দেড় বছর আগে নাগরিক ঐক্যের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে যে পোস্টার ছাড়া হয়েছিল তার মূল বক্তব্য ছিল 'দুই নেত্রীর হাতে দেশ নিরাপদ নয়'। দেশের মানুষের মধ্যে বেশ সাড়া পড়েছিল তাতে। আওয়ামী লীগে যাদের সঙ্গে এখনো আমার হৃদ্যতা আছে (অবশ্য সম্পর্ক ব্যক্তিগত পর্যায়ে কারও সঙ্গে খারাপ হয়নি) তাদের কেউ কেউ মনে কষ্ট পেয়েছিলেন। তারা বলতে চান দুই নেত্রীই কি সমানভাবে দায়ী এ জন্য? একই রকম ভাবনা বিএনপির অনেকের মধ্যে দেখেছি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে দুই নেত্রীর কাউকেই বিশেষ করে পছন্দ বা অপছন্দ করি না। আমার যতটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে সে হিসেবে দুই নেত্রীর আলাদা মূল্যায়ন আছে। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় ৬৮০ কোটি মানুষের মধ্যে কারও সঙ্গে কারও সম্পূর্ণ মিল নেই। বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনার মধ্যে যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে সে কথা অস্বীকার করবে কে? কিন্তু ওই পোস্টারে দুই নেত্রীকে আলাদা করে কিংবা একই পাল্লায় তুলে দেখার উদ্দেশ্য ছিল না। দেশের বিরাজিত পরিস্থিতির একটি বাস্তবচিত্র তুলে ধরার জন্য এ বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। বকের মতো এক-পা দাঁড়িয়ে থাকে না সংসদ। সেখানে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংসদ তার কার্যকর চরিত্র হারায়। আমরা সবাই জানি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে সুসম্পর্ক নেই। কখনো ছিল না। এর কোনো বিশেষ কারণ নেই। এটা কেবলই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল। এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক চাটুকার জুটেছে। স্বাধীনতার পরপরই যথেচ্ছভাবে যেমন শেখ মুজিবের নাম ব্যবহারের প্রবণতা শুরু হয়েছিল, এখনো নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। তখন মুজিববাদ নামের এক উদ্ভট দর্শন প্রচারের চেষ্টা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিজে কখনো এরকম মতবাদের কথা বলেননি। কিন্তু চাটুকাররা তার ওপর ইয়া মোটা মোটা বই লিখে ফেলেছিল। মাত্র কয়েক দিন হয় এক টকশোতে শুনলাম একটি নতুন ডকট্রিন নাকি চালু হয়েছে যার নাম শেখ হাসিনা ডকট্রিন এবং এটি সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। ডকট্রিনটি কি? একজন বললেন, এই যে দুটি বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতার মধ্যে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নতির দিশা দেখিয়ে যাচ্ছেন এটাই হচ্ছে হাসিনা ডকট্রিন। হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারি না। বাংলাদেশের চারদিকে কেবল ভারতবর্ষ। সামান্য একটু অংশে আছে মিয়ানমার। দুটি বৃহৎ শক্তি কোথায় পাওয়া যাচ্ছে? হয়তো এ প্রশ্নের জবাবও তারা দিয়ে দেবেন। কিন্তু আমি তার মধ্যে যেতে চাই না। এমন কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই পাঁচ বছরে হয়নি যা একটি ডকট্রিন বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু চাটুকাররা তাই বলতে চাচ্ছে, যেমন তারা বলেছিল মুজিববাদের ক্ষেত্রে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হয়েছিলেন, যার পথ চলতে চলতে আমরা জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় দেখতে পেয়েছিলাম। তখন অনেকে জিয়াকে মুজিব হত্যার বেনিফিশিয়ারি বলতেন। এর পরে জিয়াউর রহমানও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তার স্ত্রী বেগম জিয়া দলের নেতৃত্বে এসেছেন। সেই থেকেই দুই নারী নেত্রীর ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছে। কিন্তু সেটা কখনোই এমন পর্যায়ে ছিল না যে, একজন আরেকজনকে নির্মূল করে দিতে চান। তারা একসঙ্গে পথও চলছেন। এরশাদের বিরুদ্ধে নয় বছর আন্দোলন করেছেন। নির্বাচনের পরে সংসদে দুই নেত্রী হাসতে হাসতে ভোট দিয়ে সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন করে সংসদীয় ব্যবস্থায় এসেছেন। একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলেছেন সে কথা কখনোই বলা যাবে না। কিন্তু শুরু থেকেই যে দুজনের হাতে পরস্পরের দিকে তাক করা অস্ত্র ছিল না, সেটা ঠিক। এখন পরিস্থিতির কতদূর অবনতি হয়েছে। যে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। প্রথমে চাটুকাররা বলত, এখন খোদ প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। ওদের সঙ্গে আবার কিসের বসা। কিসের আলোচনা। অথচ খেয়াল করে দেখুন ৫ জানুয়ারির আগেও প্রধানমন্ত্রী টেলিফোনে কথা বলেছিলেন বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে। চাটুকাররা এখন যে তত্ত্ব দিচ্ছে, ওরা তো হত্যাকারী, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সমঝোতা হতে পারে না, সেটা ওই টেলিফোন সংলাপের সময় কোথায় ছিল।
ক্ষমতার লড়াই যত তীব্র হয়েছে ততই ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক সম্পর্কও তিক্ত হয়েছে। সেটা এখন জাতীয় গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং এটা সর্বশেষ শুরু হয়েছে ৫ জানুয়ারি প্রহসনের পর। এই প্রহসন দিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা ক্ষমতাসীন হয়েছে। আর বাকি সবাই এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। সমালোচিত এবং নিন্দিত হয়েছে দল ও সরকার। এ সমালোচনাকে মোকাবিলা করার শক্তি নেই সরকারের। অতএব তারা আলোচনার বিষয়বস্তু পাল্টে দিতে চাচ্ছেন। জনগণের উদ্দেশে তারা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে তোমরা কি নির্বাচন চাও না উন্নয়ন চাও? কি অদ্ভুত প্রশ্ন। তাদের মাথায় আসছে না যে, বৈষয়িক কিংবা মানবসম্পদের উন্নয়ন হলে জনগণ তার আত্দা ও চিন্তার মুক্তি চায়। অতএব গণতন্ত্রকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তা মানবে কেন। তারা যদি গণতন্ত্র মেনে নেয় তবে কি নতুন করে নির্বাচন দিতে হবে? সেরকম নির্বাচন হলে তারা কি জিততে পারবে? পারবে না। আর পারবে না বলেই যারা জনগণ ও নির্বাচনের কথা বলছে তাদের ওপর মহা খাপ্পা তারা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের পতন হওয়ার এটা একটা অন্যতম কারণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে খুবই মানবতাবাদী ও গণতান্ত্রিক দেশ সে কথা কেউ বলবে না। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন ৫ জানুয়ারির এই তথাকথিত নির্বাচনকে কখনো গ্রহণযোগ্য মনে করেনি। এ জন্যই মার্কিনিদের এত অপছন্দ বর্তমান সরকারের। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে এ জন্যই কোনো সাক্ষাৎকার দেন না প্রধানমন্ত্রী। ড্যান ডব্লিউ মজিনা সারা দেশে মতবিনিময় সভা করে বেড়ান আর ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ তাকে কাজের বুয়া মর্জিনা বলে সম্বোধন করেন। অপমান করার জন্য তিনি এও বলেন, মজিনাকে নিয়ে এখন কাজের বুয়ারাও হাসাহাসি করে।
এখানেই শেষ নয়, এশিয়ার এ অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি নিশা দেসাইকেও আক্রমণ করতে ছাড়েন না সৈয়দ আশরাফ। এমনিতে সৈয়দ আশরাফ কটু কথা বলার লোক নন। অপ্রয়োজনীয় কথাও বলেন না তিনি। সেই তিনি নিশা দেসাইকে দুই আনার মন্ত্রী বলে অভিহিত করলেন। রীতিমতো বিস্ময়কর! এবং যে কোনো বিবেচনায় কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত।
আওয়ামী লীগ সরকার যে নিশা দেসাইকে চাচ্ছে না সেটা খুব স্পষ্ট। নিশা দেসাই কোনো সরকারি সফরে আসেননি। বাংলাদেশ সরকার তাকে সেরকম কোনো আমন্ত্রণ জানায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাকে কোনো প্রটোকল দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তাকে কোনো সাক্ষাৎ দেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার যে বৈঠক হয়েছে সে সম্পর্কে সরকারি কোনো ব্রিফিং নেই। এগুলো শুধু উপেক্ষাই নয়, এক ধরনের ছোট করাও। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশের সরকার। সম্ভবত এ জন্যই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সরকারের মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের এই অবজ্ঞা প্রদর্শন।
এ আচরণটি কি ভালো? সরকারি দলের কিছু কিছু নেতা এবং বুদ্ধি ব্যবসায়ীদের উল্লাস প্রকাশ করতে দেখছি। তারা বলছেন, বাপের বেটি শেখ হাসিনা। মার্কিনিদেরও পাত্তা দেয় না। হ্যাঁ, তাই মনে হয়। কিন্তু পাত্তা দেন না কেন তিনি? এরকম একটা দৃষ্টিভঙ্গি সিপিবি বা বামপন্থিদের আছে। তারা সেই থেকে মার্কিনিদের সাম্রাজ্যবাদ বলে সমালোচনা করে আসছে। আওয়ামী লীগের তো এ ধরনের নীতিগত অবস্থান ছিল না। কবে থেকে শুরু হলো সেটা? যখন থেকে তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলল। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলল। এসবই এমন অভিযোগ যে মানুষ তা বিশ্বাস করে। সরকার সেগুলোর যথাযথ জবাব দেওয়ার বদলে পাল্টা আঘাত হানলো।
এ কথা কেউ বলবে না যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ধারক-বাহক। ল্যাটিন আমেরিকা হয়ে ভিয়েতনাম থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত তাদের ভূমিকার কথা কেউ ভুলেনি। কিন্তু এ কথা তো ঠিক মার্কিনিদের সন্তুষ্ট করতে এই সরকার 'দেশপ্রেমিক' মন্ত্রী আবুল হোসেনকে বাদ দিয়েছে। উপদেষ্টা মশিউর রহমান চাকরি হারিয়েছেন। এখনো জিএসপি পাওয়ার জন্য মার্কিনিদের কাছে ধরনা দেওয়া শেষ হয়নি। যখন কোনোটাতে কোনো কাজ হয়নি তখন 'বিপ্লবী' সেজেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
বেসরকারি টেলিভিশনের এক টকশোতে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলছিলেন, শেখ হাসিনার এই মার্কিনবিরোধী ভূমিকার জন্যই তো তাকে অভিনন্দন জানানো উচিত। নিয়মমাফিক বিএনপির এক নেতা উপস্থিত ছিলেন অতিথি হিসেবে। তিনি বললেন, এই সাহসী ভূমিকা ভারতের বেলায় দেখছি না কেন? যখন ওরা ফেলানীকে গুলি করে মারছে, তিস্তার পানি দিচ্ছে না, সীমান্ত চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভূমি বিনিময়ের শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। ভাবি, সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ! ভেতরে ভেতরে বিএনপিও ভারতকে পক্ষে রাখার জন্য কত কি না করছে এবং করছে না। শেখ হাসিনা যেমন বেগম জিয়াকে জেলের ভাত খাওয়াবে বলে উঠেপড়ে লেগেছেন, তেমনি খালেদা জিয়াও শেখ হাসিনাকে গদি থেকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য সবকিছু ছেড়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে গেছেন। পর পর দুটি জনসভায় তিনি বলেছেন, আমি ক্ষমতা চাই না। অবাক করা কথা না? তিনি বলছেন, তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়ছেন। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নেই, নিজের ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার কারণে দলের মধ্যে অসন্তোষ। প্রায় সবাই বিশ্বাস করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো নিজের পরে ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেগম জিয়াও কাজ করছেন। সেই তিনি বলছেন, তিনি ক্ষমতা চান না। এ কথার কি বিশেষ কোনো অর্থ আছে? কোনো সিগন্যাল?
সরকার এবারও জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন হবে নির্ধারিত সময়ের পরে। কিন্তু মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি নিশা দেসাই ফিরে যাওয়ার আগে বললেন, জনগণ যখন চাইবে তখনই নির্বাচন হবে। এটা কি শুধু এ কথা বলা যে, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস? জনগণ কিভাবে এ সিদ্ধান্ত নেবে? মার্কিনিরা কি ভাবে? পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। সব পক্ষের এ ধরনের অনড় অবস্থান একটি অশনি সংকেত দেয়।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল :
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন