আন্দোলন দমনের তুরুপের তাস!
03 February 2015, Tuesday
এক. 'কি নিয়ে লিখব তাই ভাবছি অনেকক্ষণ। প্রায়শই এরকম হয় ভাবার সময় পাই না। কিন্তু আমি পছন্দ করি ভাবনাটাকে গুছিয়ে নিয়ে লেখা শুরু করতে। সেরকম একটি ভাবনা নিয়েই ছিলাম। কিন্তু সকালবেলার পত্রিকা ভাবনাগুলো এলোমেলো করে দিল। এক মাস হয়ে গেল খালেদা জিয়ার অবরোধ বা অফিস বাসা, 'অবরুদ্ধ-বিচ্ছিন্ন খালেদার দিনরাত।' এর পাশাপাশি 'পরীক্ষাকে আমলে নিচ্ছে না বিএনপি, বুধ-বৃহস্পতি ও শুক্রবার হরতালের চিন্তা।'
দুই. ২৪ জানুয়ারি বেগম জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেছেন মালয়েশিয়ায়। সেদিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন বেগম জিয়াকে সমবেদনা জানাতে। একদিন পর আমি গেছি। কিন্তু বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা হয়নি। তার অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন তিনি শোকে মুহ্যমান। তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। ড. কামাল তখন বিদেশ ছিলেন। দেশে ফিরলে ৩০ জানুয়ারি তিনি গিয়েছিলেন বেগম জিয়ার অফিসে। আমি গিয়েছিলাম সঙ্গে এবং সেই তখন আমি বেগম জিয়াকে দেখি।
বেগম জিয়াকে যেই সাজে আমি দেখেছিলাম এরকম বাংলাদেশের মানুষ তাকে কমই দেখেছে। কোনো মেকাপ ছিল না তার। আটপৌরে একটা শাড়ি ছিল পরনে। মুখমণ্ডলজুড়ে বেদনার ছাপ। আমরা সবশুদ্ধ সেখানে ১০-১২ মিনিট ছিলাম। এর মধ্যে ৪-৫ মিনিট তিনি কথা বলেছিলেন। কেবল তার পুত্রের স্মৃতি তর্পণ। এরকম সময় যারা থাকেন তাদেরও খারাপ লাগে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা জোগায় না মুখে। আমাদেরও সেরকম হয়েছিল। পরে যখন বাইরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ড. কামাল তখন তিনি বিরাজিত রাজনীতির ওপর কথা বলতে রাজি হননি। কিন্তু তাতে কি সাংবাদিকরা ছাড়ে? এর পর অনেকে আমাকে ফোন করেছেন। আমিও একই রকম জবাব দিয়েছি। রাজনীতি বা চলমান আন্দোলন নিয়ে কোনো কথা হয়নি সেখানে। ওই কথা বলার পরিবেশ নয়। আমি আগে লিখেছিলাম, এখন আবার বলছি প্রধানমন্ত্রী যদি সেদিন ভিতরে যেতে পারতেন, তার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার দেখা হতো সেখানেও কোনো রাজনৈতিক আলোচনা হতো বলে আমার মনে হয় না। টকশো '৭১ জার্নালেও এ প্রসঙ্গে কথা উঠেছিল। আমি একই রকম জবাব দিয়েছিলাম। সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান বলেছিলেন, আপনারা তো দুই নেত্রীর জাতীয় সংলাপের কথা বলছেন, দুই নেত্রী তো আর এমনিতে সরাসরি কথা বলবেন না। তার জন্য অনুঘটক লাগবে। যিনি বা যারা উভয় পক্ষে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনের ভূমিকা পালন করবেন। আপনারা কি সে ভূমিকা নিতে পারেন না?
পাঠক, কথা বলতে বলতে আমরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করলাম। এই লেখা লিখছি আমি ৩ ফেব্রুয়ারি। ৩-৪ জানুয়ারি দেশে অঘোষিত সরকারি অবরোধ ছিল। সেই হিসেবে দেখতে গেলে পুরো এক মাস পার হলো অবরোধের। এখন পর্যন্ত বিষয় নিষ্পত্তির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। জেদ বাড়ছে এবং তা ধীরে ধীরে চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। বেগম জিয়ার অফিসের বিদ্যুৎ সংযোগ, ক্যাবল-ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এক ধরনের জেদাজেদি ছাড়া আর কি? হতে পারে সরকারি মহল ভাবেন বেগম জিয়াকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারলে তিনি আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন এবং এতে করে আন্দোলন নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার যতই কঠোর, কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছে তার ফলাফল কি? আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ৬ জানুয়ারি টানা অবরোধ তাদের আগের দুই দিন থেকে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৪৬ জন। গতকাল রেলে ব্যাপক সহিংসতা, ট্রেন লাইনচ্যুত। ট্রেন ও বাসে পেট্রলবোমা হামলাসহ নাশকতা অব্যাহত আছে।
পাঠক, আন্দোলনটাকেও নিশ্চয়ই খেয়াল করছেন আপনারা। এটাকে কি আর গণআন্দোলন বলা যাবে? আমার এই প্রশ্নে সরকারি দল হয়তো উৎফুল্ল হবেন কিন্তু এই যে আন্দোলনের স্খলন, তার গণচরিত্র হারিয়ে ধীরে ধীরে সশস্ত্র সহিংসতায় রূপান্তরের জন্য দায়ী কে? অন্যত্র আমি লিখেছি, ১৯৭৪ সালে জাসদ যে 'গণআন্দোলনের ছেদ ঘটিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সশস্ত্র ইউনিট বিপ্লবী গণবাহিনী গড়ে তোলে তা কেন?' মজার ব্যাপার সেই জাসদের বিশিষ্ট অংশটি এখন সরকারের অংশ হয়ে এই সশস্ত্র সহিংসতার তীব্র বিরোধিতায় লেগেছে।
এই সন্ত্রাসবাদ, সহিংসতা, পেট্রলবোমার বিরোধিতা অবশ্যই করতে হবে কিন্তু একে কেবল সহিংসতা মনে করে আরও অধিক রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগ করে নির্মূল করা যাবে মনে করলে ভুল হবে। যারা কট্টর বিএনপি-জামায়াতবিরোধী তারাও এ সত্য উপলব্ধি করতে পারেন। গণজাগরণ মঞ্চ দাবি করেছিল সরকারকে রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। ইন্টারনেট জরিপে এর পক্ষে ভোট পড়েছে ৭৯.৪৯%। আর বিপক্ষে পড়েছে ১৭.৫২%। কিন্তু সরকার তার একচোখা নীতি পরিবর্তন করছে না। ফলে পরিস্থিতির অবনতি ছাড়া উন্নতি হচ্ছে না।
পত্রিকায় 'অবরুদ্ধ-বিচ্ছিন্ন খালেদার দিনরাত' শিরোনামের খবরটির কথা উল্লেখ করেছিলাম। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, এখন মোবাইল ফোন, ডিশ ও ফোন, ফ্যাক্স ও ইন্টারনেটের সুবিধা পাওয়া থেকে তিনি বঞ্চিত রয়েছেন। তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও একটি বড় দলের প্রধানের প্রতি এটা কোন ধরনের আচরণ? সবচেয়ে বড় কথা কেন এসব হচ্ছে, কোন আইনে এসব হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই সরকারের তরফে। বিদ্যুৎ সংযোগ কাটার দায়িত্বও কেউ নিচ্ছে না।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করার কোনো নির্দেশ তারা দেননি। মোবাইল ফোন অপারেটর সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিটিআরসি থেকে তারা একটি বিশেষ ঠিকানায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধের চিঠি পেয়েছেন। বিটিআরসির দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরামর্শে তারা পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কারা, যারা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর অজ্ঞাতে বা তার নির্দেশনা ছাড়াই এ ধরনের পরামর্শ বিটিআরসিকে দিতে পারে।
সবাই দুঃখিত হয়েছিলেন ঘটনায়। বেগম জিয়া বলেছিলেন তিনি স্তম্ভিত। রবিবার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতিতে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে ইন্টারনেট সুবিধা, টেলিফোন ও ডিশ ক্যাবল সংযোগ অবিলম্বে পুনঃস্থাপন করা না হলে অবিরাম হরতাল ও অবরোধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আজ যখন এ লেখা লিখছি তখন পর্যন্ত এগুলোর সংযোগ পুনঃস্থাপিত হয়নি। তবে কার্যালয়ের গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ সচল আছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবারও হরতালের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। পত্রিকায় লিখেছে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে আজ। পত্রিকার সূত্র অনুযায়ী আগামী শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও হরতাল দেওয়ার কথা চিন্তা করছে ২০ দল। বোঝা যাচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আন্দোলনের একটা দাউয়ে পরিণত হয়েছে এসএসসি পরীক্ষাটা। সরকার পক্ষ চেষ্টা করছে যেভাবেই হোক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের। তাতে বলা যাবে যে, বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। আর ২০ দল চেষ্টা করবে যেন পরীক্ষা হতে না পারে। তাতে তারা বলতে পারবে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ২ তারিখের পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়াতে কিছুটা বলার জায়গা যেন তৈরি হয়েছে তাদের। আর শিক্ষামন্ত্রী তো অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন হরতাল থাকলে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে না। হায়রে কোমলমতি কিশোর পরীক্ষার্থীরা! রাজনীতি, ক্ষমতা এতই নিষ্ঠুর যে, প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এখন বাজিতে উঠেছে। অবশ্য ঘটনা এই প্রথম নয়। ১৯৯৬ সালে এভাবে এসএসসি পরীক্ষা পিছাতে হয়েছিল দুই মাস। আমাদের অতীতের সব কিছুই গর্ব করার মতো রেখে আসিনি আমরা। কিছু আছে যা বোঝার মতো, এখন টেনে বেড়াচ্ছি। কিন্তু এতেও কি শেষ হবে এই দুঃসহ যাতনার? জেদ ছাড়বেন তারা। কথা বলবেন, সরাসরি অথবা মাধ্যম দিয়ে সমস্যার সমাধানের জন্য? অসহায় মানুষগুলোর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কি করার আছে?
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন