ছাত্র রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ফল
21 December 2014, Sunday
আ বার ছাত্র রাজনীতি লিখব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। গত ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার যে ছাত্র হত্যার বিষয় ঘটেছে, তা বাংলাদেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৪৩ বছর আগে এই দিনে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এর মাত্র ২ দিন পরে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। জাতি আজও গভীর শ্রদ্ধা ও বেদনার সঙ্গে এই দিনকে স্মরণ করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এই দিনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের কর্মসূচি নিয়েছিল। সেখানে দুই গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষে তাপস পাল নামে ছাত্রলীগের এক কর্মী মারা যায়।
চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রায় দুই যুগের ব্যাপার। অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ইসলামী ছাত্রশিবির ঢুকতে পেরেছিল তার কারণও ছিল আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। ক্যাম্পাসের বাইরে এবং চট্টগ্রাম শহরে ছাত্রশিবির তখন যথেষ্ট শক্তিশালী। ছাত্রলীগের এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য ছাত্রশিবিরকে বিশ্ববিদ্যালয় হলে জায়গা দিয়েছিল। ছাত্রশিবির সুই হয়ে ঢুকেছিল। এখন ফাল হয়ে বেরোচ্ছে। পাঠকরা জানেন, মাস তিনেক আগে সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে ক্যাম্পাসে যে আন্দোলন হয়েছিল তাতে শিবিরের প্রভাব কত তীব্র ছিল। একসঙ্গে ছাত্রলীগ তাকে মোকাবেলা করতে পারেনি। প্রশাসনকে সরাসরি মাঠে নামতে হয়েছিল। এবারের কোন্দলটিও বেশ কয়েক মাস ধরে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল তাদের।
এই সংঘর্ষের মধ্যে কোনো মতাদর্শগত বিষয় আছে? না নেই। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৫২ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছে। সীমানা প্রাচীর নির্মাণে আরও ১০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়াও প্রায় শেষের পথে। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক দুই সাধারণ সম্পাদকের কড়া ‘নজর’ রয়েছে এসব উন্নয়নকাজে। দরপত্র আর ঠিকাদারি কাজ থেকে প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিক সুবিধা নিতেই বারবার বিরোধে জড়াচ্ছে দুই নেতার অনুসারী দুটি পক্ষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনায় মর্মাহত কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, এও কি হতে পারে। যে ছাত্র সমাজ দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্তের নদীতে সাঁতার দিল তাদেরই উত্তরাধিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে নিজেদের মধ্যে হত্যাকা- চালাল। বাংলাদেশের ইতিহাস আবারও ভালো করে এক নজর দেখে নেওয়ার একটা ধারা সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্কটা শুরু করেছিল অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলো, যা এখনো চলছে। কিন্তু সে ছিল কেবল ক্ষমতার প্রশ্নে। নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য। স্বাধীনতার জন্য কার অবদান ছিল বেশি, কে ছিল স্বাধীনতার মূল নায়ক, কে ঘোষক এই ধরনের বিতর্ক। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তার অধিকাংশ ছিল নেতিবাচক। কিন্তু এখন নতুন করে কথা উঠছে। বেশ কয়েকটি প্রামাণ্য বইও লেখা হয়ে গেছে। নতুন কথা আসছে, ছাত্রদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার জন্য একটি নিউকিয়াস কাজ করছিল সেই ’৬২ সাল থেকে। এ নিয়েও অবশ্য বিতর্ক আছে। কিন্তু এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল মুখ্য। তারাই প্রথম শেখ মুজিবের দেওয়া ছয় দফাকে সমর্থন করে মাঠে নেমেছিল। তারাই সেøাগান তুলেছিল, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার যে সেøাগান জয় বাংলা তাও মাঠে নিয়েছিল তারাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা প্রদর্শন করেছিল তারাই।
এই প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনা একটি উদাহরণ হতে পারে। নিশ্চয় ছাত্র সমাজ সবাই অর্থগৃধœু, রক্তপিপাসু হয়ে যায়নি। আর এই চরিত্রের ঘটনাও একেবারে প্রথম নয়। এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন হলের ছাদ থেকে ছাত্রদের ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল, ছাত্রলীগে ছাত্রলীগে গোলাগুলি শুরু হয়েছিল তখনও সাংবাদিকরা জানতে পেরেছিল প্রধানত বিদ্যালয়ের টেন্ডারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে এই হানাহানি চলছিল। এখনো বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানেই অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে সেখানে আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াই আছে।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই তো এমন। যে কোনোভাবে অর্থবিত্ত কামাতে হবে, প্রভাব-প্রতিপত্তি, আধিপত্য বাড়াতে হবে। আর এ জন্য রাজনীতি হচ্ছে সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ। এককালে যে রাজনীতিকে মনে করা হতো দেশ সেবার ব্রত তাকে এখন স্বর্গের সোপান মনে করা হয়। প্রায় কেউই বিশ্বাস করে না যে, রাজনীতির মধ্যে মহৎ কিছু আছে, ভালো মানুষ রাজনীতি করে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, নৈতিক অধঃপতন এতটাই যে, দলের অভ্যন্তর থেকে এর বিরোধিতা তেমন একটা দেখা যায় না। ফলে দলের অভ্যন্তরে দুর্বৃত্তদের প্রভাবই বেশি। অর্থ ও পেশি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাজনীতিকদের দূর করে তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি টিআইবির এক গবেষণায় দেখা যায়, দশম জাতীয় সংসদকে যদিও সংসদ বলা যায় না, তারপরও এসব কথিত সদস্যের মধ্যেও ব্যবসায়ী ৫০ ভাগ, আইনজীবী ১৩ ভাগ, অন্যান্য ৭ ভাগ আর রাজনীতিবিদ হলেন সবচেয়ে কম। মাত্র ৬ ভাগ।
অনেকে বিশেষ করে বামপন্থীরা ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনকে আলাদা করে দেখাতে চান। এ ব্যাপারে কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমি দেখিনি। কিন্তু আমার কাছে রাজনীতি বাদ দিয়ে ছাত্র আন্দোলন খুব কমই নজরে পড়ে। সনি হত্যার বিরুদ্ধে বুয়েটের ছাত্রদের আন্দোলন, হলের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের আন্দোলন, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের আন্দোলন সরাসরি কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। ’৬০-এর দশকের শিক্ষা আন্দোলনও সরাসরি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। কিন্তু এই আন্দোলনের নেতাকর্মীরা পরে স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। এরও আগে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয় তার নেতাকর্মীরা অনেকে বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলনে এবং পরিশেষে জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নেন।
বিষয়টি জাতীয় রাজনীতির নেতাদের ভেবে দেখা উচিত। ছাত্র সংগঠনের যে নেতাকর্মীরা নিবেদিত হয়ে দলের জন্য কাজ করছে তারা ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দিলে কী করবে? তারা তো সিদ্ধান্তই নিয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নেবে। অথচ জাতীয় সংসদে মনোনয়ন পাচ্ছে মাত্র ৬%। ব্যবসায়ীরা যে অর্ধেকের মতো মনোনীত বা নির্বাচিত হচ্ছে তার প্রধান কারণ তো তাদের আর্থিক সক্ষমতা। অর্থ আছে কি না সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সেই অর্থ কীভাবে অর্জিত হচ্ছে, মনোনয়ন দেওয়ার সময় সেটা তো আর দল দেখছে না। এভাবেই অর্থ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে। আর অর্থ যে খুবই শক্তিশালী, এমনকি নিয়ন্ত্রক তা অস্বীকার করবে কে? তাই যে ছাত্রনেতা লেখাপড়ার চেয়ে বেশি করে নিবেদন করেছেন সংগঠনে তিনি রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কারণে নিজেও এক সময় দুর্বৃত্ত বনে যাবেন তাকে অস্বীকার করা কঠিন হবে।
এক টক শোতে সরকারপন্থী এক বুদ্ধিজীবীকে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখলাম। তিনি বললেন, এটা কোনো কথা হলো ছাত্ররা অর্থের প্রতি লোভ করবে কেন? আগে তো এ রকম করেনি ছাত্ররা।
এটা আমাদের একটা সমস্যা। তিনি সমর্থন করেন এই সরকারকে। অথবা বিরোধী দলকে সমর্থন করুন। কোনো নৈতিক জায়গা তৈরি না করে ছাত্রদের বা যে কাউকে এ উপদেশ দেওয়া যায় কি? সেই যে আমাদের ধর্মে রাসুলুল্লাহর উদাহরণ দেওয়া হয়। অন্য কাউকে মিষ্টি খেতে নিষেধ করার আগে নিজে মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করেছিলেন তিনি।
আমি আগে বলেছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এই সংকটটি বহু বছরের। বর্তমান সংকটটিও চলছে কয়েক মাস ধরে। দেশের ক্ষমতাধর মানুষ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংবিধানিক নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই ব্যাপারে নালিশ করা হয়েছিল। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের কি কোনো দায়িত্ব আছে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানোর, এ প্রশ্ন তুলছি না। কারণ সব জায়গায়ই তো দলীয়করণ হয়ে গেছে।
পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ছাত্রলীগের বিরোধে প্রাণহানির বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেড় বছর ধরে চলছে। বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এনেছিলাম।
পুলিশ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মকা-ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ। কি সুন্দর কথা! উনি ক্ষুব্ধ! কিন্তু ক্ষুব্ধ হয়ে করলেন কি তিনি? পুলিশ সূত্রই বলছে বিরোধ মেটানোর জন্য তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক আজম নাছিরউদ্দিনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কী করলেন তারা দুজন। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যতগুলো গ্রুপ তার সবই নাকি মহিউদ্দিন চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে। অথচ এরপরও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ঘেরা চত্বরে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে একটি ছাত্র কর্মীর মৃত্যু হলো।
কাকে দোষ দেবেন? বেগম খালেদা জিয়াকে? মুজাহিদ ইসলাম সেলিম অথবা মাহমুদুর রহমান মান্নাকে? আমার প্রশ্ন শুনে সরকারভক্ত কেউ একজন হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, আপনি বেগম জিয়াকে আড়াল করছেন। উনি বা উনার দল কি এরকম কাজ করেননি?
আমার জবাব, অবশ্যই। নব্বইয়ে বেগম জিয়া ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষাঙ্গনে এই খুনোখুনি বেড়ে যায়। তখন ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দুজন ছাত্রকে হত্যা করে মুহসীন হলের পানির ট্যাংকের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়। কিন্তু সে কথা এখন কেন? এখনকার কথা এখন। আর যদি বাংলাদেশের ইতিহাস পুরোটা বলা হয় তাহলে বলতে হবে এই উভয় দলই ছাত্র রাজনীতিতে খুনোখুনির চর্চা করেছে।
যারা প্রশ্ন করেন, ছাত্র রাজনীতির এই অধঃপতন কেন, তাদের জন্য জবাব, এটা মূলত দুই দলের যে দুর্বৃত্তায়ন তারই প্রতিফলন।
লেখক : আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন