনীর সঙ্গে বিদেশে গিয়ে নিজের বিদ্যাবুদ্ধি সতেজ করার উপায় নেই। ঠিক করলাম নিজেই ভারতে গিয়ে দেখে আসব। গেলাম চেন্নাই শহরে। এক ভদ্রলোক খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়ে যাবেন বলে একটি পুরোনো যুগের খসে পড়া দেয়ালের ভবনের দোতলায় নিয়ে একটি তেল-চিটচিটে টেবিলের সামনে দাঁড় করালেন। টেবিলের ওপরে বসানো কম্পিউটারকে আরও মান্ধাতার আমলের মনে হলো। আইআইটি মাদ্রাজের টিনএজার ছাত্রজীবনের প্রথম কম্পিউটার দিয়ে এমন সব সফটওয়্যার তৈরি করছে যে মাইক্রোসফট তাকে ইন্ডাস্ট্রি প্রোডাক্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং মাত্র ২২ বছর বয়সে ৩৬ জন আইআইটি স্নাতক তার সঙ্গে কাজ করছে। কি–বোর্ডের বর্ণ না হয় দেখা না-ই গেল, মাথায় তো আর বুদ্ধি কম নয়, তাই পুরোনো কম্পিউটার দিয়ে যতক্ষণ কাজ করানো যায় করিয়ে নিচ্ছে। গিগাহার্টজ মেশিন নয়, আসল সম্পদ হলো মাথা। মেশিনে কাজ হলে কুয়েত, কাতার আর সৌদি আরব হতো সবচেয়ে উন্নত দেশ। তা কিন্তু নয়, তেল-গ্যাস সম্পদহীন জাপান হলো সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী আর তাদের সম্পদ হলো তাদের মাথা, জ্ঞান, প্রাযুক্তিক দক্ষতা। আমাদেরও যদি কোনো সম্পদ থেকে থাকে তা হলো মানুষ, যাকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। প্রাকৃতিক কিংবা ভৌত অবকাঠামোতে তো আমাদের এখনই সমৃদ্ধ হওয়ার কথা নয়।
৬. নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শুরুতে যিনি অবদান রেখেছিলেন, আইআইটি কানপুরের সেই অধ্যাপক ফাল্গুনী গুপ্ত ও তাঁর স্ত্রীকে বাসায় দাওয়াত করেছি। বড় বড় ফার্মের মুরগি কিনেছি। রোস্ট করার পর দেখতে খাসির পায়ের মতো লাগছে। ছয়-ফুটি ফাল্গুনী অতিকষ্টে নিজের প্লেটেরটা শেষ করে স্ত্রী এবং তনয়ার প্লেটের প্রায় অক্ষত ড্রামস্টিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, দুজন মিলে তো একটা খাওয়ার চেষ্টা করতে পারতে। এত মূল্যবান খাবার নষ্ট হয়ে যেতে তাঁর যে কষ্ট হচ্ছিল, তাতে আমারই খারাপ লাগছিল। অবশ্য দুর্বল অর্থনীতির দেশের নাগরিক হিসেবে বেহিসাবে খরচ করার জন্য নয়।
৭. আমার এক বন্ধু নামকরা বিদেশি দাতা সংস্থায় কর্মরত। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তারা কৃচ্ছ্রসাধনে মনোনিবেশ করেছে। নোটিশ দিয়ে সব কর্মকর্তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে এই কৃচ্ছ্র সত্ত্বেও সভাগুলোতে গরম পানি সরবরাহে কার্পণ্য করা হবে না। আবার তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধানও নাকি ইকোনমি ক্লাসে বিমান ভ্রমণ করে থাকেন। দাতা সংস্থার কৃচ্ছ্রসাধন যদি এমন হয়, তাহলে যাদের দান করে, তাদের থেকে এই সংস্থার প্রত্যাশা কী হওয়া উচিত?
সীমিত সম্পদের দেশে আমরা যেন সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা করে দেশকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাই, এটাই প্রত্যাশা।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন