ধ্বংসের পথে শিক্ষা
28 September 2014, Sunday
১৭ সেপ্টেম্বর ছিল ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবস। এখন এ কথা অধিকাংশ ছাত্রনেতা এমনকি ছাত্রসংগঠনও ভুলে গেছে। বাবুল-মোস্তফা-ওয়াজিউল্লাহ ষাটের দশকে একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন এই দিনে। এ কথা হয়তো সবাই ভুলে গেছে এ জন্য বলছি যে এই দিনটি এখন আর কেউ পালন করে না। অথচ আগে শিক্ষা দিবস হিসেবে ছাত্রসংগঠনগুলো এই দিন পালন করত।
নবগঠিত নাগরিক ছাত্র ঐক্য এই দিনকে স্মরণ করে শিক্ষাঙ্গনে পরিস্থিতি ও ছাত্ররাজনীতি শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সেখানকার আলোচনায় বোঝা গেল কেন ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস হিসেবে তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। কারণ পরিস্থিতি দিন দিন এত খারাপ হচ্ছে যে এখন সময় হয়েছে আরেকটি নতুন শিক্ষা দিবস তৈরি করার। অর্থাৎ শিক্ষার জন্য আরেকটি নতুন আন্দোলন গড়ে তোলার। ২৬-২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের দুটি জনপ্রিয় দৈনিকের খবরে শিক্ষাব্যবস্থার যে করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে তা পড়লে শিউরে উঠতে হয়। এমনিতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদন, অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থেকে শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদির ব্যাপারে দুর্নীতি নিয়ে প্রচুর কথা হয়েছে। টিআইবি এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেটি নিয়ে সরকারি মহলের কী উষ্মা প্রকাশ!
আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদরা এমনভাবে কথা বললেন, যেন সরকারের বিরুদ্ধে টিআইবি একটা ষড়যন্ত্র করছে। এ রকম মাঝেমধ্যেই বলে থাকেন সরকারি দলের লোকেরা, যখনই যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন। এবার সরাসরি শিক্ষামন্ত্রী অনুপ্রবেশ করলেন। এমনিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ একজন মিষ্টভাষী ভদ্রলোক। আওয়ামী মন্ত্রিসভার দুর্নীতিবাজদের ভিড়ে টেক্সটবুক বোর্ডের সময়মতো বই বিতরণ করে তিনি বেশ নাম কামিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ছিলেন, সেই হিসেবে তাঁকে কেউ দুর্নীতিবাজ মনে করেন না। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ নিতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেলেন তিনি। তিনি বুঝতে পারেননি, কাক কাকের মাংস খায় না; কিন্তু আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের গোশত খায়। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বোমা ফাটালেন। মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা সম্পর্কে তিনি যা বললেন তা টিআইবি তদন্ত প্রতিবেদনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কিসের ভিত্তিতে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হলো, নির্ধারিত বিধান ও আইন না মেনে এসব বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু করল কিভাবে এবং চালিয়েই বা যাচ্ছে কিভাবে- সেই প্রশ্ন উত্থাপিত হলো।
ধ্বংসের পথে শিক্ষা
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হঠাৎ করে একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল কেন, সেটা নিয়েও মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হলো। এত দিন কী করেছে মঞ্জুরি কমিশন? এখন যে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে ছাত্রদের সতর্ক করার চেষ্টা হচ্ছে, এত দিন তা করা হয়নি কেন? যারা এরই মধ্যে সেখানে ভর্তি হয়েছে, পড়াশোনা করছে, তাদের কী হবে? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। অথচ মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর দায় চাপাচ্ছে, মঞ্জুরি কমিশন কি নিজেদের দোষ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে?
টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা খাতে অন্তত ৬০ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এই তিন পক্ষ এসব অপরাধ করছে। এ ক্ষেত্রে এই তিন পক্ষ পরস্পর গাঁটছড়া বেঁধেছে। এ নিয়ে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতামূলক দুর্নীতির উদ্ভব ঘটেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেওয়া পর্যন্ত মোট ১১টি ঘাটে ঘুষ দিতে হয়। কাজ অনুযায়ী এই ঘুষের রেট সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত।
গবেষণায় পাওয়া ঘুষের বিভিন্ন খাতের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের ক্ষেত্রে এক থেকে তিন কোটি টাকা, ভুয়া সার্টিফিকেট কিনতে ৫০ হাজার থেকে তিন লাখ, অডিট প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ, ভিসি-প্রোভিসি-ট্রেজারার নিয়োগের অনুমোদনে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে ১০ থেকে ৫০ হাজার, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য পরিদর্শনে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা প্রদানের তথ্য দেখা যায়। এ ছাড়াও ইউজিসিকেন্দ্রিক কাজ যেমন- অনুষদ, বিভাগ, পাঠ্যক্রম অনুমোদন ও দ্রুত অনুমোদনসহ অন্যান্য খাতে পাঁচ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে দিতে হয়। তবে টিআইবির গোটা বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন ইউজিসির চেয়ারম্যান।
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে সর্বোচ্চ ১২ বছরের মধ্যে স্থায়ী সনদ গ্রহণ করার নিয়ম থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শর্ত পূরণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে স্থায়ী সনদ গ্রহণ করেছে। ৭৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ১৭টি স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িক অনুমতি নিয়ে তা বারবার নবায়নের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া কোর্স কারিকুলাম পড়ানো, বিভাগ খোলা ও শিক্ষার্থী ভর্তি এবং অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে অনুমোদন, ক্লাস না করিয়ে, পরীক্ষা না নিয়ে ও ব্যবহারিক ক্লাস (বিশেষায়িত ল্যাব সুবিধা অপর্যাপ্ত) না নিয়ে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট প্রদান, কাগজে-কলমে শিক্ষকের কোটা পূরণ দেখালেও বাস্তবে শিক্ষকের উপস্থিতি না থাকা, গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখার নিয়ম থাকলেও তা ব্যয় না করা, মাস্টার্সের থিসিস, জার্নালে লেখা ও ব্যক্তি-উদ্যোগের কাজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলে চালানো, সমঝোতার মাধ্যমে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র গোপন করার মতো নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে।
আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক। কিন্তু বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসা ও মুনাফার হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছেন। টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলছে, যে হারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যা আরো বাড়বে। তাই সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
এ তো গেল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের ব্যাপারগুলো। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাও কোনো অংশে কম নয়।
একসময় প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এখন ভর্তি পরীক্ষার কেলেঙ্কারির জন্য পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। এ বছরে 'ঘ' ইউনিটের জালিয়াতি আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এখন পর্যন্ত ৪০ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে পরীক্ষার্থী ছাড়াও ছাত্রলীগের নেতাসহ চাকরিজীবি ও কলেজের প্রভাষকও রয়েছেন। ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে মোবাইল ফোনে উত্তর জালিয়াতির সময় ১৭ জন পরীক্ষার্থীকে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আটক করা হয়েছে। এবার ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রায় ৮০ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাসই করতে পারেনি। 'খ' ইউনিটের পরীক্ষায় ১০ জনের ৯ জনই ফেল করেছে। অথচ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের বেশির ভাগই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে। প্রতিবছরই ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার উদ্বেগজনকভাবে কমছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ পাস ও লক্ষাধিক জিপিএ ৫ পাওয়াকে শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার নিজেদের মহাসাফল্য হিসেবে দেখালেও অন্যরা একে শিক্ষার সর্বনাশ বলে মনে করছেন। শিক্ষার মান ক্রমাগতভাবে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের দুর্নীতিও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এবারের ভর্তি জালিয়াতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন কলেজ শাখার নেতাদের নাম পত্রিকায় এসেছে। এর আগে ছাত্রদলের নেতারাও এ কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ শিক্ষার সর্বনাশে কেউই পিছিয়ে থাকেনি। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাব্যবস্থা যখন এ রকম করে ভেঙে পড়ছে, তখনো শিক্ষামন্ত্রী সংকটের গভীরতা বুঝতে পারছেন না। শুধু শিক্ষামন্ত্রী নন, খোদ প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার বিষয়ে বাগাড়ম্বর করছেন। এ রকম কথা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে সরকার পাসের হার বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে শিক্ষকদের উৎসাহিত করছে। প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্কে গিয়ে বলেছেন, দেশে যদি এতই দুর্নীতি হয় তবে এত উন্নয়ন হচ্ছে কেমন করে? মজার কথা পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খান এবং বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময়ের স্বৈরশাসক এরশাদও একই রকমভাবে উন্নয়নের কথা বলতেন। তাঁদের আমলের উন্নয়ন তবু কিছু কিছু দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু এই সরকারের দুর্নীতি উন্নয়নের নামে দাঁত বের করে হাসছে।
অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। কিন্তু আজকের এই লেখার আর পরিসর বাড়ানো যাচ্ছে না। এখানে অথবা অন্যত্র সে প্রসঙ্গে বলব। ছাত্র ও যুবসমাজের উদ্দেশে আমার এখন এটাই আবেদন- দুর্নীতি প্রতিরোধে, শিক্ষার মান বাঁচাতে ছাত্র-যুবকদের নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং তার জন্য এখনই সময়।
লেখক : আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন