সংলাপ চায় না যারা, গণতন্ত্রের শত্রু তারা
28 January 2015, Wednesday
২৭ জানুয়ারির দৈনিক পত্রিকাগুলোর খবর অনুযায়ী ৪ থেকে ২৬ জানুয়ারি এই ২৩ দিনে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৩৬ জন। আগুন লেগেছে ৩৩৬টি যানবাহনে। ভাঙচুর হয়েছে ৪৩১টি। রাতে টেলিভিশনের টকশোতে এক সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী সংখ্যা আরও বেশি। বলা যায় সংখ্যা আরও বাড়ছে- কমছে না। ইতিমধ্যে দুইজন মন্ত্রী এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুইবার বলেছেন, সাত দিনের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি একটু আগেই বলেছি, ৪ থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। প্রায় সবার চোখে-মুখে প্রশ্ন এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারবে কি? অর্থনীতিতে যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে সে কথা এখানে আর উল্লেখ করলাম না। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এবং গবেষকরা এ ব্যাপারে প্রতিদিনই তাদের বিবরণ তুলে ধরছেন। সে চিত্রও ভয়াবহ। কিন্তু যদি এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে না পারে আগামী দিনের জন্য তার চেয়ে ভয়াবহ সম্ভবত আর কিছু হবে না।
সমস্যা এখানে। এই একটি প্যারা পড়ে সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দলের নেতারা মুখিয়ে উঠবেন। বলবেন সব কিছুর জন্য খালেদা জিয়া দায়ী। তিনি মানুষের জানমাল, নিরাপত্তা, শিক্ষা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। এ বিতর্কের মধ্যে আমি আপাতত যেতে চাই না। পুরো বিষয়টাকে আমি রাজনীতির সমস্যা থেকে উদ্ভূত বলে মনে করি। কিন্তু আপাতত আমি তাদের কথা ধরে নিচ্ছি। সমস্যাটা তো বাস্তব এবং সেটার আসল সমাধান জরুরি। ২৩ দিনে তারা যে সমস্যার সমাধান করতে পারেননি বরং গভীর করেছেন সেটা তো বাস্তব। এখন কী করবেন? আবার কি সাত দিন সময় নেবেন? খেয়াল করবেন আমার এ লেখা যেদিন ছাপা হবে সেদিন থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হতে আর সাতদিন বাকি থাকবে। পারবেন এ সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান বা দমন করতে। নাকি অনির্দিষ্টকাল ধরে এ যুদ্ধাবস্থা চালিয়ে যেতে চান আপনারা।
আমার খুব অবাক লাগল সরকারের লোকদের বলতে শুনলাম যারা সংলাপ চায়, তারা প্রকারান্তরে এই সহিংসতাকেই মদদ দেয়। সেই যে কথায় বলে 'নাচতে না জানলে তার চরণ বাঁকা'। আমি এবং আমার সংগঠন নাগরিক ঐক্যসহ বাংলাদেশের অজস্র মানুষ ও সংগঠন আছে যারা ৫ জানুয়ারিকে কোনো নির্বাচন মনে করে না। এবং বর্তমান সমস্যার মূলে যে ওই নির্বাচন প্রহসন তাই মনে করে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তারা আন্দোলনকেও সমর্থন করে কিন্তু সহিংসতাকে সমর্থন করে না। ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাসীনদের দোসররা অতীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে উগ্র বল প্রয়োগের সমর্থন ও চর্চা কিভাবে করেছেন তার অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। কিন্তু এসব দল ও ব্যক্তি, যাদের কথা বললাম তারা কখনো সহিংসতাকে সমর্থন করেনি।
সহিংসতা বা জঙ্গিবাদ নিয়ে অতীতে বিতর্ক কম হয়নি। অবিভক্ত ভারতের যুগান্তর অনুশীলনের আন্দোলন, ক্ষুদিরাম সূর্যসেনের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডকে কিভাবে মূল্যায়ন করা যাবে? আজও সূর্যসেনকে নিয়ে ছবি তৈরি হচ্ছে, উপাখ্যান হচ্ছে। কিন্তু তার পরেও সূর্যসেন খুদিরামদের আন্দোলন ভারতকে ব্রিটিশ মুক্ত করেনি। রাজনীতি সব সময় যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে পেট্রল-বোমাবাজি হচ্ছে সেগুলোকে কোনোভাবেই এসব আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এগুলো নৃশংস। নিশ্চিতভাবেই অমানবিক। যে বোমায় মানুষ পুড়ে মারা যায় তাকে সমর্থন করার প্রশ্ন আসে না। কিন্তু একে দমন করার জন্য সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সেটাও তো কোনো কাজে আসছে না।
অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকেই সরকারকে আমরা দেখেছি হার্ডলাইন কথা বলতে। মন্ত্রীদের কেউ বলেছেন, নকশালী কায়দায় এগুলো দমন করা হবে। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা যে ভাষায় কথা বলেছেন তাতে তো সন্ত্রাসীদের বুকের রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হতে দেখিনি।
সরকার যে শুধু কথা বলেছে তা কিন্তু না। এই সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অপারেশনও চালিয়েছে। পত্রিকার পাতায় আরও দেখেছি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রাম থেকে কিভাবে মানুষ উদ্বাস্তুর মতো হেঁটে চলে যাচ্ছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এ পর্যন্ত কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন মারা গেছেন। আমার মাথায় আসে না স্বাধীন বাংলাদেশে এর চেয়ে বেশি আর কী করবে সরকার। লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছেন মন্ত্রী ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান। এ ব্যাপারে জনগণের পক্ষ থেকে খুব যে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে তা তো দেখছি না। এলাকায় এলাকায় ধরপাকড় চলছে তাতে ক'জন সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে তা কি সরকার বলতে পারবে? পত্রিকায় যেভাবে গ্রেফতারের খবর ছাপা হচ্ছে এগুলো যদি সত্যি হতো তাহলে তো বাইরে আর বোমাবাজ থাকার কথা নয়। অথচ অভিযোগ হচ্ছে কিছু কিছু অসাধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক একটা গ্রেফতার বাণিজ্যের জাল বিছিয়েছেন। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, আমাদের মতো দেশে যখন সামরিক আইন জারি হয় তখন মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন করে। কিন্তু এ সামরিক আইন জনগণের অপ্রিয় হয়ে উঠতে সময় লাগে না। কেন তা সবাই জানে। আমাদের যৌথবাহিনীও মাঠে নেমেছে দুই সপ্তাহেরও বেশি। দীর্ঘ সময় তাদের এই অপারেশনে রাখা কি সুখকর হবে, যদি ইপ্সিত ফল লাভ না হয়? এ জন্যই সংলাপের কথা বলছি। যেহেতু সমস্যাটি রাজনীতি থেকে উদ্ভূত, রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে। আর গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় রাজনীতিতে সংলাপের তো কোনো বিকল্প নেই।
সংলাপ না করার পক্ষে আওয়ামী লীগ এবং তার সাম্প্রতিকতম ঘনিষ্ঠ পার্টনার জাসদ এক অদ্ভুত যুক্তি হাজির করছে। যারা এই বোমাবাজি সন্ত্রাস করে তাদের সঙ্গে আবার কিসের সংলাপ। এর আগে তারা বলত, বিএনপি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে ইনডেমনিটি দিয়েছিল, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল তাদের সঙ্গে আবার কিসের সংলাপ। এখানে তো হবে টিট ফর ট্যাট। খুন বা বদলা খুন।
কি অদ্ভুত না? আওয়ামী লীগ কি বিএনপির সঙ্গে আগে বসেনি? জামায়াতিদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। সংসদীয় গণতন্ত্র চালাতে হলে কথা তো বলতেই হবে। শেখ হাসিনা বছর খানেক আগে বেগম জিয়াকে সংলাপের জন্য ফোন করেননি? এমনকি সেটা এখনো ঢালাও করে প্রচার করছে না। এই যে অতি সম্প্রতি বেগম জিয়ার কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে বেগম জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গেলেন শেখ হাসিনা, সেটা কি?
বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা যে মূল দরজার তালা খুলেননি সেটা নিশ্চয়ই অসৌজন্যমূলক। সেটা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু এটা তো ঠিক, শেখ হাসিনা দৃশ্যত বেগম জিয়ার শোক শেয়ার করতে গিয়েছিলেন। তাহলে কথা বলতে পারবেন না কেন? নাকি বেগম জিয়ার কর্মকর্তারা দরজা খুলেননি বলে আওয়ামী লীগ রাগ করে দেশের গণতন্ত্রের দরজাই বন্ধ করে দেবে, এরকম রাগ কারা করে?
এক টেলিভিশন টকশোতে উপস্থাপক প্রশ্ন করেছিলেন আমাদের দেশে সংলাপ কি কখনো সফল হয়েছে? আমি বললাম না হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি হলো কিভাবে? তখন তিনি আবার প্রশ্ন করলেন; কিন্তু হাসিনা-খালেদার সংলাপ কোনো দিন সফল হয়েছে? আমি বললাম আমরা এই দুই নারীকে মুখোমুখি সংলাপে বসতে দেখিনি। কিন্তু তাদের মধ্যে সফল কথাবার্তা হয়েছে। তা না হলে এরশাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কিভাবে হলো? কিভাবে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে আমরা সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে এলাম?
অনেক সময় আমরা আমাদের সামনে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো ভুলে যাই। নেতিবাচক প্রচারণা আমাদের বিভ্রান্ত করে। দুই নেত্রীর বিভ্রান্তিকর আচরণ ও উচ্চারণ আমাদের বিক্ষুব্ধ করে। সম্ভবত সেরকম বিক্ষোভ থেকেই প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সংলাপের ব্যাপারে নেতিবাচক বলেছেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ মন জটিল কেন সাধারণ সমস্যাও সমাধান করতে পারে না। গণতন্ত্রের পথে চলতে হলে সংলাপ ছাড়া বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি তার প্রমাণ। আমাদের পাশের পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়খন্ডে তার উদাহরণ আছে। সংলাপের কথা যারা বলছেন, তারা প্রকারান্তরে সহিংসতাকে মদদ দিচ্ছেন বলে যারা মনে করেন তাদের উদ্দেশে বলছি, উগ্র বল প্রয়োগ করে যখন ব্যর্থ হবেন তখন দেখবেন সহিংসতা জঙ্গিবাদের চাদরে ঢেকে গেছে দেশ।
লেখক : রাজনীতিক।
উৎসঃ বিডি-প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন