এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে ইমোশন প্লে করা নয়
31 January 2015, Saturday
রা ত পোহালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ছাত্রদের শিক্ষা কর্মযজ্ঞ- এসএসসি পরীক্ষা। দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ২৬৬ শিক্ষার্থী অংশ নেবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষা কি হবে? নির্বিঘেœ হবে? এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ঘুম প্রায় হারাম।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ আজ ২৭ দিন চলছে। এই ২৭ দিনে সহিংসতা ও পেট্রলবোমায় মারা গেছে ৩৮ (?) জন, গাড়ি পুড়েছে প্রায় ৪ হাজার। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ কত তা প্রতিদিনই বিভিন্ন ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরছে। কিন্তু সেটা আজকে আমার লেখার প্রতিপাদ্য নয়।
প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী দেশের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হবে কাল থেকে। তারা ঠিকমতো পরীক্ষা দিতে পারবে তো? পরীক্ষার হলে ঠিকমতো পৌঁছতে পারবে তো? পাকিস্তান থেকে এ পর্যন্ত এই জনপদের ইতিহাসে এ রকম লাগাতার সহিংসতার ঘটনা কখনো ঘটেনি। আন্দোলনে মারা গেছে অনেকে। সেগুলো আমাদের ইতিহাসের অধ্যায় হয়ে আছে। কিন্তু সম্প্রতি যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তাদের অধিকাংশ আন্দোলনের কোনো অংশ বা শিকার নয়। মরেছে অনেক সাধারণ মানুষ-দীনদরিদ্র মেহনতি মানুষ। সবচেয়ে বেশি মরেছে পরিবহন শ্রমিক। এই লেখা লেখার সময় পর্যন্ত বার্ন ইউনিটে পুড়ে জ্বলতে জ্বলতে মারা গেছে ৭ জন। পেট্রলবোমায় পুড়ে গেছে কত মানুষ।
যে অভিভাবক তার সন্তানকে পাঠাবেন পরীক্ষা দিতে তার মাথায় এখন এসব চিন্তা। আমি ধরে নিচ্ছি, যারা পরীক্ষা দেবে তাদের বয়স গড়ে ১৮ বছর। কম বয়স, এখনো দুশ্চিন্তা করার মতো অভিজ্ঞতা হয়নি। কিন্তু একেবারেই কম নয়। পত্রপত্রিকা নিয়মিত না পড়লেও টেলিভিশন তো দেখছে। তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না? আট-দশ বছর আগের ঘটনা মনে পড়ল। রাজধানী ঢাকায় হঠাৎ করেই কিশোর হত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে এবং সে হত্যার সঙ্গে আবার বন্ধু কিশোরদের জড়িত থাকতে দেখা যায়। তখন কিশোরদের মধ্যে এই ঘটনার প্রভাব লক্ষ করা যায়। রাতে ঘুমের মধ্যে কিশোর ভয়ে চিৎকার করে উঠেছে, এ রকম সংবাদ তখনকার পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
পাঠকরা বিষয়টা নিয়ে ইমোশন প্লে করা আমার উদ্দেশ্য নয়। ইতিহাসের এমন এক চৌরাস্তায় বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে যেখান থেকে কোনো রাস্তাই আমাদের নিরাপদ গন্তব্য দেখাচ্ছে না। এটা ইমোশন প্লে করার সময় নয়। সেই যে কবির কথা, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন, কা-ারি বল ...।’ কাল কিংবা তারপর যে কোনো দিন পরীক্ষা দিতে গিয়ে অথবা পরীক্ষা দিয়ে ফিরে আসার সময় কোনো পরীক্ষার্থী যদি সহিংসতার শিকার হয় তখন সে অথবা তার পিতা কি আওয়ামী লীগ করে নাকি বিএনপি করে অথবা জামায়াতে ইসলামী তা ভেবে কোনো লাভ হবে না। যে কেউ মারা যেতে পারে এই সময়।
আমি সবাইকে বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ করব। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের। তারা এবং তাদের অযৌক্তিক চেলাচামু-ারা হয়তো আমার ওপর রেগে যাবেন। বলবেন, পেট্রলবোমা মারছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকারীরা, আর আমি দোষ দিচ্ছি ক্ষমতাসীনদের। না আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে আমি একটা প্রবণতা দেখছি যে, তারা এই বিষয়টির দায় কেবল বিএনপি তথা আন্দোলনকারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করতে চাইছেন। বাংলাদেশ যেন জীবনে এই প্রথম পেট্রলবোমা দেখল। পেট্রলবোমা বা গানপাউডার ব্যবহার করে বাস জ্বালিয়ে দেওয়া, মানুষ মেরে ফেলার ঘটনা আগে ঘটেনি? যাদের বয়স হয়েছে তাদের মনে করে দেখার অনুরোধ করছি, অপেক্ষাকৃত কম বয়সিদের ইতিহাস দেখে নেওয়ার জন্য বলছি : পাকিস্তান আমলে এই ধরনের বীভৎস নৃশংসতা কি আমরা দেখেছি? অথচ তখন আন্দোলন কম হয়নি। বায়ান্ন থেকে ঊনসত্তর পর্যন্ত যে আন্দোলন এই প্রদেশের মানুষ করেছে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা তা করতে পারিনি।
স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাতাগুলোর ওপর যদি একবার চোখ বুলাই তাহলে আমরা কী দেখি? যে সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদের কথা আমরা আজ বলছি তার গোড়াপত্তন তো সেই স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই। সিরাজ শিকদার বা অন্য বামপন্থীদের কথা বাদই দিলাম। মাত্র তিন বছরের মাথায় তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে ‘গণআন্দোলনে ছেদ ঘটিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন’ তথা সশস্ত্র আন্দোলনের পথ ধরতে দেখিনি আমরা? রীতিমতো একটি গণসংগঠন ছিল জাসদ এবং মাত্র তিন বছরে দেশের একমাত্র বিরোধী দল হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। গণবাহিনী গঠন করেছিল তারা। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের উদ্বুদ্ধ হাজার হাজার মেধাবী তরুণ শ্রেণি শত্রু খতমসহ থানা ফাঁড়ি লুট করে অস্ত্র সংগ্রহের বন্ধুর পথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এখনকার জাসদ নেতারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ও শিক্ষক নিখিল চন্দ্র সাহার কথা। নিখিল ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। এক গরিব পিতামাতার সন্তান। আমরা তার নামে একটি বিস্ফোরক উৎসর্গ করেছিলাম। কারণ ওই বিস্ফোরকটি তিনিই তৈরি করেছিলেন এবং দল তার ‘প্রতিভার’ স্বীকৃতি দিয়েছিল।
কোনো দোষারোপের মধ্যে যাচ্ছি না। নিখিলসহ অজস্র মেধাবী ছাত্র কেন এই পথে গেল তার বিশ্লেষণও হাজির করার চেষ্টা করছি না। আমি তখনো মনে করতাম গণআন্দোলন ছেড়ে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ ধরা ঠিক ছিল না। আজও আমি তাই মনে করি। বিএনপি একটি বড় দল। তারা বিশ দলের একটি জোট গঠন করে আন্দোলন শুরু করেছিল। তারা যদি তা নাও করত গণতন্ত্রের লড়াই জনগণ একদিন ঠিকই সংগঠিত করত। গণতন্ত্রকে অস্বীকার করলে মানুষ যে কোনোভাবেই তার মত প্রকাশের সুযোগ খোঁজে। এই পথেই সহিংসতা তার জায়গা করে ফেলে।
আমার জাসদ রাজনীতির ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা হয়েছে। রাগ করে, হঠকারিতা, সহিংসতা করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয় না। আমার মনে আছে তখনো এ রকম বিতর্ক হয়েছিল যে, গান্ধিবাদী আন্দোলনের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। অথচ আমি তখনো গান্ধির ভক্ত ছিলাম, এখনো আছি। আর এ জন্যই বর্তমান আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা চলছে তাকে কোনোক্রমে অনুমোদন করি না। একই সঙ্গে একে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কার্যকলাপও সমর্থন করি না। সমস্যাটা আমাদের সবার। এসএসসি পরীক্ষা সুন্দরমতো অনুষ্ঠিত হতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো দেশটাই। তাই দায়িত্ব আমাদের সবার। যে কোনোভাবেই হোক, যারাই ক্ষমতায় আছেন দায়িত্বটা তাদের বেশি।
গান্ধিবাদের কোনো মূল্য কি এখন আছে? গান্ধিকে নিয়ে টানাটানি করার দরকার নেই। গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে শান্তিপূর্ণ হতে পারবে না তা আমি মনে করি না। কিন্তু সে জন্য রাজনীতির মাঠে যারা আছেন তাদের সবাইকে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতে হবে। আচরণ-উচ্চারণে গণতান্ত্রিক হতে হবে। সবার চেয়ে বড় কথা মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। মানবিক বিষয়গুলোকে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দায়ী করা ছাড়তে হবে।
দেশের মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা চাইছেন এই সহিংসতার অবসান হোক। এজন্য অবিলম্বে উভয় পক্ষ কথা বলুক। কিন্তু সরকার সে রকম দৃষ্টিভঙ্গি দেখানোর বদলে মনে হচ্ছে গায়ের জোরে জিততে চাইছে। সেদিন দেখলাম পুত্রশোকে কাতর বেগম জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। আর আজ মৃত্যুর ছয় দিন যেতে না যেতেই তার অফিসের বিদ্যুৎ সংযোগ, কেবল এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। কয়েক ছাত্রছাত্রী জোগাড় করে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে একটি মানববন্ধনও দেখানো হয়েছে।
বেগম জিয়া বা ২০ দল অবরোধের ওপরে হরতাল ডেকেছেন। কিশোর-কিশোরীদের এসএসসি পরীক্ষার জন্য ভাবছেন না। আর সরকারি দল সেটা নিয়ে রাজনীতি করছে। দায়িত্ব থাকলেও তারাও এসএসসি পরীক্ষাকে নিষ্কণ্টক, মসৃণ বানানোর চেষ্টা করছেন না।
লেখক : আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য
( আমাদের সময় )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন