রাজধানীর সরকারি বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার বিভিন্ন সূচকে বেসরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। এমন স্বীকারোক্তি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) প্রাতিষ্ঠানিক স্বমূল্যায়ন প্রতিবেদনেই পাওয়া গেছে। সরকার সব ক্ষেত্রেই সাফল্য দাবি করে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও সাফল্যের দাবিতে শিক্ষামন্ত্রী সরব। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল ফোলানো বেলুনটি ফাটিয়ে দিয়েছে। উচ্চশিক্ষায় বিশৃঙ্খলা-দুর্নীতির ছড়াছড়ি। এটা গোটা শিক্ষাব্যবস্থারই চিত্র। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায়ও ভিন্নতা নেই।
শহরের স্কুলগুলোর সক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকলেও চরম দুরবস্থার মধ্যে থেকেও গ্রামের কোনো কোনো স্কুল সাফল্যের চূড়ায় উঠে এসেছে। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ৩৪ নম্বর সিধুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পড়ালেখায় ২০১২ ও ২০১৪ সালে উপজেলার সেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মর্যাদা পেয়েছে স্কুলটি। এই সফলতার পেছনে সরকারের অবদান কতটুকু?
সিধুলী গ্রামে জমিদারদের রেখে যাওয়া ২ দশমিক ২৯ একর জমিতে ১৯১৮ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ খুবই পুরনো স্কুল। এর প্রাঙ্গণজুড়ে আছে পুরনো বট-পাকুড়, তেঁতুলগাছ, মন্দির, ঈদগাহ, কবরস্থান, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, ভূমি অফিস, প্রাণী প্রজননকেন্দ্র ও বাজার। বেশ জমজমাট অবস্থা। কোলাহলপূর্ণ। তবে শিক্ষার পরিবেশ যে নেই সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তার ওপর বিদ্যালয়ের দুটি পাকা ভবনের অবস্থাও ভালো নয়। ২০০০-২০০১ এবং ২০০৮-২০০৯ সালে নির্মিত দুটি ভবনের এখন করুণদশা। বৃষ্টি হলে ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। এমনিতেই দুই ভবনের চারটি ঘরে ৩৫২ জন শিশু শিক্ষার্থীর জায়গা হয় না। তাই স্কুল মাঠের বট-পাকুড়তলায় তিন-চারটি দলে বিভক্ত হয়ে মাদুর বিছিয়ে ক্লাস করতে হয়। বৃষ্টি হলে ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। এ রকম স্কুলের সংখ্যা এ দেশে কম নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ নেই বললেই চলে।
তার পরও সিধুলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাফল্যে সবাই খুশি। শিক্ষার্থীদের মতো অভিভাবক, স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান- সবাই এক বাক্যে এই সাফল্যের জন্য স্কুলের শিক্ষকদের কথা বলেছেন। প্রধান শিক্ষকসহ সবাই নারী। তাঁরাই নিরলস পরিশ্রমের ফলে বিদ্যালয়টিকে বিজয়ের মুকুট পরিয়েছেন। নিয়মিত পড়া আদায়, বছরজুড়েই দলভিত্তিক শিক্ষা, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর খোঁজখবর রাখার কাজটি তাঁরা নিজ উদ্যোগেই করে থাকেন।
শিক্ষার সমস্যা নিয়ে সাম্প্রতিককালে অনেক কথা হচ্ছে। সংকট যে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নয়, এর শুরু আরো নিচু স্তর থেকে, গভীরে সেটা নিয়ে খুব বেশি কথা হয়নি। সেই কথা বলার জন্য এই লেখার অবতারণা।
যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে
আরো একটা কারণ আছে এবং সেটাই মূল। একটা উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে এ রকম সমস্যা হলে যা করা হতো, তা আমরা করছি না। দরকার ছিল সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে, ঘাটতি আছে তা খুঁজে বের করে সেগুলোর সমাধানের চেষ্টা করা। আমরা সেটা না করে ভুলটাই শিকার করছি না। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করছি এই বলে, তুমি সত্যি কথা বলছ না। তুমি দেশের ক্ষতি করছ।
পরস্পরকে দোষারোপ করা আজ আমাদের জাতীয় রাজনীতির সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আজ আমার লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সেটি।
দুই.
২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধান দুই নেতা দেশের দুই জায়গা থেকে জাতির উদ্দেশে কথা বলেছেন। একজন দেশের তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বর্তমানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিকেলে নীলফামারী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর এই সরকারকে পৃথিবীর কেউ বৈধতা দেয়নি। সরকার দ্বারে দ্বারে ঘুরে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে। আর ভাবছে, বিদেশে গিয়ে ছবি তুললেই স্বীকৃতি আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু বিদেশে গিয়ে ফটোসেশন করলেই স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। গণতন্ত্র না থাকলে কেউ স্বীকৃতি দেবে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্র না থাকার এই অবৈধ সরকারকে বিদেশিরাও বৈধতা দেয়নি।
একই দিনে বিকেলে গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (তিনিও ৫ জানুয়ারির কল্যাণে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন) খালেদা জিয়ার বক্তব্যের জবাবে বলেন, আন্দোলনের নামে দেশে কোনো অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তার পরিণতি ভালো হবে না বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি আরো বলেন, এখন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায়। কাজেই ৫ জানুয়ারির আগে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় যা করা হয়েছে, এখন কোনোভাবেই তা করতে দেওয়া হবে না। এখন তারা দেশের একজন মানুষের গায়ে হাত দিয়ে দেখুক।
বলা বাহুল্য, নীলফামারীর জনসভায় বেগম জিয়া আন্দোলনের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, স্বৈরাচার এরশাদকে হটিয়েছি, এবার শেখ হাসিনাকেও হটাব। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হবে। তাই এই সরকার পদত্যাগ না করলে আন্দোলন করে তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।
বোঝা যাচ্ছে রাজনীতির মাঠ আবার গরম হতে যাচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে না পারার জন্য নিজের ও ঢাকার নেতাদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, আমি দোষ দেব আমাদের। আমি ধন্যবাদ দেব আপনাদের। আপনারা সারা দেশে কঠোর আন্দোলন করেছেন।
বিএনপি কি পারবে আন্দোলন করতে? সে জবাব সময় দেবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই পরস্পরকে দোষারোপ করা ও নিন্দাবাদ শুরু হয়ে গেছে। বেগম জিয়া এই সরকারকে অবৈধ বলেছেন (যা তিনি প্রথম থেকে বলছেন) এবং বলছেন বিশ্বের কেউই এই সরকারকে বৈধতা দেয়নি।
কথাটি বিতর্কিত হতে পারে। কারণ বৈধতা কথাটির ব্যাখ্যা থাকতে পারে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ এবং সে কারণে এই সরকারের বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু সেটার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশ্বে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ এটিই De Facto সরকার। আমি তাকে অন্তর থেকে গ্রহণ নাও করত পারি। কিন্তু জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র এভাবে দেখবে না। রুয়ান্ডা সরকার কিংবা জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারকে বিশ্ব অস্বীকার করে পরিত্যাগ করেনি।
বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে তাদের গায়ের জ্বালাও এই কারণে। সরকারের দলকানা বুদ্ধিজীবীরাও বলেন, ৫ জানুয়ারির 'নির্বাচন'টি 'সুন্দর' হয়নি। তাদেরও হতাশা আছে। কিন্তু এটা সংবিধানসম্মত। অতএব, গ্রহণযোগ্য। যেটা অসুন্দর সেটাকে সংবিধানসম্মত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার তাদের কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। সবশেষে সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমরা দেখলাম সিপিএ ও আইপিইউতে বাংলাদেশের স্পিকার এবং একজন আওয়ামী নেতার নির্বাচিত হওয়াকে হাতিয়ার বানানো।
আমি বিশেষ করে সাবের হোসেন চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাই। কোনো কারণ ছাড়াই (হয়তো কারণ ছিল যা কেবল শেখ হাসিনা জানতেন) তিনি মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মো. মনসুর, আবদুল মান্নানদের মতো নেতাদের টপকে এক নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদ যে পদ কলঙ্কিত করেছিলেন, সেই তিনিই প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের পদ লাভ করেছিলেন। এক-এগারোর পর শেখ হাসিনা তাঁকে সব জায়গা থেকে বাদ দিয়েছিলেন। সেই থেকে সাবের হোসেন চৌধুরীর দিনকাল খারাপ যাচ্ছিল। কিন্তু সাবের চৌধুরী বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন, অর্থবিত্তের মালিক। শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি তিনি একজন ভদ্রলোক, ধৈর্যশীল। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন এবং কাজ করেছেন। তাঁর ভাগ্য খুলে গেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এত প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে সরকার যেকোনো উপায়ে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার ইমেজ সংকট কাটাতে সর্বোতভাবে চেষ্টা করছে। এ সময় এই দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার এই নির্বাচন। সাধারণভাবে বিশ্ব দরবারে এ দুটি সংস্থার এমন কোনো ভূমিকা নেই, গুরুত্ব নেই। কিন্তু শেখ হাসিনা গোবরে পদ্ম ফুল ফোটানোর সাহস করতে পারেন। তিনি এই সুযোগ ছাড়বেন কেন। মানুষ এই দুটো আন্তর্জাতিক সংগঠন সম্পর্কে তেমন জানে না (মূর্খ লোক! ওরা জানবে কোত্থেকে)। তাদের জানানোর জন্য বিজয় ডঙ্কা বাজাতে ছাড়বেন কেন তিনি। অতএব, সরকারি খরচে বিরাট সংবর্ধনার আয়োজন। বঙ্গবন্ধুর সেই সময়কার রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসার চেয়ার পান না। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাবেক রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরীও পেতেন না। কিন্তু এবার আইপিইউ জিতে জয়লাভ করে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পাশের চেয়ারে বসার সৌভাগ্য আবার অর্জন করলেন। এ কি খুব বড় জয়? প্রধানমন্ত্রী একে গণতন্ত্রের বিশ্বজয় বলে অভিহিত করলেন।
প্রধানমন্ত্রী এ রকম পারেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের তফসিল যখন ঘোষণা করা হলো, তখন তো তিনি আর ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। সেটা ভালো দেখায় না। তখন তিনি বললেন, আমরা তো সেই আগের সরকার নই। আমরা হচ্ছি অন্তর্বর্তী সরকার। হা হা হা এবং সেই প্রসঙ্গ টেনে ২৩ তারিখের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিরোধী দলকে পাল্টা হুমকি দিলেন। 'একজন মানুষের গায়ে হাত তুলে দেখুক।'
রীতিমতো ভয় দেখানো। গায়ে হাত তোলার কথা আসছে কেন? সরাসরি কোনো দল কি কারো গায়ে হাত তোলে? প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত বোঝাতে চাইছেন তিনি বিরোধী দলকে ছাড়বেন না।
দ্রিমদ্রিম যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে না?
লেখক : আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন