হে তরুণ তিষ্ঠ ক্ষণকাল
22 October 2014, Wednesday
গত বুধবার পিয়াস করিমের উপরে আমার লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর দুটি প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। একটি সরাসরি আমার ফেসবুকে। অপরটি বিদেশ থেকে এক তরুণ লিখেছেন তার পরিচিতজনের কাছে। তারা দুজন মনে করেন পিয়াস করিম মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধের মানুষ। তার মরদেহ কোনোভাবেই শহীদ মিনারে যাওয়া উচিত নয়। আমি তার স্বপক্ষে লিখে ভালো কাজ করিনি।
অজস্র যুবক, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ এ লেখার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও এই দুই তরুণের বক্তব্য আমার কাছে প্রণিধানযোগ্য। কারণ আমি বুঝি এটি একটি চিন্তার ধারা, যা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে বিরাজ করছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তরুণ সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে এর ব্যাপ্তি আছে। গণজাগরণ মঞ্চ যখন কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে শাহবাগে সমবেত হয়েছিল তখন আমরা এর প্রকাশ দেখেছিলাম। কিন্তু নিশ্চয়ই ওই দুই তরুণ, যারা আমার ওপর লিখেছেন, তারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, গণজাগরণ মঞ্চ এখন আর আগের অবয়বে নেই। কেন? এই কথা আজ সবার বিশেষ করে তাদের যারা গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে তুলেছিলেন, তাদের ভাবতে হবে। তারুণ্য বা যৌবন কেবল আবেগ দিয়ে চলে না। চলতে পারে না। কবি হেলাল হাফিজ যখন লেখেন- 'এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়', তখন তিনি এটা বুঝান না যে, যুবকরা কেবল যুদ্ধ করে বেড়াবে। যুদ্ধ মানে তো কেবল সশস্ত্র লড়াই নয়। ভাবের জগতে, চিন্তার ক্ষেত্রে, দর্শনের রাজ্যেও যুদ্ধ চলে। যুদ্ধ হলো রাজনীতিরই আরেকটি রূপ। যখন রাজনীতি আর গণতন্ত্রের পথে শান্তিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে না। এখানে রাজনীতিই মূল, রাজনৈতিক ভাবাদর্শ আসল। যার ওপর ভিত্তি করে লড়াইটা গড়ে উঠে।
৪৩ বছর পরেও যখন আমাদের যৌবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তখন আমাদের তা আরও প্রত্যয় করে তোলে। বাংলাদেশের কোনো মানুষ বাংলাদেশের বিরোধী হতে পারে না। তাই আমি বলি বাংলাদেশের কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করতে পারে না। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করতে পারে না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক কলিক বিষয় হতে পারে না। কোথাও স্থির হতে পারে না। ৪৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে কেবল সেই সময়ের ইতিহাস বর্ণনা নয়। বরং সেই সময়ের মুক্তি চেতনাকে আজকের সময়ে এনে স্থাপন করা। এ জন্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এখন ইতিহাস চেতনা, গণতন্ত্রের চেতনা এবং সর্বোপরি সার্বিক মুক্তির চেতনা। আমার মনে হয়েছে, গণজাগরণ মঞ্চ এ বিষয়টি বুঝেও বুঝেনি। অথবা যারা তাদের পরিচালনা করেছেন, পেছন থেকে সুতা ধরে টানতে চেষ্টা করেছেন তারা তাদের এটা বুঝতে দেননি। সেই তারাই গণজাগরণের মতো একটি মহান উদ্যোগকে বিভক্ত করতে চেয়েছে। কারণ তারা রাজনৈতিক স্বার্থে এই বিভেদটাই চেয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে তাদের এই মতলব প্রথম থেকেই ধরা পড়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়ায় যে ত্রুটি ছিল সেই প্রশ্ন শুরু থেকেই ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি করেছে। শেষের দিকে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মেজর জিয়া উদ্দিনের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধারাও করেছে।
পিয়াস করিমকে নিয়ে এ বিতর্কের জন্ম হলো কেন? তার ঘনিষ্ঠ দু-একজন মনে করেছিলেন, তার মরদেহ ঘণ্টা দুয়েকের জন্য শহীদ মিনারে রাখা হবে তার প্রতি শ্রদ্ধ প্রদর্শনের জন্য। শহীদ মিনারে কি পিয়াস করিমের মরদেহ রাখা সঙ্গত হতো। কাদের মরদেহ সেখানে রাখা যাবে আর কাদের যাবে না এর জন্য কি কোনো নীতিমালা আছে? নেই। শহীদ মিনার হচ্ছে বাঙালির জাতি হয়ে ওঠা অবিনশ্বর এপিটাফ। শহীদ মিনার বাঙালি জাতির অখণ্ড স্মারক। শহীদ মিনার কোনো ব্যক্তির নয়, গোষ্ঠীর নয়, দলের নয়। এর অখণ্ডতা, পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব সমগ্র জাতির। এটা কি আমরা সব সময় রাখতে পেরেছি। পারিনি। বছরের একটি দিন ২১ ফেব্রুয়ারি বাদ দিলে আলাদাভাবে দেখভাল করার কি কোনো ব্যবস্থা আছে? নেই। ওই দিনগুলোতে শহীদ মিনারে যে দুষ্টচক্র সক্রিয় থাকে তা কি আমরা জানি না? আর শুধু তাদের কথা বলবো কেন, রাজনৈতিক দলসমূহ কি অতীতে শহীদ মিনারের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন করেনি? জুতা স্যান্ডেল নিক্ষিপ্ত হয়নি। অর্পিত পুষ্পার্ঘ্য পদতলে পিষ্ট হয়নি? মূল মিনারে কার ছবি উপরে থাকবে, শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান, কর্নেল তাহের তা নিয়ে রীতিমতো মারামারি হয়নি? এই শহীদ মিনারে আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ছুরিকাহত হননি? এই শহীদ মিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের মেয়েরা লাঞ্ছিত হননি?
এগুলো আমাদের কোনো অহংকারের কথা নয়। কিন্তু এটি একটি ভালো দিক যে সারা দেশে যখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কুৎসিত ক্ষমতার লড়াই এখন শহীদ মিনারে শেখ মুজিব আর জিয়াউর রহমানের ছবি তোলার লড়াই আর নেই। ওই সময় আলাপ -আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা গেছে। পিয়াস করিমের ব্যাপারে এ রকম একটি পরিস্থিতি কি এড়ানো যেত না? পিয়াস করিমের স্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমেনা মহাসিন যখন তার স্বামীর মরদেহ শহীদ মিনারে আনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত করলেন তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যুক্তি দেখাতে পারতেন, কেন তারা অনুমতি দিতে পারছেন না। সেই যুক্তি সিদ্ধ হতো কিনা তা জানি না, তবে আরেকটি পক্ষ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে দাঁড়িয়েছে জেনেও পিয়াস করিমের স্ত্রী বা তার পরিবারের সদস্যরা তার মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেদ করতেন তা আমি মনে করি না। পরবর্তী ঘটনা তা প্রমাণ করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখানে পক্ষপাতিত্ব করল কেন? যারা বিরোধিতা করল তাদের শহীদ মিনারের অনুমতি দিল কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসির রাজনৈতিক পরিচয় কারও অজানা নয়। এ জন্যই আজ প্রশ্ন উঠেছে শহীদ মিনার দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে কেন? যাই কিছু হলো তার দায় কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারবেন?
পত্রিকায় দেখেছি দুটি সংগঠনকে ওইদিন শহীদ মিনার ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল ২০টির মতো সংগঠন। তারা একটি কফিন সাজিয়েছিল এবং তাতে জুতা স্যান্ডেল থুথু নিক্ষেপ করেছিল। পত্রিকায় সবাই দেখেছেন তারা একটি ব্যানার টাঙ্গিয়েছিল যার মাধ্যমে নয় ব্যক্তিকে শহীদ মিনারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কি অদ্ভুত? শহীদ মিনারে কাউকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার এরা কারা। যাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে তাদের আমরা চিনি। সবার ব্যাপারে বলতে পারি আমি কিন্তু এই লেখায় সে অবকাশ নেই। আমি কেবল অধ্যাপক আমেনা মহাসিনের কথা বলব। তার কি দোষ? তিনি অধ্যাপক পিয়াস করিমের স্ত্রী এই? যারা এ ব্যানার লটকেছিলেন তারা এই প্রশ্নের জবাব দিবেন কি? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমার প্রশ্ন সেদিন শহীদ মিনারে যা হয়েছে সেটা তারা অনুমোদন করেন?
সিপি গ্যাংসহ যাদের তারা অনুমতি দিয়েছিলেন তারা কি করবে বলে অনুমতি চেয়েছিল? তারা কি সে অনুযায়ী কাজ করেছে। আ আ ম স শামসুল আরেফিন সিদ্দিকসহ কারও যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে তারা যেন মেহেরবাণী করে কথাটি আমাদের জানান। শিক্ষার সর্বোচ্চ পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয় তাও আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কি চলে? যেই দুই তরুণ বন্ধু আমার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছেন পিয়াস করিমের ওপর আমি লিখেছি বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্যের পরে তারা এখন কি ভাবছেন? নাকি তারাও যুবলীগের চেয়ারম্যানের মতো বলবেন, সরকারের বিরুদ্ধে এটা একটি ষড়যন্ত্র। আপনারা নিশ্চয়ই সরকারি দল করেন না। আর যদিবা করেনও নিশ্চয়ই দলকানা নন। আর যদি তা-ও হন তবে অবশ্য আমার এ কথা আপনাদের কানে ঢুকবে না। আমি জাগ্রত তারুণ্যের উদ্দেশে বলছি, যারা এ সমাজের একটি গুণগত পরিবর্তন চান তারা নিশ্চয়ই কাঠের গাইয়ের কাছে দুধ আশা করেন না। এ সরকার একটা কাঠের গাই। এদের সিনিয়র এক মন্ত্রী আমেরিকায় বসে এক কথা বলে দেশবাসীকে বিগড়ে দিয়েছেন। এক মন্ত্রী উল্টাপাল্টা কথা বলে মঞ্চের উপরে সিগারেট খেয়ে সমাজকে বিগড়ে দিয়েছেন সমাজকল্যাণ আর কী করবেন? সবচেয়ে সিনিয়র মন্ত্রী শেয়ার কেলেঙ্কারির নায়কদের এবং দুর্নীতিবাজদের ভয় করেন। কি আশ্চর্য মহান মন্ত্রিপরিষদ!
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে এই সরকার। অথচ জেনারেল ওসমানী এদের সঙ্গে থাকতে পারেননি। জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের এজেন্ট হয়ে গেছেন। কর্নেল নুরুজ্জামান এবং মেজর জলিলকে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে স্বীকারই করেননি। এ কে খন্দকার এক বই লিখে চেতনার কাছে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছেন। কাদের সিদ্দিকীরা রাজাকার। বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগই তাদের দল থেকে বেরিয়ে গেছেন। তারা হাতের মুঠো বন্ধ করে বলছেন এই মুঠোর মধ্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রেখেছি। স্যালুকাস কি বিচিত্র এই রাজনীতি।
পিয়াস করিম সম্পর্কে আমি যা লিখেছিলাম তাতেই যদি কারও রাগ হয়ে যায় তবে আইনমন্ত্রীকে কি করবেন তারা? পিয়াস করিম আমার সঙ্গে ছিলেন চিন্তার দিক থেকে হয়তোবা মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত। কিন্তু তিনি শেষের দিকে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। যেটা আমার ভালো লাগেনি। বিএনপির সঙ্গে আমার কোনো জাত শত্রুতা নেই।
যেমন নেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে। কিন্তু এই গত কয়েকদিনে ছাত্রদল নিয়ে যা হলো তাতে বিএনপির উপর আস্থা রাখা যায়? ক্ষমতায় এলে এরা বর্তমান সময়ের চেয়ে ভালো কিছু করতে পারবে? এ জন্যই আমি বলি এ দুই নেত্রীর কারও কাছেই দেশ নিরাপদ নয়। নতুন কিছু করতে হবে। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড় অহংকার। কিন্তু সেই চেতনার কথা বলে কেউ কেউ তোমাদের ৭১-এ আটকে রাখতে চাইছে। কেউ কেউ তোমাদের ক্ষমতার আলোয় চোখ অন্ধ করে দিতে চাইছে। কিন্তু তোমাদের চোখ খোলা রাখতে হবে। দেখতে হবে সামনে।
একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশ, একটি সমৃদ্ধ কল্যাণমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলা আমাদের জন্য অসম্ভব নয়। কিন্তু সে জন্য আমাদের এই দুবৃত্তায়িত রাজনীতির জগদ্দল ভাঙতে হবে।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন