নীরব উপেক্ষা নিয়ে প্রস্থান
12 October 2014, Sunday
৯ অক্টোবর দুপুর ১২টায় আমি যখন শহীদ মিনার চত্বরে পৌঁছলাম, তখন আবদুল মতিনের লাশ সেখানে আনা হয়েছে। শহীদ মিনার চত্বর তখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ।
আবদুল মতিন যখন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন, তখন আমার সংগঠন নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ বাবুসহ কয়েকজন বলেছিল একবার গিয়ে তাঁকে দেখে আসতে। যাই যাই করেও আমার যাওয়া হয়নি। আমার মাঝেমধ্যে এ রকম হয়। বিশেষ করে হাসপাতালে যেতে ভালো লাগে না। শেষের দিকে মতিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশ নিয়মিত দেখা হতো। তাঁর স্ত্রী গুলবদন নেসা মনিকা ভাবির সঙ্গে দেখা হতো তাঁর চেয়ে বেশি। ফলে মতিন ভাইকে আরো একটু বেশি করে জানার সুযোগ হয়েছিল। সেই মতিন ভাই চলে গেলেন। তাঁকে দেখতে যেতে না পারার একটা গ্লানি ছিল। এ জন্য তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলাম শহীদ মিনারে।
আমাদের দেশে শ্রদ্ধা জানানোর এই ধরনটা প্রধানত রাজনৈতিক। কফিনে করে লাশ রাখার নিয়ম অবশ্য পরিবারেও চালু আছে। লাশ এনে বাড়িতে রেখে দেওয়া হয়। পরিবারের লোকজন আত্মীয়-স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, বন্ধুবান্ধব, তাঁরা এসে লাশ দেখেন। প্রায়ই মুখ থেকে কাফনের কাপড় সরিয়ে দেওয়া হয় মৃত ব্যক্তিকে শেষ একনজর দেখার জন্য। আমি বিষয়টি খুব অনুভব করি। যখনই এ রকম করে কোনো মৃত ব্যক্তির কফিনের সামনে দাঁড়াই, তখন বারে বারেই মনে হয় আমি ওই লোকটির মতো মরে পড়ে থাকতে পারতাম অথবা ওই ব্যক্তি আমার মতো এ রকম দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন। ব্যক্তিটি যদি আমার ঘনিষ্ঠ কেউ হন, যাঁর সঙ্গে আমার মেলামেশা ছিল, তখন এক বিচিত্র অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কী রকম করে জীবন-মৃত্যু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে। কোনটা জীবন, কোনটা মৃত্যু? কেন এই অপার লীলা, তা নিজের মধ্যেই খুঁজতে থাকি।
মতিন ভাইকে সর্বশেষ দেখেছিলাম মাস নয়েক আগে, অফিসার্স ক্লাবের এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। ভাবিসহ তাঁরা কয়েকজন দোতলায় এক টেবিলে খেতে বসলেন। আমি আমার টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে তাঁর টেবিলে বসলাম। তিনি আমাকে দেখে চিনতে পারলেন বলে মনে হলো না। ভাবি আমার কথা তাঁকে বললেন। তিনি আমার প্রতি মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করলেন। চোখটা বড় বড় করে আমাকে প্রশ্ন করলেন- কেমন? আমি আবারও বুঝলাম, তিনি আমাকে মনে করতে পারেননি। তখনই খারাপ লাগছিল। যদি তাঁর আয়ু পাই তবে একদিন আমিও তাঁর মতোই হবো। জীবন শেষে কত কষ্টের।
মতিন ভাইকে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব শ্রদ্ধা করি, বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা জাতি চির জীবন স্মরণ রাখবে। ভাষা আন্দোলন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করে। মতিন ভাই ছিলেন সেই আন্দোলনের অন্যতম প্রাণ-পুরুষ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ রকম করে একটা বলার প্রচলন রয়েছে যে অমুক ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। রাজনীতিতে দলাদলি বেড়েছে, দলবাজি বেড়েছে, তারই স্বার্থে ব্যক্তিবাদও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আন্দোলনে নিশ্চয়ই নেতৃত্ব থাকে। কখনো কখনো কোনো ব্যক্তি ওই আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবেও আবির্ভূত হন।
নীরব উপেক্ষা নিয়ে প্রস্থান
কখনো কি অংশগ্রহণকারী সমগ্র জনগণ আন্দোলনের নেতা হয়ে উঠতে পারে? এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মিলিত বিক্ষোভে কোনো আন্দোলন শুরু হতেই পারে। হয়তো কোনো সংগঠিত শক্তি তার পেছনে কাজ করেনি। সাম্প্রতিককালে মিসরের তাহরির স্কয়ারের ব্যাপারটা তো সে রকমই ছিল। আমার বিবেচনায় তাহরির স্কয়ারের অভ্যুত্থান সাম্প্রতিককালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভ্যুত্থান। '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের একক নেতা হিসেবে আমরা তোফায়েল আহমেদের নাম বলতে পারি, যৌথভাবে বলতে পারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের নাম। সে রকম করে তাহরির স্কয়ারের ব্যাপারে বলতে পারি না, যেমন পারি না ভাষা আন্দোলনের বেলায়ও। রাজনীতিবিদ, লেখক, গবেষক জনাব বদরুদ্দীন উমর অংশগ্রহণকারী ছাত্র শ্রমিক কৃষককে এ আন্দোলনের নেতা বলে অভিহিত করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অবশ্য এ আন্দোলনে কৃতিত্ব আরোপ করার চেষ্টা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। কিন্তু বিশেষ করে বদরুদ্দীন উমরের গবেষণামূলক লেখার কাছে সেই দাবি জায়গা করে নিতে পারেনি। এ জন্য বদরুদ্দীন উমর আওয়ামী লীগ তথা শাসকগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছেন। কিন্তু জনাব উমর তাতে বিচলিত হননি। দীর্ঘ এই গবেষণামূলক গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন কারা কারা তখন আন্দোলনের ব্যাপারে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর সেই লেখায় এবং অন্যদের বইয়েও আমরা জানতে পারি, আবদুল মতিন ১৯৪৮ সাল থেকে নিষ্ঠভাবে ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছেন। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ভাষণে 'উর্দু কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' উচ্চারণ করলে আবদুল মতিন দাঁড়িয়ে তীব্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করেন।
সেই সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের জন্য ছিলেন এক পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কেউ 'না' বলতে পারে- এটা কারো ভাবনার মধ্যেও ছিল না। আবদুল মতিন সেই কাজটি করেছিলেন এবং এ জন্যই তিনি একুশে আন্দোলনের অন্যান্য নেতার তুলনায় বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি আমরা একবার চোখ বুলাই, আমরা দেখব এই বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে বড় দুটি দল কেবল নীতিহীনতার চাষ করছে। আনুগত্য এখন রাজনীতির অলংকার হয়ে দাঁড়িয়েছে, শুধু আনুগত্যের কারণে কেউ কেউ রাষ্ট্রপতির পদ পর্যন্ত পেয়েছেন। জাতীয় রাজনীতির এই অবক্ষয় ছাত্র রাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। প্রায় দুই যুগ ডাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদের নির্বাচন নেই। বড় দুটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের নির্বাচনের কোনো সম্মেলন নেই। নেতা বেরোচ্ছেন নেত্রীদের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে। ফলে যে ছাত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে না বলতে পেরেছিল, ষাটের দশকে সংকোচনমুখী শিক্ষানীতিকে ছুড়ে ফেলতে পেরেছিল, আবার ১৯৭১ সালে ভুট্টো, ইয়াহিয়ার দৃষ্টির সামনে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে ধরেছিল, সেই ছাত্রসমাজ আজ আত্মবিস্মৃত। দুর্বৃত্তায়িত জাতীয় রাজনীতি আজ তাদেরও দুর্বৃত্ত বানিয়ে ফেলেছে। শুধু অর্থ আর প্রতিষ্ঠার লোভে তারা সিটবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, এমনকি অপহরণ বাণিজ্যে লেগে গেছে। এ সময় আবদুল মতিন এ দেশের ছাত্রসমাজ তথা সমগ্র জাতীয় রাজনীতির কাছে একটি অনুকরণীয় চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
১৯৫০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এগুলো সবই ছিল খুব যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত। কারণ মতিন ভাই তখনো দ্বিধায় ছিলেন না। আন্দোলনের চূড়ান্ত সময় যখন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল তখনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের মতো দ্বিধান্বিত ছিলেন না তিনি। অন্যান্য কিছু ছাত্রনেতার সঙ্গে মিলে ছাত্রদের আহ্বান জানিয়েছিলেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করতে এবং এভাবে বাঙালি জাতির প্রথম ইতিহাস তৈরি করেছিলেন।
তাঁকে সবাই ভাষা মতিন বলত। মতিন নামের আরো কয়েকজন যুক্ত ছিলেন এই আন্দোলনে। আমি আগেই বলেছি, কিন্তু আবদুল মতিন এরই মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। মওলানা ভাসানী তাঁকে ডাকতেন ভাষা মতিন বলে এবং এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অলংকার হয়ে উঠেছিল। ভাষা আন্দোলনের পরপর তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় হন। ১৯৫৪ সালে তিনি পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নিযুক্ত হন। মওলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করলে তিনি এমএল গঠন করেন। চীনকে অনুসরণকারী বামপন্থী দলগুলোর নানা বিভাজনের মধ্যে আবদুল মতিনও চলছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি গঠনে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখেন। ২০০৬ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে ২০০৯ সালে হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠন) গঠিত হলে আবদুল মতিন তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। হায়দার আকবর খান রনো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেও আবদুল মতিন পুনর্গঠিত ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গেই আমৃত্যু ছিলেন।
পাঠক, আবদুল মতিনের এই পরবর্তী জীবন আমাদের নানা প্রয়োজন। গোলাম আযমও একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন। এ ছাড়া জিল্লুর রহমান, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদসহ ১১ জন ছিলেন সংগ্রাম পরিষদের নেতা। তাঁরা সবাই পরে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, কেবল আবদুল মতিন ছাড়া।
বায়ান্নর পরে জনাব মতিন যে রাজনীতি করেছেন, তার বেশ কিছু অংশ নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে। কিন্তু সেসব কেবলই রাজনৈতিক বিতর্ক। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এবং তাঁর দলের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আবদুল মতিন একসময় উগ্র বামপন্থী রাজনীতি করতেন। উগ্র বামপন্থা আজ পৃথিবীজুড়ে পরিত্যাজ্য। সেখানে আবদুল মতিনকে সমর্থন করা যাবে না। কিন্তু এ কথা মানতে হবে, আবদুল মতিন আজীবন দেশের জন্য লড়েছেন, পরিবর্তনের জন্য লড়েছেন এবং ৮৮ বছরের জীবনে কখনো সুবিধাবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি।
এ জন্যই কমরেড আবদুল মতিনকে সহস্র শ্রদ্ধা।
দুই.
মতিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হলো না কেন? রাজেকুজ্জামান রতন লিখেছেন, তিনি তো জীবনে কিছুই চাননি। না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নিয়ে পুঁজিবাদের দীক্ষা গ্রহণ করলে কি না হতে পারতেন। তাহলে এই দীনহীন অবস্থায় রাষ্ট্রের নীরব উপেক্ষা নিয়ে... প্রস্থান ঘটত না।
আসলে দীন আবদুল মতিন নন, অতি দীন এই রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের কর্ণধার। ওরা মূসা ভাইকেও সম্মান দেয়নি। তাঁর তো প্রটোকল ছিল।
লেখক : আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন