রুশ পুতুল মাতৃওস্কার সংসার ও পরিবারতন্ত্রের গল্প
15 May 2024, Wednesday
গাধা ও ঘোড়ার মিলনে যে প্রাণীর জন্ম, তার নাম ‘খচ্চর’। সুকুমার রায় অবশ্য হাঁস ও সজারুর মিশেলে অদ্ভুত এক প্রাণীর চেহারা কল্পনা করেছিলেন, যার নাম হাঁসজারু। আর রাজনীতি ও অর্থনীতির মিলনে যে ক্ষমতার সৃষ্টি, তার নাম দেওয়া যায় ‘পরিবারতন্ত্র’। আমি মন্ত্রী বা এমপি হলে আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-ভাই-ভাতিজাদের বানাব উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ইত্যাদি। সবই হবে ‘আমরা আর মামুরা’ ব্যাপার। এবং ব্যাপারটার সঙ্গে বেশ লাগসইভাবে মিলে যায় রুশ পুতুল মাতৃওস্কার সুরত। মাতৃওস্কা হাতে নিলে প্রথমে মনে হবে একটাই যেন নারী পুতুল। কিন্তু পেটের অংশ খুললেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে একই রকম আরেকটা পুতুল। এভাবে তার পেট থেকে বের হবে আরেকটা ছোট পুতুল। সেটার পেট থেকে আরেকটা। রাশিয়ার বাজারে এ রকম ৮ থেকে ১২টি পুতুলের ‘মাতৃওস্কা সেট’ কিনতে পাওয়া যায়। সবারই চেহারা একই রকম, সবাই যেন একই পরিবারের গুণধর সন্তান-সন্ততি।
আমাদের চোখের সামনের উদাহরণ হলো এবারের উপজেলা নির্বাচনের ভোটের ফল। পরিবারতন্ত্রের নব্য চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন। প্রথম ধাপের নির্বাচনে ১৩ উপজেলায় এমপি-মন্ত্রীর ৫২ জন আত্মীয়স্বজন প্রার্থী ছিলেন। তাদের মধ্যে বিজয়ী হয়েছেন অন্তত ১০ জন। স্বজন বলতে আওয়ামী লীগ যে পরিবারকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতেও দেখা যাচ্ছে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অন্তত ৯ জনের সন্তান এবং একজনের স্ত্রী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী রয়েছেন। দল তাদের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য করলেও দিনের শেষে তারা নিজেদের তরিকাতেই নির্বাচনে বহাল থেকেছেন। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রথম দফার নির্বাচনে এসব দেখেও শেষতক না-দেখার ভান করেছেন। আগামী দফাগুলোতেও তাদের এই ভান বদলাবার কারণ নাই।
এসব স্বজনের জয়ের জোগান দিয়ে গেছেন প্রার্থীদের ক্ষমতাসীন স্বজনেরা, যারা নাকি ইতোমধ্যে এমপি বা মন্ত্রী হয়ে গেছেন। এর বাইরেও বিজয়ীদের অনেকেই ছিলেন (স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীর) পছন্দের প্রার্থী। এসব উপজেলায় ভোটে কারচুপি, কেন্দ্র দখল, ফলাফল নিজেদের পক্ষে ঘোষণাসহ নানা অভিযোগ তুলেছেন পরাজিত প্রার্থীরা।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে কামিয়াব বলা যায় নোয়াখালীর সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। বিভিন্ন সময়ে দুর্ধর্ষ সব কাজ আর বক্তব্য রাখার জন্য তিনি বেশ আলোচিত। কথার সঙ্গে কাজের মিলের ব্যাপারেও তিনি আপসহীন। তাঁর স্বজনদের স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৯ সালে। তাঁর গ্রামের বাড়ি কবিরহাটে। প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হয়ে তিনি তাঁর স্ত্রী কামরুন্নাহার শিউলিকে কবিরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে বিজয়ী করে আনেন। পরের বছর ২০১০ সালে কবিরহাট পৌর নির্বাচনে ভাগনে জহিরুল হককে মেয়র প্রার্থী করেন। সেই থেকে জহিরুল কবিরহাট পৌরসভার মেয়র। দল রাষ্ট্রক্ষমতায়, স্বামীও সংসদ সদস্য; তাই কামরুন্নাহারেরও পরপর দু’বার উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া ঠেকানো যায়নি। এমপি সাহেব এবার ভোটের ময়দানে হাজির করেছেন সুযোগ্য পুত্রকে। এবং পুত্র জয়ীও হয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, তপশিলের কিছুদিন আগে সংসদ সদস্য তাঁর ছেলের ভোটার এলাকা বদলে কবিরহাট থেকে সুবর্ণচরে আনেন। ৮ মের নির্বাচনে ২৬ বছর বয়সী শাবাব চৌধুরীর কাছে ৭০৩ ভোটে হেরেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী। সমর্থকদের অভিযোগ, তিনি হেরেছেন ক্ষমতা, অর্থবিত্ত ও সংসদ সদস্যের প্রভাবের কাছে।
নোয়াখালী-৬ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীও একই পথের অনুসারী। তাঁর ছেলে আশিক আলী প্রথমবারের মতো হাতিয়ায় প্রার্থী হয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
নোয়াখালী থেকে আসা যাক বগুড়ার গল্পে। বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নান প্রথমবারের মতো ছেলে মোহাম্মেদ সাখাওয়াত হোসেনকে সারিয়াকান্দিতে এবং ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামান লিটনকে দ্বিতীয়বারের মতো সোনাতলায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অভিযোগ, প্রভাব খাটিয়ে, নেতাকর্মীকে ভয়ভীতি ও প্রশাসনের ওপর কৌশল প্রয়োগ করে দুই উপজেলায় নিজের সর্বাত্মক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন সংসদ সদস্য।
সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা নিয়ে গঠিত বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান। ২০২০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে প্রথমবার ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হন তাঁর স্ত্রী সাহাদারা মান্নান। পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে তিনি নিজের ভাই মিনহাদুজ্জামানকে সোনাতলায় প্রার্থী করিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। ১৬ মার্চ অনুসারী নেতাকর্মীকে বাসায় ডেকে এবার সারিয়াকান্দিতে ছেলেকে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী করার ঘোষণা দেন।
সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান রেজাউল করিম। তাঁর অভিযোগ, সংসদ সদস্য দুই উপজেলার সব সাংগঠনিক কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে স্বজনদের বসিয়েছেন। ২০১৯ সালে ভাইকে দলীয় মনোনয়নের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ দখল করেছিলেন। এবার নিজের ছেলেকে সারিয়াকান্দিতে বসিয়েছেন। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে, নেতাকর্মীকে হুমকি দিয়ে গোটা নির্বাচনী এলাকায় পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এভাবে একটি সংসদীয় আসন থেকে কয়েকটি উপজেলা মায় জেলা পর্যন্ত এক ব্যক্তির অথবা এক পরিবারের কর্তৃত্ব বহাল হওয়ার ব্যাপারটি অভিনব। এসব এলাকার প্রশাসনেরও কি পরিবারতন্ত্রের ইচ্ছার বাইরে যাবার সাধ্য হবে? প্রথম দফায় যদি ১০টি পরিবার ক্ষমতাসীন হয়, তাহলে চার দফায় কত পরিবার ক্ষমতাসীন হবে, সেই হিসাব ঐকিক নিয়মে করা যাবে নাকি বীজগণিতের দরকার হবে– তা অবশ্য এই কলমচি বলতে পারেন না।
কেন তারা এমনটা করলেন? কারণ বুঝতে গবেষক বনবার দরকার নাই। তারা স্বজনদের মাধ্যমে শুধু বর্তমান রাজত্বই নিশ্চিত করলেন না, ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীকেও এগিয়ে রেখে গেলেন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে তারাই থাকবেন ক্ষমতার দৌড়ে এগিয়ে। এর মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বের আসন, দলীয় নেতৃত্ব, প্রশাসনিক ক্ষমতা– সবই থাকবে এক ব্যক্তি বা এক পরিবারের কবজায়।
কোনো দেশের অর্থনীতি যতই মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যেতে থাকে, ততই সেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয় এবং আইনের শাসনের পথ সুগম হয়। এমনটাই রাজনৈতিক অর্থনীতির শিক্ষকেরা আমাদের শিখিয়ে এসেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ এক তেলেসমাতির দেশ। এখানে কোনো বৈশ্বিক নিয়ম বা সূত্র খাটে না। তাই দেখা যায়, দেশ যতই নাকি মধ্যম আয়ের দেশের কাতারের কাছে ঘেঁষছে, ততই এখানে কায়েম হচ্ছে পরিবারতন্ত্র।
কার্ল মার্কস পশ্চিম ইউরোপ বিশেষত ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের ইতিহাস ঘেঁটে শ্রেণি ও শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু ভারতবর্ষের সমাজ ও অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে যা পেলেন, তা ঠিক ইউরোপীয় অর্থে শ্রেণি না। তিনি পেলেন গ্রাম সমাজ এবং তার মাথার ওপর বসে থাকা রাজন্যবর্গ। এই জমিদার ও রাজা-বাদশাহদের নাম দিলেন প্রাচ্যীয় স্বৈরতন্ত্র। এই স্বৈরতন্ত্র বটেই পরিবারকেন্দ্রিক।
বাংলার ইতিহাসে এক সময় স্বাধীনচেতা বারোজন আঞ্চলিক শাসক বা বারো ভূঁইয়ার দেখা পাওয়া যায়। এদের সবার নেতা ছিলেন ঈশা খাঁ। এরা যদিও সকলে সেই অর্থে স্বৈরাচারী ছিলেন না, তাদের স্বাধীনচেতা মনোভাব প্রকাশিত হয়েছিল বাইরের শাসকদের বিরুদ্ধে। আর আজকে সারাদেশে ধীরে ধীরে জেলায় জেলায় নির্বাচিত বা নামমাত্র নির্বাচিত এবং অনির্বাচিত ভূঁইয়ার জন্ম হচ্ছে। প্রাচ্যীয় স্বৈরতন্ত্রের কায়দায় এরা সকলেই পরিবারতান্ত্রিক ক্ষমতার বলয় তৈরি করছেন। জনগণ, ভোটাধিকার হলো মৃত গণতন্ত্রের মাজারের লালসালুর মতো। গণতন্ত্র যে মৃতপ্রায় তা ঢেকে রাখতেই এই গণতান্ত্রিক লালসালুর দরকার হচ্ছে। এক সময় এই লেবাসটুকুও হয়তো ঝেড়ে ফেলা হবে।
সেই ষোলকলা পূর্ণ হতে আর কত দেরি, পাঞ্জেরী?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন