গত শুক্রবার বিকেলে সাম্প্রতিক সার্ক সম্মেলনে যোগ দেওয়া এবং মালয়েশিয়া সফর সম্পর্কে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্যে এ কথা পরিষ্কার, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ যে মন্তব্য করেছিলেন এতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছিল। দুদিন আগে বুধবার রাতে বাংলাভিশনের মেগা টক শো ‘গণতন্ত্র এখন’-এ ওই বিষয়ই আলোচনার মুখ্য প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়ায়। আওয়ামীপন্থী দুই সিনিয়র সাংবাদিক ছিলেন (যদিও এভাবে চিহ্নিত হতে তারা রাজি হবেন না)। তারাসহ সবাই আমরা মন্তব্য করলাম, সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য শিষ্টাচারের মধ্যে ছিল না। অবশ্য এখন তারা কী বলবেন, তা আমি জানি না।
নিশা দেশাই কোনো সরকারি সফরে বাংলাদেশে আসেননি। এ কথা অন্যত্র বলেছি। যদি আসতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে প্রটোকল দেওয়া হতো, প্রাধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও হতো। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একটু দেখা যাও হয়েছে, এর ওপর কোনো সরকারি বিবৃতি নেই। এতে মনে হয়, এটিও একটি আধা সরকারি কর্মসূচি। শুনেছি, নিশা দেশাই সার্ক সম্মেলন পর্যবেক্ষণ করার উছিলায় এসেছিলেন। যে করয়কদিন ছিলেন, এর মধ্যে সংসদে তথাকথিক বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে এবং সংসদের বাইরের মূল বিরোধী নেতা (যদিও খুব কার্যকর বিরোধী আন্দোলন যে তিনি করতে পারছেন, তা পর্যবেক্ষক মহল স্বীকার নাও করতে পারেন) খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। দুই জায়গায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে। রওশন এরশাদকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, জাতীয় সংসদের পরবর্তী নির্বাচন কবে হবে। বেচারা রওশন! তিনি কি জানেন পরবর্তী নির্বাচন কবে হবে? নিশা দেশাই কি জানতেন না রওশন এরশাদের এ কথার জবাব দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই? তিনি যে বিরোধী দলের নেতা আলখেল্লা গায়ে দিতে পেরেছেন, এটিই তো এক ইতিহাস। এরপরও নিশা যে তাকে এ প্রশ্ন করেছেন, তা কি না জানার কারণে, নাকি নেহাতই রসিকতাÑ এটি বোধগম্য হয়নি আমার কাছে। এতেই কি আওয়ামী লীগ নাখোশ হয়েছে?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ, আওয়ামী লীগ তথা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশা দেশাইয়ের ওপর এত রুষ্ট কেন হলেন, এর কারণও আমাদের কাছে (বাংলাভিশনের আলোচনায় যারা উপস্থিত ছিলেন) তা স্পষ্ট হচ্ছিল না। যে তিন দিন নিশা দেশাই বাংলাদেশে ছিলেন, এর মধ্যে এমন কিছু তিনি করেছিলেন বলে পর্যবেক্ষক মহলের কাছে ধরা পরেনিÑ যাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বা এর সরকার এত নগ্ন কূটনীতিবিরোধী আচরণ করতে পারেন। রওশন এরশাদকে এই প্রশ্ন করায় আওয়ামী লীগ সরকারের এমন কিছু যায়-আসে বলে মনে হয় না।
নিশা দেশাই অবশ্য সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও দেখা করেছেন। এতে কি রুষ্ট হয়েছে সরকার? কেন নিশা দেশাই জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন? বেগম জিয়া তো এখন বিরোধী দলের নেতা নন। কোন প্রটোকলে নিশা দেশাই তার সঙ্গে দেখা করলেন? এ রকম করে ভেবেছে বর্তমান সরকার? জানি না। কেননা এ রকম কোনো প্রতিক্রিয়া সরকারের পক্ষ থেকে দেখানো হয়নি। কিন্তু সরকার যে নিশা দেশাইয়ের এই সফর শেষ পর্যন্ত পছন্দ করেনি, তা বোঝা গেছে তার চলে যাওয়ার প্রাক্কালে সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। বেগম জিয়ার সঙ্গে তার বৈঠকের ব্যাপারে নিশা দেশাইয়ের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। কিন্তু বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, নিশা দেশাই বলেছেনÑ দক্ষিণ এশিয়ায় যে আর্থসামাজিক অগ্রগতি, তা ধরে রাখতে হলে অঞ্চল হিসেবে এখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি আরও সুদৃঢ় করতে হবে। এতেও সম্ভবত সরকারে রিঅ্যাক্ট করার কোনো বিষয় থাকে না। একদিন পর ফিরে যাওয়ার প্রাক্কালে নিশা দেশাই সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য দিলেন, এতে রিঅ্যাক্ট করল সরকার। বিদেশি অতিথি বা কূটনীতিক যারা আসেন, তারা সাধারণত এ রকম সংবাদ সম্মেলন করেন। সাংবাদিকরা তাদের প্রশ্ন করেন এবং ে অতিথিরা জবাব দেন। নিশা দেশাইও সে রকম করেই সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন কবে হবেÑ এ সিদ্ধান্ত নেবে এখানকার জনগণ। আর এতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল বাংলাদেশের সরকার।
গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল একটি প্রহসন, প্রতারণা। দেশে ও বিদেশে কোথাও এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনে এই নির্বাচন জরুরি। অবিলম্বেই একাদশ সংসদের নির্বাচনের ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে। এখন সেই কথার পুরোটাই গিলে ফেলতে চাইছেন তিনি ও তার সরকার। ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনটি হতে পারবে না, তারা হতে দেবে নাÑ বিএনপির পক্ষ থেকে এ রকম ঘোষণা ছিল। ‘গণতন্ত্র অভিযাত্রা’র কর্মসূচি ছিল। এতে সূচনীয়ভাবে ব্যর্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করতে শুরু করল। একাদশ সংসদ নিয়ে আলোচনার যে কথা শেখ হাসিনাই বলেছিলেন, সেটি তুড়ি বাজিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন একাদশ সংসদের নির্বাচন হবে নির্দিষ্ট সময়েই এবং তা এই ‘স্বনির্বাচিত’ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেই। নিশা দেশাইয়ের বক্তব্য ওই কথার প্রতিফলন নয়।
যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছে। তাদের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এই নির্বাচন প্রহসনের ব্যাপারে সে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিয়েছে। আর এতেই ভয়ানকভাবে নাকচ এ স্বনির্বাচিত সরকার। না হলে সাধারণভাবে যদি কেউ বলেন, আগামী নির্বাচন থেকে শুরু করে যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এ দেশের জনগণÑ তাহলে এতে তো অন্যায় কিছু নেই। আমাদের সংবিধানেই তো বলা আছে, ‘জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক।’ তাহলে নিশা দেশাই অন্যায় কী বললেন? অথচ তার ওই বক্তব্যেই গায়ে জ্বালা ধরে গেছে বর্তমান সরকারের। ওই যে কাহিনি আছেÑ রাজাকে গণক বলেছিলেন, রাজা মশাই, আপনি ন্যাংটা। অনেকটা সেই রকম।
আগেও বলেছি, সম্প্রতি বাজারে একদল বুদ্ধি ও টক শোজীবী নেমেছেনÑ যারা বুদ্ধি খরচ করে প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো বক্তব্যকেই যৌক্তিক বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। চেষ্টা করে খুঁজে বের করেন ওই ধরনের কথাÑ যা মানুষের অনুভূতি নাড়া দিতে পারে, যেটিকে খুবই যৌক্তিক মনে হয়। কিন্তু একটু ভাবলেই দেখা যায় বক্তব্যগুলো কতখানি অন্তরসারশূন্য, প্রতরাণাপূর্ণ।
এ রকম বুদ্ধিজীবী পেয়েছিÑ যারা সৈয়দ আশরাফের ওই বক্তব্যটিও সমর্থন করছেন। বলছেন, তার বক্তব্য আরেকটু শালিন হতে পারত। কিন্তু ওই কথার মধ্যে দিয়ে তিনি যে বার্তা মার্কিনিদের কাছে দিয়েছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। আমাদের দেশ কীভাবে চলবে, নির্বাচন কবে হবে বা হবে নাÑ এ ব্যাপারে মার্কিনিরা বলার কে? তারা ভিয়েতনাম, মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে মার্কিনিদের ভূমিকার উদাহারণ দিয়ে বলেন, তারা আবার এখন গণতন্ত্রের বন্ধু হয়ে গেল! কথাগুলো এমনিতে তো সত্যি। অর্ধশতকেরও বেশি মার্কিনিরা বিশ্বব্যাপী যে ভূমিকা পালন করেছে, তা জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্রের সহায়ক ছিল না। নিজেদের আধিপত্যবাদী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অনেক অমানবিক তৎপরতাও চালিয়েছে। এসব কথাই অতীতে বামপন্থী প্রগতিশীলরা বলে এসেছেন। আওয়ামী লীগের এই অর্থে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে কোনো ভূমিকা নেই। ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার পাওয়া এবং মার্কিন প্রশাসনের বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ওপর প্রদত্ত বক্তব্যের ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকার, বিশেষ করে স্বয়ং এর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে রকম করে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বা এখনো দেখিয়ে যাচ্ছেনÑ এ রকম এর আগে কখনো কোনো উদাহারণ আছে?
মাত্র যে বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু থেকে অর্থায়ন উঠিয়ে নেওয়া হলো, তখনো তো এ সরকার তাদের কাছে মাথা নত করেছে। এক মন্ত্রী ও এক উপদেষ্টাকে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বরখাস্তও করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় মার্কিন সরকারকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, এ ঘটনাটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। আমরা তা মানতে পারতাম নাÑ যদি তিনি ওই দু’জনকে বরখাস্ত না করতেন, এরপরও বিশ্বব্যাংককে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য তদবির না করতেন। কথা বলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি এ ধরনের আচরণের মূল কারণটি জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধের জন্য সব চেষ্টা চালিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দুই আনার মন্ত্রী বলায় দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
পাঠক, বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়Ñ নিশা দেশাই সম্পর্কে কেন স্বল্প ও মিষ্টভাষী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এতখানি কূটনৈতিক সৌজন্যবহির্ভূত কটু কথা বলেছিলেন। যারা এর মধ্যে দেশপ্রেমিকতা ও জাতীয়তাবাদ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছেন, তারা মূলত ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনী প্রহসনটি আড়াল করার চেষ্টা করছেন। যদি তারা অত স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিকই হতেন, তাহলে নির্বাচনের প্রাক্কালে ভারতের বিদেশ সচিব সুজাতা সিং ৫ জানুয়ারির আগে হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে দেখা করে যে কথা বলেছিলেন, যে সামগ্রিক তৎপরতা চালিয়েছিলেনÑ এর ওপর কথা বলতেন।
লেখক : আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন