বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ
21 August 2014, Thursday
যে দেশটি পৃথিবীর গড় নাগরিকের প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদের শতকরা ২৪ ভাগের এক ভাগ সম্পদ দিয়ে সে দেশের একটি শিশুকে পরিপূর্ণ নাগরিকে পরিণত করতে হয়, ওই দেশের সব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং সব ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে, পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তির মতো জুতসই প্রযুক্তি আর নেই। সুতরাং সেই প্রযুক্তিজ্ঞানের দক্ষতায় আমাদের তরুণদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হলে প্রতিযোগিতার কোনো বিকল্প নেই।
বলা হয়ে থাকে, জিডিপির কমপক্ষে ছয় শতাংশ বরাদ্দ হওয়া উচিত শিক্ষায় অথবা বাজেটের ২০ শতাংশ। আমাদের বরাদ্দ জিডিপির দুই শতাংশের কিছুটা ওপরে এবং বাজেটের সম্ভবত ১১ শতাংশ; তাও আবার আমরা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি না। কোরিয়া ও মালয়েশিয়া একসময় উন্নয়নের মাপকাঠিতে আমাদের সমপর্যায়ের ছিল। শুধু শিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তারা উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে আমাদের ধরাছোঁঁয়ার বাইরে চলে গেছে। একসময় ওই সব দেশের ছেলেমেয়েরা আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসত, এখন স্রোত বিপরীতমুখী। সুতরাং সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষা, দক্ষতা বিশ্বমানের করাটা মোটেই সহজসাধ্য নয়। তাই সুস্থ প্রতিযোগিতা এবং গণমাধ্যমে তার বহুল প্রচারের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মধ্যে যেমন তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে, ঠিক একইভাবে তরুণদের মধ্যে এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী করতে হবে।
২০০০ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বিজয়ী হয়ে সেন্ট পিটার্সবুর্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার নামই পরিবর্তন করে ফেলল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সফল দলগুলোর সঙ্গে দেখা করেন, মতবিনিময় করেন, সে দেশের তরুণেরা তথ্যপ্রযুক্তিতে তাদের দক্ষতা অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন করে। তাই রাশিয়ানদের এই প্রতিযোগিতায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য। বিগত তিন বছর রাশিয়ান দল চ্যাম্পিয়ন, এবার অবশ্য রানারআপের গৌরবও তারা অর্জন করেছে।
একইভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের বিজয়ীদের সময় দিয়ে উৎসাহিত করে থাকেন। কারণ, তিনি জানেন, আমেরিকার অগ্রগতিতে বিজ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সরকারের আচরণ থেকে তথ্যপ্রযুক্তি কিংবা বিজ্ঞান প্রযুক্তির গুরুত্ব আঁচ করা কঠিন। আমাদের সোনার ছেলে আবিরুল ইসলাম উপমহাদেশের আট প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড থেকে রৌপ্যপদক অর্জন করেছিল। সে সম্ভবত তার এই গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের ‘গুরুত্বহীনতা’ টের পেয়ে বৃত্তি নিয়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে পড়তে গেছে।
এবার এসিএম আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার বিশ্ব চ্যাপিয়নশিপে সারা পৃথিবীর ৪০টি আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ১২২টি দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে যোগদানের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এবার প্রতিযোগিতার আয়োজন হলো এশিয়া ও ইউরোপের মিলনস্থল উরাল ফেডারেল ইউনিভার্সিটি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এই মর্যাদাকর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সম্মান অর্জন করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই প্রতিযোগিতায় পর পর ১৭ বার অংশগ্রহণের গৌরব অর্জন করল। এ রকম ধারাবাহিক সাফল্য নিয়ে গর্ব করতে পারে পৃথিবীর মাত্র পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। এই সুবাদে বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষাবিদেরা বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষার মানেরও ভূয়সী প্রশংসা করছে। এই আকাশছোঁঁয়া অর্জন কখনো কি আমাদের নজরে এসেছে?
অথচ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে শুধু বুয়েটের নয়, শাহজালাল, জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা, এআইইউবি এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গুগল, মাইক্রোসফটসহ অন্যান্য নামীদামি বহুজাতিক কোম্পানির দামি চাকরি নিয়মিতভাবে পাচ্ছে। ২০০০ সালের ৬০ দলের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দল যখন ১১তম স্থান দখল করেছিল, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উৎসাহিত করেছিলেন এবং প্রত্যেককে নগদ এক লাখ টাকা করে অর্থ পুরস্কারও দিয়েছিলেন। এবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৯তম স্থান দখল করেছে। (বিস্তারিত ফলাফল মিলবে এই ঠিকানায়) তাদের পেছনে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির মহাশক্তিধর ভারতের নয়টি দল, ইরানের সুবিখ্যাত শরিফ বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ছাড়া সব বিশ্ববিদ্যালয়ই আমাদের পেছনে। তাই বিভাগীয় শিক্ষক মোহাম্মদ সাইফুর রহমানের কোচিংয়ে প্রত্যয়, হাফিজ ও প্রসেনজিতের এই অর্জন নজর এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না।
দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতিযোগিতায় যাতায়াতের ব্যয়ভার ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস ডার্টমাউথের প্রভোস্ট এবং এক্সিকিউটিভ ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আতাউল করিমের উদ্যোগে নর্থ আমেরিকান বাংলাদেশি ইসলামিক কমিউনিটি বহন করে আসছিল। এবারের ব্যয়ভার বহন করে আমাদের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, যার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং আগামী দিনে আমাদের ছাত্রদের এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখার জন্য অনুরোধ করছি। উল্লেখ করা যেতে পারে, এবার দলগুলোকে কঠিন সমস্যার সেট সমাধান করতে হয়েছে, যার জন্য ২১/২২টি দল কোনো সমস্যাই সমাধান করতে পারেনি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দল ১২টি সমস্যার মধ্যে তিনটির সমাধান করে ১৯তম স্থান দখল করে। দুটি সমস্যার সমাধান করেও কিছু দল র্যাঙ্ক পায়। ২২-২৬ জুনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের আগে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ দলের অনুশীলনের জন্য একটি সুন্দর সুযোগ তৈরি করে।
তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের ছাত্র–ছাত্রীরা যাতে তাদের দক্ষতার প্রমাণ রাখতে পারে, সে জন্য তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। শ্রেয়তর ফল অর্জনের জন্য তাদের নানা প্রণোদনার মাধ্যমে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কারণ, আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞে এরা সৈনিক নয়, জেনারেলের ভূমিকা পালন করবে। বুয়েট ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দল, যারা এই মর্যাদাকর প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরল, তাদের অভিবাদন।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন