যদি গণতন্ত্র রাখতে হয় তবে আলোচনায় বসতে হবে
25 January 2015, Sunday
দে শ যে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০তম দিনে পা দিয়েছে বিরোধী জোটের অবরোধ। জাতীয় অর্থনীতি অচল হয়ে পড়েছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) হিসাব দিয়েছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধের ১৬ দিনে দেশের ক্ষতি হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৪৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এই অঙ্ক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৭০ শতাংশ। অবরোধের প্রথম ১৬ দিনে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা একটি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যথেষ্টর চেয়েও বেশি। ডিসিসিআইয়ের হিসাবে অবরোধের কারণে প্রতিদিন গড়ে ক্ষতি হচ্ছে ২,২৭৮ কোটি টাকা। জাতীয় অর্থনীতির এমন কোনো খাত নেই, যা অবরোধের কারণে কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পণ্য পরিবহনব্যবস্থা, ট্রাকভাড়া বেড়ে গেছে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে শীর্ষ খাত তৈরি পোশাকশিল্পে দেখা দিয়েছে বিরাট সংকট। পোশাক রপ্তানি ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছেন। জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। ঢাকার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে। পণ্য সংকট দেখা দিয়েছে বাজারে। আলোচনা প্রসঙ্গে এক ব্যবসায়ী বললেন, এভাবে চললে আর কয়েকদিন পরে ঢাকার বাজারে চালের অভাব দেখা দেবে। কথাটা সত্যি কি না জানি না। কিন্তু এটা সত্যি যে, শিম, কপি, আলুসহ ঢাকার বাজারে যে পণ্যের দাম ধরা যাক ১০ টাকা তা উত্তরবঙ্গের বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২ টাকায়। উত্তরবঙ্গের কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন।
প্রতিদিন সহিংসতায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। সংবাদপত্রের প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ৪ থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে নিহতের সংখ্যা ৩৩। এর মধ্যে আগুন ও পেট্রলবোমায় নিহতের সংখ্যা ১৬ জন। যানবাহনে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ৬৯৪। ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় যাত্রীবাহী বাসের ওপর এক পেট্রলবোমা হামলায় দুই নারীসহ ২৮ যাত্রী দগ্ধ হয়েছেন। পরদিন অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারির পত্রিকায় প্লাস্টার করা সেই দগ্ধ মানুষদের ছবি ছাপা হয়েছে। যে কেউ এই ছবি দেখতে চাইবেন না। বারবার তার সেই কবিতা মনে পড়বে, এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়। এ জন্য কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাই তো বলতাম, জীবন দিয়ে আমরা জীবন জয় করার চেষ্টা করছি।
এর মধ্যে একদিন আমি ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে গিয়েছিলাম। প্লাস্টার করা, পুড়ে যাওয়া সেই মানুষদের দিকে তাকানো যায় না। টেলিভিশনগুলো এত করে সেসব ছবি দেখিয়েছে যে, সারা দেশের মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমরা এই অসুস্থ রাজনীতি দেখতে চাই না। সেই যে ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর শাহবাগে বিহঙ্গ বাসে হামলায় আহত গীতা সেনের কথাÑ আমরা হাসিনা, খালেদা বুঝি না আমরা শান্তি চাই।
গীতা সেনের কথা আজ সারা দেশের মানুষের কথা। এক বছর আগেও তাই ছিল। অথবা যদি সময়ের ক্যানভাসকে আরও বড় করে বলি, সব সময়ই সাধারণ মানুষ এ রকমই চায়। আমিও সেই সাধারণ মানুষের দলে। কিন্তু আমাদের চাওয়ায় কি আসে যায়? কেউ কি সাধারণ মানুষের আর্তি শোনেন?
মানবতার বুকে কান পাতার বদলে ক্ষমতাসীন কী বিরোধী দল উভয়ই আজ মানবতার বুকের ওপরে চেপে বসেছেন। আমরা যে বাঙালি জাতিকে চিনতাম সংবেদনশীল, হৃদয়বান বলে সেই বাঙালি আজ রাজনীতির নির্দয় খেলার বলি হয়ে যাচ্ছে। এ কথা ঠিক পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করা আন্দোলনের অংশ হতে পারে না। এর জন্য যারা দায়ী তারা একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াবেনই। কিন্তু পত্রিকার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী নিহত ৩৩ জনের মধ্যে ১৬ জন আগুন ও পেট্রলবোমায় মারা গেছেন। বাকিরা?
বিএনপির চেয়ারপারসন, চলমান অবরোধ আন্দোলনের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, এসব বোমা হামলার অধিকাংশের জন্য সরকার দায়ী। অনেকে তার কথা বিশ্বাস করছেন, অনেকে করছেন না। তাই হয়। এই দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা প্রায়ই সত্য কথা বলেন না। একজনের দোষ আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার ঘটনা আমরা অতীতেও দেখেছি। এরা দুজন কেউই তার থেকে বাইরে নন। সিরাজগঞ্জের ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে যখন ৭-৮ জন মানুষ মারা গিয়েছিল তখনো এই একই কাহিনি শুনেছিলাম আমরা।
গত শবেবরাতে মিরপুরের কালশীর ঘটনা হয়তো পাঠকদের মনে আছে। ঘরে-বাইরে দরজায় তালা দিয়ে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। ৯ জন মানুষ পুড়ে মারা গিয়েছিল তাতে। এক রাতে। একজন কীভাবে যেন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছিল, নিহতদের মধ্যে দুটি শিশু এবং একজন গর্ভবতী মা ছিলেন। ক্যাম্পবাসীদের পক্ষ থেকে এ ঘটনার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যকে দায়ী করা হয়েছিল। এই ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং তাদের শাস্তি দেওয়ার কোনো ঘটনা আমরা জানি না।
আমার বক্তব্য হলো যারা মানুষ পুড়িয়ে মারে তারা অমানুষ। এর পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। অবশ্যই দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এই অজুহাতে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিনা বিচারে সুনির্দিষ্টভাবে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হত্যা করাও অমানবিক। এটাকে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করাও অমানবিক। ঢাকা ও চট্টগ্রামে অতিসম্প্রতি যে, বিনা বিচারে গুলি করে হত্যাকা- হয়েছে আমি তার উল্লেখ করছি না।
ঘটনা যখন ঘটতে শুরু করে তখন সরকার যৌথ বাহিনী নামিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে সরকারি মহলের কেউ হাতে-পায়ে নয়, একেবারে বুকে গুলি করে দেবেন; নকশাল কায়দায় তাদের দমন করবেন। ইত্যাদি কথা বলেছিলেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ৭ দিনের মধ্যে সব ঠিক করে ফেলবেন। সেই ৭ দিন পার হওয়ার পর আরেক মন্ত্রী সংসদে দুদিন আগে আবারও বললেন, আগামী ৭ দিনের মধ্যে সব ঠা-া হয়ে যাবে। কথা শুনে আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন, এরাও তো দেখি বেগম জিয়ার মতো কথা বলছে। বেগম জিয়া যেমন বলতেন, আগামী ঈদের পরে কর্মসূচি দেব, সেই রকম।
যাই হোক, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। আরও অবনতি হতে পারে বলে মানুষ ভয় পাচ্ছে। সরকারি দল যথারীতি বিরোধী দলের ওপর সব দায় চাপিয়ে ভাবছেন এই রাজনীতিতে এবারও তারাই জিতে যাবেন। আর বিরোধীরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। শিল-পাটায় ঘষাঘষি হচ্ছে। মরিচের মতো জনগণের জান যাচ্ছে। এ থেকে তো আমাদের বের হতে হবে। মানবতার এই ধ্বংস কি ১৬ কোটি মানুষ অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখবে আর সহ্য করবে?
সরকার পক্ষ পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অস্বীকার করায় সমঝোতার পথও খুলছে না। ফলে সংকট নিয়ে রাজনীতি চলছে। সহিংসতার ঘটনায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হামলা-মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। সংকটের সমাধান নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে।
রাজধানীতে প্রবীণ রাজনীতিক-ব্যবসায়ী নেতাদেরও নাশকতার মামলায় জড়ানো হয়েছে। রাজশাহীতে গাড়িবহরে হামলার মামলায় সিটি মেয়রকে আসামি করা হয়েছে। এই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার রাজনীতি বর্জন করতে হবে। উদ্ভূত সংকটে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠলেও এর সমাধানের চেয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শেষ করে দেওয়াই প্রাধান্য পাচ্ছে ক্ষমতাসীনদের কাছে। আমরা সহিংসতার মতোই এরও নিন্দা জানাই। দ্রুত সংকটের সমাধান চাই।
উভয় পক্ষ যেন আলোচনার টেবিলে বসতে পারে তার একটা উদ্যোগ এখনই চাই। যদি দেশে গণতন্ত্র রাখতে হয় তবে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই এবং এ জন্য উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। সেটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল।
লেখক : আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন