অক্টোবর মাসে তৃতীয় সপ্তাহে মিলি আমাকে ফোন করল। মিলি ঢাকা ইন্ট. ইউনিভার্সিটির ইংরেজির শিক্ষক। বলল, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার নিয়ে একটা বক্তৃতামালা হচ্ছে। সে বিষয়টিতে রাজনীতিকে নির্বাচন করেছে। অর্থাৎ শেষ বক্তৃতাটির বিষয়বস্তু হবে Politics as a career. বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে বক্তৃতা করার জন্য আমার কথা ভেবেছে। আমি কি পারব?
আমি বেশ আগ্রহী হলাম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে সাম্প্রতিককালে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। অনেক অভিযোগ উঠেছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শুরু থেকেই এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এগুলোতে লেখাপড়ার খরচ অনেক বেশি, এগুলো সবই গড়ে উঠবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। এ রকম আশঙ্কা ও অভিযোগ ছিল। কিন্তু তার পরও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তা দ্রুত প্রসার লাভ করেছিল। এখন আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৯টি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এরই মধ্যেই সেশনজটে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিল, যার জন্য প্রধানত দায়ী করা হচ্ছিল ছাত্ররাজনীতিকে বা ছাত্ররাজনীতির নামে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঘোষণা দিয়েছিল তাদের ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে, যাতে কোনো সেশনজট হতে না পারে।
সেই রকমের একটি বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে বক্তৃতা করার জন্য তাদের ক্যাম্পাসে ডাকছে, তাও আবার রাজনীতি নিয়ে বক্তৃতা করার জন্য। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু মিলি বলল, আরো অনেকের নাম এসেছিল, কিন্তু প্রশাসন মনে করেছে আমি এ ব্যাপারে নৈর্ব্যক্তিক ও নির্মোহভাবে একটি নিরপেক্ষ আলোচনা ছাত্রদের উপহার দিতে পারব।
মাঝেমধ্যে এসব ঘটনায় আমি খুবই উৎফুল্ল হই। কেউ যদি কোনো ভালো কাজের জন্য আমাকে যোগ্য মনে করেন, তবে ভালো লাগবে না কেন বলুন। কিন্তু তাই বলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বক্তৃতা! মিলি বলল, আমরা ছাত্রদের ক্যারিয়ার সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে চাই। রাজনীতিও কি একটি ক্যারিয়ার হতে পারে? কিভাবে? কেমন করে? এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্ররা, যারা রাজনীতিতে আগ্রহী তাদেরই আপনার সেমিনারে দাওয়াত দিচ্ছি।
দেশ ও জনতার সেবার ব্রত রাজনীতি
শুনে ভালো লাগল আমার। রাজি হয়ে গেলাম। আমার মাঝেমধ্যে এ রকম হয়। কাজের চাপে আগপাশতলা সব ভাবার সময় পাই না। মনে করি পরে ভেবে ঠিক করে নেব। করিও তাই। কিন্তু এবার একটু বিপদে পড়লাম। এটা তো মাঠের বক্তৃতা নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের সামনে তাঁদের জীবন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা তুলে ধরা, একটি বিশেষ ঘটনা বা ইস্যু নিয়ে দ্রোহী বক্তৃতাও নয়। প্রতিবাদ করার জন্য জ্ঞান বড় বিবেচ্য নয়। ভাষা বা অলংকার না থাকলেও চলে। কিন্তু জীবনের নির্দেশিকার ওপর আবেগ দিয়ে বক্তৃতা চলে না।
ক্যারিয়ার মানে কী? অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে পেলাম Career is an occupation under taken for a significant period of a persons life with opportunities for progress.
আমি আমার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম কেউ যদি আমাকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। দুই-তিনটি মত পেলাম- সব একই রকম। তাঁরা বললেন, রাজনীতি হলো দেশ সেবা ও জনকল্যাণকর কাজ। এটা কোনো পেশা হতে পারে না। পাঠকবৃন্দ, এই হলো এ বিষয়বস্তুর জটিলতা। রাজনীতি যদি সমাজ ও জনকল্যাণের বিষয় হয়, তবে তারচেয়ে বড় মারাত্মক কাজ আর কী আছে? সেটা কি পার্টটাইম কাজ হতে পারে? আবার কেউ যদি সার্বক্ষণিক রাজনীতি করেন, তবে তাঁর পেট চলবে কিভাবে? তিনি যদি সংসারী হন (রাজনীতি তো বৈরাগ্যের বিষয় নয়), তাঁর সংসারের ব্যয় নির্বাহ করবে কে? কিভাবে? রাজনীতি তাঁকে অন্নের জোগান দেবে? আর যদি তিনি কোনো পেশায় যান, তাহলে সে পেশার প্রতি দায়িত্ব পালন করার পর তিনি রাজনীতি করার সময় পাবেন কখন?
BIU-এর প্রশাসন কিন্তু আমাকে এই আশায় নিয়ে যাচ্ছে যে আমি এই জটিলতার একটি সদুত্তর জানি। আমি দীর্ঘদিন ছাত্ররাজনীতি করেছি। ছাত্ররাজনীতিতে সর্বোচ্চ যতগুলো পদ অলংকরণ করা যায়, তার সব কিছু করেছি। কিন্তু আমি যেদিন ছাত্ররাজনীতি ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোলাম, সেদিন আমি যাব কোথায়? আমি যদি রাজনীতি করতে চাই, মূল দল (আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ যাই হোক না কেন) আমাকে গ্রহণ করলে তো? যদি বা করে, এমনকি একটা ভালো পদও দিয়ে দেয় আমার জীবিকা নির্বাহের দায়িত্ব তো তারা নেবে না। আমাকে তার জন্য চাকরি বা ব্যবসা করতে হবে। তারপর আমি সার্বক্ষণিক রাজনীতি করতে পারব কি? রাজনীতি কিভাবে আমার পেশা হতে পারে?
আমার ছেলে নিলয় আমাকে এ প্রশ্নের একটা জবাব দিল। ও কানাডায় পড়ে। ও বলল, কানাডার একটি প্রদেশে এক রাজনৈতিক দলের সভায় গিয়েছিল সে। সেখানকার সবাই নিজেদের ক্যারিয়ার হিসেবে রাজনীতির কথা ভাবে। নিলয় বলল, অক্সফোর্ডের সংজ্ঞা সঠিক নয়। কানাডার রাজনীতিতে মাস্তানি, চাঁদাবাজি নেই। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পদ লুট করে বিলাসী জীবনযাপন করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সেখানে মানুষ আছে, যারা রাজনীতিকে ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে এবং তারা কেউ না খেয়ে থাকে না।
রাজনীতি নিশ্চয়ই একটি মহৎ বৃত্তি। দেশ ও জনতার সেবা করার ব্রত। সেটা মুনাফাভিত্তিক হতে পারে না। ইউরোপ বা আমেরিকার সঙ্গে আমাদের তুলনা করছি না। সেখানে রাজনীতি করা ও বাংলাদেশের রাজনীতি করা নিশ্চয়ই এক বিষয় নয়। বাংলাদেশে বিশেষত অনুন্নত দেশগুলোতে সমাজ ও রাষ্ট্র ছাত্রদের কাছে অনেক কিছু চায়। ছাত্ররা না হলে আমাদের ভাষা থাকত না, আমরা একটা গণমুখী শিক্ষা পেতাম না, বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। মানুষের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার যখন শাসকের দুঃশাসনে লুণ্ঠিত হয়, তখন কথা বলার জন্য ছাত্রদেরই প্রয়োজন হয়। আমাদের শাসনব্যবস্থা কখনো কখনো এত হৃদয়হীন যে প্রধানমন্ত্রীর অবমাননা করা হয়েছে বলে তথ্য অধিকার আইনের বলে বগুড়ার মাদলা ইউনিয়নের এক বাদাম বিক্রেতাকে তার ছেলেসহ জেলে পুরে দেয়। অসহায় স্ত্রী দুই কন্যা সন্তান নিয়ে ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে- আমাদের গণতন্ত্র ঠা ঠা করে হাসে। এ অবস্থায় প্রতিবাদ করবে কে?
আমাদের দুই প্রধান নেত্রী ক্ষমতার মদমত্ততায় বিভোর, কিংবা বিভোর ছিলেন। থাকতেন। সাধারণত থাকেন। তখন অন্য কাউকে আর মানুষ মনে করেন না। একজন আরেকজনকে মোটেও সহ্য করতে পারেন না। একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতেও নারাজ। প্রকাশ্যে বলেন, ও আমাকে খুন করতে চায়। ওর সঙ্গে কিসের কথা?
সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারি ও বিরোধী দল দুটি পিলারের মতো। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটি চলতে পারে না। অথচ তাঁরা, একজন আরেকজনকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চান বলে অভিযোগ করেন তাঁরা নিজেরাই। তাঁদের হাতে দেশ কি নিরাপদ? দেশের জনগণ? জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার?
সারা দেশের মানুষ আজ ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতায় বাস করছে। যে নেত্রী দাবি করতেন, তিনি জনগণের ভোটের অধিকার তুলে দিয়েছিলেন- সেই তিনিই গত ৫ জানুয়ারি জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। অতঃপর এখন দম্ভ করছেন যে ৫ জানুয়ারি নিয়ে প্রশ্ন তুলে কোনো লাভ নেই। বিশ্ব ধীরে ধীরে তাঁকে মেনে নিচ্ছে। ভোট নিয়ে আর কেউ প্রশ্ন করছে না। অতএব, জনগণ তোমরাও আর এ নিয়ে কথা বাড়িও না। মেনে নাও আমাদের।
এই পরিস্থিতিতেও ছাত্রদের প্রয়োজন। বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই ক্ষমতার মত্ততা, হানাহানি, সহিংসতা এ সম্ভাবনার দ্বার খুলতে দিচ্ছে না। এখনা শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে পড়া দেশে ছাত্ররাই হলো প্রগতির ভ্যানগার্ড। আগামী দিনের নেতৃত্ব গড়ে উঠবে এই ছাত্রদের মধ্য থেকে। এই ছাত্রদের ক্যারিয়ার হিসেবে রাজনীতি গ্রহণ করার আহ্বান জানাতে চাই আমি। না হলে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে এক লোভী আমলা ব্যবসায়ীকে অথবা সামরিক জান্তাকে ক্ষমতায় বসাবে তারা?
কিন্তু আবারও সেই প্রশ্ন, তাদের চলবে কিভাবে? তাদের পেশা কী হবে? আমিই পাল্টা প্রশ্ন করলাম তাদের। বিল ক্লিনটন বক্তৃতা করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাই করেন। আমাদের এখানে মিলিয়ন ডলার কামাই করার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু শুনেছি, এক মাওলানা (যিনি সক্রিয় রাজনীতিও করতেন) কেবল ওয়াজ করেই যে টাকা কামাই করতেন তাতে তাঁর সংসার চলেও বেশি। দুই বামপন্থী নেতা তাঁদের আয়ের উৎস সম্পর্কে বলেছিলেন, টেলিভিশন, টক শো তাঁদের আয়ের অন্যতম উৎস। হতে পারে আমি এক টেলিভিশন টক শো উপস্থাপনা করে যা কামাই করতাম, তাতে আমার সংসার চলে যেত। এখন অবশ্য চলে না। কারণ, আমি আর ওই শো করতে পারি না। তবে এখনো টেলিভিশনে কথা বলে আর পত্রিকায় লিখে যা কামাই তাতে একটা মধ্যবিত্ত সংসার কষ্টেসৃষ্টে চলে যায়।
আচ্ছা টক শো করতে হবে কেন? লিখেই বা পয়সা উপার্জন করতে হবে কেন? পেশায় একজন উকিল, ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারের ক্যারিয়ার রাজনীতি হতে পারে না? ডক্টর কামাল কিংবা ব্যারিস্টার মওদুদ কী হিসেবে বড়? একজন আইনজীবী হিসেবে? নাকি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে? কোনটা তাঁদের পেশা? আর কোনটা ক্যারিয়ার?
৮৫ মিনিটের বক্তৃতা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাঞ্চ (তারাই খাওয়ালেন) করে যখন চলে আসব, তখন মিলি আমাকে একটা খাম ধরিয়ে দিল। বললাম, কী আছে এতে? স্মিত হেসে বলল, আপনার সম্মানী। পরে আমি গাড়িতে খামটা খুলেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একটা ধন্যবাদ দিতে পারতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মোহসিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, যখন আমি ডাকসুর ভিপি ছিলাম। এই বয়সেও ভারি চমৎকার লোক। খাওয়ার সময় আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক গাইবান্ধার এমপি।
তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। রাজনীতির ওপরে বক্তৃতা করে এই প্রথম আমি কিছু উপার্জন করলাম, তাও আবার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে রাজনীতি নিষিদ্ধ।
আমার রাজনীতির ক্যারিয়ারে একটি নতুন পালক যুক্ত হলো।
লেখক : আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন