বিপ্লবীরা যেন ঘুমিয়ে না পড়েন, বিভক্ত না হন
30 August 2024, Friday
৫ আগস্ট সকালে সত্যিই লাখো আবাবিল ঢাকার সড়কে নেমে এসেছিল। পুরো বাংলাদেশ একটা শপথের সুতায় গাঁথা হয়েছিল। অনেকেই সেদিন পরিবারের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়েই ময়দানে নেমেছিল। সেই ময়দানে যদি কেউ বলত, ‘তুমি কে আমি কে’। সবাই একই উত্তর দিত, ‘আবু সাঈদ আর মীর মুগ্ধ’। তারপর যা হলো, তা বিশ্বের বিস্ময়। এ নিয়ে এখন অনেক গবেষণা হবে। কিন্তু এখনও নতুন বাংলাদেশের জমিন পরিষ্কার হয়নি। জমিন পরিষ্কার করতে হলে তো আগে নজর পরিষ্কার করা লাগে। যিনি শেখাবেন সেই শিক্ষকদের তো আগে নতুন করে শিখতে হবে। পুরোনো চিন্তা ও রাজনৈতিক অভ্যাস দিয়ে এই নতুন বাংলাদেশকে চেনা কঠিন, সামনে এগিয়ে নেওয়া পরের কথা।
আগস্ট মাসজুড়ে দেয়ালের লিখন বারবার বদলেছে, সাপলুডু খেলাও কম দেখা হলো না। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন আর এক সুতায় গাঁথা নেই। প্রতিটি শক্তি অন্য শক্তিকে ছাপিয়ে বড় হতে চাইছে। ইংরেজিতে যাকে বলে ফ্রাগমেন্টেশন বা খণ্ড খণ্ড হওয়া– সেটা দেখা যাচ্ছে। যে যার যার স্বল্প বা মাঝারি পাল্লার দুরবিন দিয়ে যা দেখছেন, বর্তমানের ঘাড়ে সেটাই চাপাতে চাইছেন। কেউবা আগে নয়া সংবিধান চান, কেউবা চান তড়িঘড়ি নির্বাচন। দুটি চাওয়াই ন্যায্য, কিন্তু কোনটা আগের ধাপ আর কোনটা পরে, সেটা ঠিক হয়নি। সে জন্যই বিতর্ক উঠছে আর পড়ছে। ফলে জাতীয় সংহতি কমজোরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। মাঝখান থেকে মজা নিচ্ছে ফজা ভাই গ্রুপ। রাতের ডাকাতের চেয়ে দিনের ডাকাতরা বেশি সেয়ানা।
এই ফ্রাগমেন্টেশনের একটা লক্ষণের কথা বিএনপি মহাসচিব তুলেছেন। তাঁর অভিযোগ ২৮ আগস্টের সমকালের সাক্ষাৎকারে ছাপা হয়েছে। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া সংস্কার অসম্ভব। একই সঙ্গে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে বিরাজনীতিকীকরণের, মাইনাস টু ঘটনের ছায়া দেখার আশঙ্কাও জানিয়েছেন। এদিকে সরকার গঠনের ২১ দিনের মাথাতেও ১৫ বছরে রাজপথে থাকা সব দলের সঙ্গে সরকারের কথা হতে পারেনি। তবে, সমকালে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের জেরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের বৈঠকটি হয়েছে। সরকারে যারা বসেছেন তাদের অভিপ্রায় নিয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু অনভিজ্ঞতার প্রশ্নটা রয়ে যাচ্ছে, রয়ে যাচ্ছে অংশগ্রহণমূলক ইনক্লুসিভিটির কথা। তাছাড়া ১৫ বছরের জঞ্জাল এক মাসেই সাফ করা যাবে না। মারাত্মক রকমভাবে নষ্ট করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহসাই দেশ গড়ার কাজে লাগিয়ে দেওয়া যাবে– তেমন আশাও অবাস্তব। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা দূর করতে হলে, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সরকারের তরফেও সংস্কারের রূপরেখা এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ জানিয়ে রাখলে তো অসুবিধা নেই। সরকারের মেয়াদ নিয়েও এখনই চূড়ান্ত কথা কেউ বলতে পারবে না। সরকার যত জরুরি ও গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নেবে, জনগণ ততই তাদের মেয়াদ বাড়িয়ে দেবে। যাতে তারা অর্থনীতি উদ্ধার এবং রাষ্ট্রের মেরামতটা ঠিকঠাক মতো চালিয়ে যেতে পারেন।
জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই জীবন ঘড়ির কাঁটা মৃত্যুর দিকে ঘুরতে শুরু করে। তেমনি বিপ্লবের মধ্যেই জন্ম নেয় তার সহোদর যমজ– প্রতিবিপ্লব। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান যে মুহূর্তে বিজয়ের চূড়ায় পৌঁছাল, সেই মুহূর্ত থেকেই প্রতিবিপ্লবের ভয় জন্মাল। তাই সফলতার পর কেউ ঘুমিয়ে পড়ে না, সফলতাকে পাহারা দেয়। এবং কেউ ঘুমিয়ে নাই। ছাত্ররা ফ্যাসিবাদ মোকাবিলার পর রাজনৈতিক বন্যার ক্ষতি মোকাবিলায় নেমে পড়েছে। সরকার পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চালু করেছে। কেউ বসে নাই। দেশের নিরাপত্তা বাহিনীও ১/১১-এর ভুল আর করতে চায় না বলেই মনে হচ্ছে। তবে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চয়ই তাদেরও একটা অবস্থান আছে।
জনগণের প্রতিপক্ষও কিন্তু ঘুমিয়ে নেই। তারা তাদের ব্যর্থতার কারণগুলো বুঝে নিয়ে বিপ্লবকে ভেতর-বাহির থেকে দুর্বল করে দেওয়ায় তৎপর। নতুন নতুন নাটকের পাণ্ডুলিপি হাজির হচ্ছে আবার তা ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে পরাস্তও হচ্ছে। উত্তেজনা থেমে গেলে পরে নামতে হয় শীতল হিসাবনিকাশে। দেখা যাচ্ছে, বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেন কারও কারও কাছে মুখ্য নয়। যার যার ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিল করাই যেন বড়। শুরু হয়েছে অস্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। প্রথমে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করল। বিএনপির দিক থেকে তার জবাবও এলো। এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা এখনও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে নিজেদের ভিশন বা কর্মসূচি ঘোষণা করেনি।
সন্দেহ নেই, সংস্কার ও পুনর্গঠনের দায়িত্ব ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। এবং এ সরকারের ম্যান্ডেট মোটেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো না। নির্বাচন দিয়ে বিজয়ী শক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যেই তারা আটকে থাকবেন, সেটা আত্মদানকারী ছাত্র-জনতাসহ দেশবাসী আশা করে না। কিন্তু সংস্কার কাজ করার জন্য তাদের তো অবশ্যই রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে হিসাবে নিতে হবে। তাদের জনপ্রিয়তা টলে যেতে পারে যদি শক্ত রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি তারা তৈরি করে নিতে না পারেন। সেটা তো আর নতুন দল বানিয়ে করা যাবে না, সেই সময়ও হাতে নেই। সেটা করতে হবে বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সেরা অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে। তারা কাদের প্রতিনিধিত্ব করেন আর কাদের করেন না, সেই চালচিত্রটা পরিষ্কার হতে হবে। নইলে বিপদ ঘনিয়ে আসতে সময় লাগবে না।
এ রকম এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে ছিল ফরাসি দেশ। ১৭৮৯ সালের জগদ্বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লব নব্বই দিন টিকে ছিল। বিপ্লবীদের বেশির ভাগ নিজেদের হাতেই গিলোটিনে নিহত হন। বাকিদের পরাস্ত করে নতুন রূপে ফিরে আসে রাজতন্ত্র। বিপ্লবের ৯১ দিন থেকেই অস্থিরতা শুরু হয় এবং ৮ বছরের মাথায় নেপোলিয়ন বোনাপার্টের হাতে আবার নতুন এক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৮৯ সালের পরাস্ত সেই ফরাসি বিপ্লব দ্বিতীয়বার মাথা তোলে ১৮৪৮ সালে। দ্বিতীয় বিপ্লবের বিপ্লবী শক্তিগুলোর অন্তর্কোন্দলকে চতুরভাবে কাজে লাগিয়ে নিজেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এবং পরে সম্রাটের আসনে ভূষিত করেন নেপোলিয়নের ভাগনে লুই বোনাপার্ট। তিনি এটা পেরেছিলেন বিপ্লবী শক্তিগুলোর অনৈক্যের ফাঁকতালে। যখন কোনো একটি পক্ষ বাকিদের থেকে শক্তিশালী হয়ে নেতৃত্ব কায়েম করতে পারছিল না, তখন লুই ফিলিপ বোনাপার্ট– একজন শেয়ার ব্যবসায়ী এবং সম্রাট নেপোলিয়নের ভাগনে– বিভিন্ন পক্ষের কাজিয়ার সুযোগে ডিক্রির পর ডিক্রি জারি করে নিজেকে দ্বিতীয় রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট এবং সেখান থেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। ফিরিয়ে আনেন বিপ্লবে পরাজিত বড় বড় সামন্ত, বড় বড় সেনাকর্তা এবং শিল্পপতিদের। এভাবে একজন মধ্যমমানের উদ্ভট লোক হয়ে যান বীর। হেরে যায় বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী, উঠতি মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিক ও কৃষকরা। এটা দেখেই কার্ল মার্কস তাঁর বিখ্যাত লুই বোনাপার্টের দ্বিতীয় ব্রুমেয়ার নামের বইয়ে লিখেছিলেন, ইতিহাসের প্রতিটি চরিত্র দুইবার হাজির হয়। প্রথমবার ট্র্যাজেডিরূপে, দ্বিতীয়বার পরিহাস হিসেবে। প্রথম বীর নেপোলিয়নের জায়গায় আসেন সুযোগসন্ধানী ভাগনে নেপোলিয়ন। দ্বিতীয় নেপোলিয়নের আমলেই ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের প্রথম মহড়া অনুষ্ঠিত হয়, পরে তা ভয়াল রূপে ফিরে আসে জার্মানিতে।
ছাত্র বিদ্রোহীরা একবার সারাদেশকে এক করে ফ্যাসিবাদকে মাটিতে নামিয়ে এনেছিল। এখনও তারাই ঐক্যের প্রতীক। আশা করি পরিবর্তনের এই বর্শার ফলা কোনোভাবেই লক্ষ্য হারাবে না। বিভক্তির চিড়কে তারাই আবার জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে বুজিয়ে দেবেন– দেশকে পথ দেখাবেন। হাজারো মানুষের শহীদানে পাওয়া ট্র্যাজিক বিজয় কোনো অবস্থাতেই পরিহাসে পরিণত হতে পারে না। আমরা আশার পুনর্দখল করেছি, ইতিহাসের পুনর্জন্মও দেখে যেতে চাই।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন