আমাকে বলতে দিন এবং হোসাইন সাগর
26 November 2014, Wednesday
দুর্নীতিবিরোধী ক্যাম্পেইন করতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন এবং একটি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। এ পর্যন্ত ৩-৪টি পেশার মানুষ এবং সিভিল সোসাইটি সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা প্রশ্ন করেছেন, যে কোনো সমাজ থেকেই পরিপূর্ণভাবে দুর্নীতি দূর করা কি সম্ভব। দুর্নীতি মানুষ করে এবং মানুষই তাকে প্রশ্রয় দেয়। রাষ্ট্র যদি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিত তাহলে কি দুর্নীতি হতে পারত? সেদিক থেকে দেখতে গেলে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন তো রাষ্ট্র ও সরকারের সামনে এসে যায়। আমি যে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের কথা বলছি সেখানে এই রাজনীতি বিবেচনা উপস্থিত নাই কেন? একজন অর্থনীতিবিদ বললেন, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন আসলে একটি স্লোগান। এর মূলগত কোনো তাৎপর্য নেই। তার মতে পুঁজিবাদী সমাজ দুর্নীতি ছাড়া এগুতেই পারে না। আর এখন এ কথা সবাই স্বীকার করে, লুণ্ঠনের মাধ্যমে আদি পুঁজি গঠিত হয়েছিল। সেই পুঁজি রক্ষা করার জন্যই রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। তিনি হব্সের চিন্তাধারার উল্লেখ করলেন।
আমি নিজেকে মূলত একজন রাজনৈতিক কর্মী মনে করি। আমি বিশ্বাস করি রাজনীতিই সমাজের নেতা। রাজনীতিই সমাজ, সমাজের সংস্কৃতি, সমাজের অর্থনীতি গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করে। অতএব আমি যেই ক্যাম্পেইনের কথা বলছি তাতে রাজনীতি একেবারে বাইরে সে কথা বলছি না। আন্দোলনটা এখনো মাঠে গড়ায়। ২৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনে বেলা ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত বসব বলে ঘোষণা দিয়েছি। কিন্তু এখনো জানি না সেই বসাটা কতখানি নির্বিঘ্ন হবে, নিষ্কণ্টক হবে। বক্তব্য এবং কর্মসূচি সংবলিত হ্যান্ডবিল বিতরণ করছি ঢাকা মহানগরে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্র কোথাও উল্লেখযোগ্যভাবে বাধা দেয়নি। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়নি।
বিস্ময় এবং বিরক্তিকর ব্যাপার একটি। আমাদের হ্যান্ডবিল যাদের হাতে গেছে কিংবা পত্রিকায় পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই একমত হবেন, এটা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়। প্রতিদিন পত্রিকায় দেশব্যাপী দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের অজস্র খবর ছাপা হচ্ছে। টেলিভিশন টকশোগুলোতে সেগুলোর ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। ২৪ তারিখ সকালেও দেখলাম একটি টেলিভিশন চ্যানেলে বিমানের দুর্নীতি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণাত্দক আলোচনা হচ্ছে। বিমানের এমডির পদত্যাগ চেয়ে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছেন রওশন এরশাদের অতি অনুগত বিরোধী দল। বিশ্বব্যাংকসহ দাতা দেশগুলো বলেছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের বদলে ফেলতে পারত যদি তা রাজনীতি থেকে বিদ্বেষ ও সহিংসতা নিমর্ূল করতে পারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নাকি বলেছেন, বাংলাদেশ কোনো কোনো দিক থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি মডেল। আরেকজন বিশ্ব নেতা বলেছেন, বাংলাদেশ অর্থনীতির বিস্ময়। নোবেল বিজয়ী ভারতের অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন স্বীকার করেছেন, অর্থনীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অধিকতর সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের ভিতরে এবং বাইরে যারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানেন তারা বলেন, বিশেষ করে দুর্নীতি ও দুঃশাসন দেশকে এগুনোর পথে বাধা সৃষ্টি করছে। খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কয়েক দফাই বলেছেন, দুর্নীতির কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এরা সবাই যদি বলতে পারে আমি বলতে পারব না কেন?
২৮ তারিখে বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি যে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছি তা একান্তই ব্যক্তিগত। এ সময়টুকু আমি দুর্নীতিকে না বলতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে থাকব। এর মধ্যে কোনো অন্যায় আছে? এতে রাষ্ট্র, সমাজের কোথাও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে? আমি যে দুর্নীতিকে 'না' বলতে চাচ্ছি তা যে সশব্দে বলতে হবে এমনও কথা নেই। নূর হোসেন মুখে যে কথা বলেছেন তার চেয়ে মুখ না খুলে বুকে-পিঠে অক্ষর উৎকীর্ণ করে আরও অনেক বড় কথা বলেছেন। এ কথা বলার জন্য আমাকে কারও অনুমতি নিতে হবে কেন? আমার কথা, চিন্তাভাবনা অন্যের সঙ্গে যাচ্ছে না, মিলছে না, তাই? একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্ন মত থাকবেই। ভিন্ন মত প্রকাশ করতে না দিলে সেটা গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্র অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। কিন্তু তার মধ্যে সংখ্যা লঘিষ্টের সম্মানজনক সহঅবস্থান থাকতে হবে।
অবশ্য আমি কর্মসূচি ব্যক্তিগতভাবে ঘোষণা করলেও আমার একটি সংগঠন আছে, সেই সংগঠন নাগরিক ঐক্য আমার এ কর্মসূচিকে সমর্থন করে। আমি যখন এ কর্মসূচি নিয়ে ঢাকার কোথাও বসব তখন তারাও আমার সঙ্গে বসতে চাইবে। কিন্তু ঢাকা শহরে তারা আর কত? খুব বেশি হলে হাজার খানেক যদি ধরে নেই এই এক হাজার মানুষই ওই দিন ওই সময় আমার সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেবেন, আমার সঙ্গে বসবেন তার জন্য কি অনুমতি নিতে হবে? শুক্রবারের বিকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোট কত লোক থাকে? তাদের সবাইকে কি অনুমতি নিয়ে উদ্যানে প্রবেশ করতে হয়? আমাকে অনুমতি নিতে হবে কেন?
আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে মাইক ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছি। ব্যাপারটি মোটেই আমার কাছে সম্মানজনক মনে হয় না। রাজনীতি অর্থনীতি বা যে কোনো বিষয় নিয়ে মাইকে কথা বলার জন্য আমাকে ডিএমপির অনুমতি নিতে হবে কেন? একই কথা আমি যখন টেলিভিশনে বলছি, পত্রিকায় লিখছি তখন তো সে অনুমতি লাগছে না। পুলিশ এখন রাজনৈতিক কথামালার গুণাগুণ বিচারের কর্তা হয়ে গেল। এটা যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। তথাপি আমি তাদের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেছি যেহেতু এরকম একটি নিয়ম চালু হয়েছে। তারা কি আমাকে অনুমতি দেবে? জানি না। না দেওয়ার তো কোনো কারণ দেখি না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অন্যরা তো জনসভাও করেন। আমি ঢাকা মহানগরে ওয়ার্কার্স পার্টির পোস্টার দেখেছি। আমি যেদিন কর্মসূচি ঘোষণা করেছি তার পরদিন তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা করবে। ওয়ার্কার্স পার্টিকে যদি অনুমতি দেওয়া হয় তবে আমাকে দেওয়া হবে না কেন? ওয়ার্কার্স পার্টি সরকারে আছে। আর আমি নেই বলে? শুধু সরকারি দল বা তাদের সহযোগীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা করতে পারবে আর বাকিরা পারবে না! খুবই খারাপ কথা।
যাই হোক তর্ক করব না। মাইকের অনুমতি না দেয় না দিক। আমি গিয়ে মন খারাপ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে থাকব। আমাকে অনেকে ফোনে, মেইলে, এসএমএসে অনুরোধ করেছিলেন মাঠে নামতে। আমি ২৮ তারিখে নামব বলে ঘোষণা দিয়েছি। আমি তা নামব। তার মানে এই নয় আমি কাউকে চ্যালেঞ্জ করছি। রাষ্ট্র শক্তির কাছে আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র একজন মানুষ। আমি যদি আড়াই ঘণ্টা উদ্যানে বসে থাকি তাতে রাষ্ট্র শক্তির একটি পিলারও কাঁপবে না। কিন্তু রাষ্ট্র যদি আমাকে বসতেই না দেয় তাহলে ধরে নিতে হবে তারা মানুষের নূ্যনতম গণতান্ত্রিক অধিকারও স্বীকার করে না। এই পরিস্থিতি মেনে নেওয়া যায় না। যারা আমাকে পরামর্শ দেন রাস্তায় নামতে তাদের অনুরোধ করব ২৮ তারিখ বিকাল ৩টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসুন। পারলে সঙ্গে দুর্নীতিকে না বলার একটা চিহ্ন ধারণ করুন। আড়াই ঘণ্টা বসে থাকব এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলব। এই শিখা চিরন্তনেই আত্দসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানের দুর্ধর্ষ সামরিক বাহিনী। আমরা সেসব নিয়ে কথা বলব। সুগঠিত শরীরের অধিকারী এবং উন্নততর সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাহিনী যে এই ক্ষুদ্র শীর্ণকায় বাঙালিদের কাছে পরাজিত হবে সে কথা কি পাকিস্তানিরা কখনো ভাবতে পেরেছিল? আজও অনেকে অনেক কিছু ভাবতে পারছে না। কিন্তু সেই ভাবনাগুলোও সত্যে পরিণত হবে।
দুই . সিলেটের ওসমানী হাসপাতালের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৫ নম্বর কেবিন থেকে এক ছাত্রলীগ কর্মী চিঠি লিখেছেন তার নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে। তার নাম হোসাইন মো. সাগর। তিনি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স ১ম বর্ষের ছাত্র। ২০ তারিখ বৃহস্পতিবার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হয় তখন তিনি সেখানে ছিলেন। গোলাগুলিতে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র সুমন চন্দ্র দাস মারা যান, আর তিনি গুলিবিদ্ধ হন। নিজেকে সাগর সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রলীগের প্রস্তাবিত কমিটির সভাপতি হিসেবে পরিচয় দেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, 'সেদিন সকাল ৯টার দিকে আমার কাছে খবর আসে, শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি অঞ্জন দাসের ওপর হামলা হয়েছে। নিজের একজন সহকর্মী ভাইয়ের ওপর হামলার কথা শুনে আমি, সুমন চন্দ্র দাসসহ ১০-১৫ জন তাৎক্ষণিক ছুটে যাই। গিয়ে সেখানে হতবিহ্বল হই। সেখানে আগে থেকে ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা বৃষ্টির মতো গুলি চালায়। ওদের গুলি আমার সামনে থাকা সুমন দাসের ওপর লাগে। সে তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাকে আনতে গিয়ে একটি গুলি আমার পেটে আঘাত করে। আরও কয়েকজন বন্ধু গুলিবিদ্ধ হয়। সুমন চন্দ্র দাস হাসপাতালে আনার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আমিসহ আরও কয়েকজন বন্ধু, শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি অঞ্জন দাস গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনো হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিহত সুমনের যাত্রী হওয়ার প্রহর গুনছি।'
চিঠি থেকে যতখানি উদ্ধৃত করেছি তাতেই হয়তো আপনাদের মন খারাপ হয়ে গেছে। বাবা-মা সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় অনেক কষ্ট করে তার লেখাপড়ার খরচ জোগান। সেই ছেলে যদি অপঘাতে মারা যায় অথবা কোনো আদর্শ ছাড়াও কেবল অন্তর্কলহে গুলি খেয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকে তবে তার কষ্ট কোনো বাধ মানে না। সাগরের বাবা অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতা। শুধু পিতাকে দেখেই ছেলে আওয়ামী লীগে উদ্বুদ্ধ। কিন্তু তাতে তার কষ্ট কমে না। বরং বাড়ে। কারণ তার সংগঠনের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিহত সুমন চন্দ্র দাস ছাত্রলীগের কেউ নন। সোহাগ তো যেনতেন প্রকারেই হোক নিজেদের ঘাড় থেকে দোষ ঝেড়ে ফেলতে চায়। কিন্তু শাক দিয়ে তো আর মাছ ঢাকা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা তাতে হৃদয়ের দাগ মোছা যায় না। গান আছে না, হৃদয়ে লেখ নাম ...। হাসপাতাল থেকে সাগর লিখেছেন- 'যখন সভাপতি বলেন নিহত সুমন চন্দ্র দাস ছাত্রলীগের কেউ নয় তখন আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।'
সোহাগের লেখার শেষ অংশটুকু আরও মর্মন্তুদ, হৃদয়বিদারক। বদিউজ্জামান সোহাগের এই ভুলকে সাগর কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। সে লিখেছে, 'আমার মনে হয় তার নামের সঙ্গে দাস না থাকলে হয়তো তাকে শিবির বলে চালিয়ে দেওয়া হতো। নেত্রী আপনার কাছে আকুল আবেদন হাসপাতালের বেডে শুয়ে, বাঁচব কিনা মরব জানি না। ... আপনি শুধু সোহাগ ভাইকে একবার বলুন আমরা ছাত্রলীগের কর্মী, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। আমাদের সেই অধিকারটুকু যাতে উনি কেড়ে না নেন।'
'হা দুঃখ, দুঃখ রে' নেত্রীরা কি এই মনোকষ্ট বুঝবেন?
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
( বাংলাদেশ প্রতিদিন )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন