চার পেয়ে প্রাণীরা দৌড়বাজ হয়। যেমন হরিণ, চিতা বা ঘোড়া। সরকারি চাকরির দৌড়ে আপনাকে চারটি পায়ের মালিক হতে হবে। দুটি জন্মগত পায়ের সাথে লাগাতে হবে কোটাজাত আরও দুটি পা। যত মেধাবীই আপনি হোন, রাত জেগে যত তথ্যই মুখস্থ করুন, হেরে যাবেন। কোটার কাঁটায় পা রক্তাক্ত হবে, দৌড়াতে হবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি কোটার কাছে অন্যদের নাতি-নাতনিরা কোনোভাবেই পারছিলেন না। এ কথাটা প্রতিটি পরিবারের বুকে বেজেছিল যে, সন্তানদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধার বৈষম্য রাখা যাবে না। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এ জন্যই জয়ী হয়েছিল। এই সর্বজনীন দাবিকে স্বীকার করে নিয়ে সরকার বিচক্ষণতার প্রমাণও রেখেছিল। সবাই ভেবেছিল, একটা সুন্দর সুরাহা হলো।
কিন্তু আমরা ক্ষত শুকাতে চাই না, পুরানা ঘায়ে মলমের বদলে লবণই আমাদের পছন্দ। সমাজে অহেতুক ফ্যাসাদ ও বিভক্তি জারি রাখার সুবিধা বিস্তর। তাতে করে পুরোনো বৃত্তেই ঘুরপাক খাওয়ানো যায়। অনেকটা বাঁদরের তৈলাক্ত লাঠি বেয়ে ওঠার মতো। অতএব, ২০১৮ সালে বৈষম্যমূলক কোটা-সুবিধা বাতিলের পরিপত্রের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করা হলো। ৩ বছর পর আদালত এখন খোদ কোটা বাতিলের ফরমান খারিজ করে দিলেন।
পুরোনো হতাশা আবার জেগে উঠল। যাদের পরিবার সম্পদশালী না, যাদের জন্য কোটা সুবিধার দরজা খোলা নাই, যাদের বিদেশে বেগমপাড়ায় বাড়ি বা দেশে ১৪ লাখ টাকায় ছাগল কেনার মুরদ নাই, তাদের বুকের ধিকিধিকি আগুন আবার জ্বলে উঠল।
তারা দেখল, তাদের হাত ফকফকা ফাঁকা। বংশপরিচয়, রাজনৈতিক ‘কানেকশন’ কিচ্ছু নাই। পুঁজি বা সম্বল বলতে আছে শুধু কয়েকটা ডিগ্রি। এটাই ছিল চাষাবাদে মানুষ হওয়া সন্তানদের একমাত্র হাতিয়ার। ‘শিক্ষা’ ‘শিক্ষা’ ‘শিক্ষা’ বলে দেশটাকে মাতিয়ে তোলা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। মানুষ জিনিসটাকে মনের ভেতর নিয়েছিল এবং শিক্ষার জন্য জানবাজি রেখে দেশটাকে বদলে দিয়েছিল। আজ তারা দেখছে যে, না, পিতার কষ্টার্জিত আয়ে কেনা শিক্ষার দাম চাকরি বাজারে নাই। সাবেককালের বংশ কিংবা বর্ণের দেমাগের জায়গায় এসেছে কোটা সুবিধার ধমক। এটা বৈষম্য, এটা অপমান।
এই বৈষম্যের কারণে জমিদার-বাবুদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না বাংলার কৃষক সন্তানেরা। প্রান্তিক মুসলিম শ্রেণির লোক বলে শিক্ষায় তারা নবীন, চাকরিতে পিছিয়ে, মান-মর্যাদাতেও খাটো। এই বৈষম্যের জন্যই দেশভাগ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। কিন্তু ৫২ সালে এসেই তারা বুঝতে পারল, পাকিস্তানের বনেদি পরিবারেরা নতুন জমিদার হয়ে বসেছে। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধেই মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হলো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পরও প্রতিটি নতুন প্রজন্ম দেখছে, দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বিকট বৈষম্য। তাদের জন্য সুযোগের দরজা আরও সংকুচিত। নব্য জমিদারি ফিরে আসছে নতুন চেহারায়। তারা আবারও আন্দোলনে নামল।
কোটা ব্যবস্থা ফিরে আসা মানে, মেধাবীদের ১০০টি পদের ৫৬টিতেই অযোগ্য হয়ে যাওয়া। তা ছাড়া কোটার মধ্যে বেশির ভাগ সময় যোগ্য লোক পাওয়া যায় না। প্রতিবছর কয়েক হাজার পদ শূন্য থেকে যায়।
ওদিকে বাবার মুখ ব্যাজার, মায়ের ফোন: কী রে, তোর কিছু হলো? প্রবাসী ভাইয়ের পাঠানো টাকা, বাবার ধান বেচা আয়, নিম্নমধ্য পেশা বা ব্যবসার আয়ে এরা প্রতিপালিত। বহুল বন্দিত ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হওয়ার বিজ্ঞাপন দেখে তারা ভাবে, আমাদের উন্নতি কই গেল?
আজ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের ঘরে গঞ্জনা, বাহিরে বঞ্চনা। সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস-এর ২০২২ সালের প্রতিবেদনমতে, প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। তারা পড়াশোনায় নেই, কর্মসংস্থানেও নেই; এমনকি কোনো কাজের প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সসীমার এই নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৩ ভাগের ২ ভাগই বেকার। অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করা ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই বেকার থাকছে। ভারতে এই হার মাত্র ৩৩, পাকিস্তানে ২৮, নেপালে ২০ আর শ্রীলঙ্কায় মাত্র ৭ দশমিক ৮।
এই তরুণেরা কী করবে? নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সাগরের তলে মরে পড়ে থাকবে? তারা কি বেনজীর-মতিউরের পথ ধরবে? তারা পথ খুঁজে পাচ্ছে না। ২০১৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম থেকে করা জরিপেও দেখা যায়, ভালো জীবনযাপন ও পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণ দেশ ছাড়তে চায়। ব্রিটিশ কাউন্সিলের করা জরিপেও প্রায় হুবহু চিত্র ফুটে উঠেছিল। তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের ২০২১ সালের এক জরিপ জানাচ্ছে, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের ৬১ শতাংশই বিষণ্নতায় ভুগছে। বিসিএস দিতে না পারায় বা সেখানে চাকরি না হওয়ায় তরুণেরা আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে। ১০০ জনের যে ৮২ জন বিদেশ যেতে চায়, তারা হয়তো কোটা সুবিধার শিকারদের অংশ। এদের প্রতি কেন সরকারের কোনো রহমবোধ থাকবে না!
আন্দোলনকারীরা কিন্তু কোটা একেবারে বাতিল দাবি করেনি। বলেছিল, মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ মোট কোটার ভাগ ১০ রাখা হোক। কিন্তু সরকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়ার মাধ্যমে নতুন বিরোধের বীজ রোপণ করা হলো। যদি ৫ ভাগও মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল থাকত, তাহলে আজকে নতুন করে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ কমে যেত।
অনেকে বলবেন, বিসিএস দিয়ে আমলা হয়ে দুর্নীতি করবার জন্য এত কিছু! হাসতে হাসতে জবাব দেওয়া যায়, দুর্নীতির সুযোগটাও তাহলে শুধু মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের জন্য? তাতে কি মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তি বাড়ে, না কমে? আর গম্ভীর ভাষায় বলব, দুর্নীতি করা না-করা তো সিস্টেমের বিষয়। সিস্টেম ঠিক হলে মানুষও ঠিক হতে বাধ্য হবে। বরং আমলাতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ন হলে, সরকারি চাকরির মেধাভিত্তিক বণ্টন হলে দেশ কিছু দক্ষ আমলা পেতে পারবে। মূল কথা রাষ্ট্রীয় সুযোগের সমবণ্টন।
কিন্তু কেন তা করা হয় না? না করার ফায়দা বিপুল। কোটা ব্যবস্থার নামে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী যদি নিজস্ব লোক দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ভরাতে পারে, তাহলে একচেটিয়া ক্ষমতা অনেক টেকসই হয়। আমাদের মতো দেশে সরকারই সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা। সরকারি চাকরি আকাশের চাঁদ। সেটা হাতে পেলেই কেল্লা ফতে। কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারি চাকরির লাগাম ধরে রাখার এই সুযোগ ক্ষমতাশালীরা তাই ছাড়তে চায় না।
কোটা সংস্কারের পাশাপাশি এই দিকটা নিয়েও হবু আমলাদের ভাবতে হবে। ভাবতে হবে যে, এতগুলি অপ্রয়োজনীয় মন্ত্রণালয় এবং এত বড় আমলাতন্ত্রের দরকার আছে কিনা আমাদের। তার ওপর যখন সরকারি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সুবিধা, দায়মুক্তি এবং রাজকীয় সম্মান দেওয়া হয়, তখন তাদের সঙ্গে জনগণের বিচ্ছেদ ঘটে যায়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাই (অনুন্নয়ন খাত) বাজেটের একক বৃহত্তম খাত। যে দামে আমরা আমলা পুষি, সেই মানের সেবা কি জনগণ পাচ্ছে? আজকের আন্দোলনকারীরা যেন এই জরুরি ব্যাপারটাও খেয়ালে রাখে। না হলে লঙ্কায় গিয়ে রাজা হওয়ার গল্পটাই দুঃখী জনগণের আবারও মনে পড়বে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন