বিএনপি তো নয়ই, আওয়ামী লীগও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে না
16 September 2014, Tuesday
অবশেষে পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করেছে সরকার। শীর্ষ এই পাঁচ কর্মকর্তা হলেন- স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞা, সদ্য ওএসডি হওয়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সচিব এ কে এম আমির হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান (বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান) এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ওএসডি) আবুল কাসেম তালুকদার। এই পাঁচ কর্মকর্তার কেউ কেউ সুপরিচিত। গত পাঁচ বছরের সরকারের আমলে বেশ দাপটের সঙ্গে তাঁরা শাসন করেছেন, নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়েছেন। প্রশাসন সম্পর্কে যাঁদের অল্পবিস্তর ধারণা আছে তাঁরা জানেন, একেবারে সচিবপর্যায়ে যাঁরা উঠে আসেন, তাঁদের আগাপাছতলা দেখে নেওয়ার রেওয়াজ আছে। সে হিসেবে এঁরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি ছিলেন না তা এই সরকারের অজানা থাকার কথা নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার তা জানত না অথবা জেনেও না-জানার ভূমিকায় ছিল। বিষয়টি প্রথম সাধারণের নজরে আনে 'দৈনিক প্রথম আলো'। চাকরির শেষ সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার হিড়িক শিরোনামে গত ২২ জানুয়ারি পত্রিকাটির প্রতিবেদনে পাঁচ সচিবের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এরপর দুদক অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানে প্রতিবেদনের সত্যতা পাওয়া যায়। তারই ভিত্তিতে দুদক সুপারিশ করে এবং সেই সুপারিশ অনুযায়ী এই সচিবদের সনদ বাতিল করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এ পর্যন্ত কম কথাবার্তা হয়নি। বাঙালি জাতি হয়তো অনাদিকাল টিকে থাকবে অথবা যত দিনই টিকে থাকুক, একটি জাতির জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড় অহংকার আর কিছু নেই। এই অহংকার আর যা-ই হোক, মিথ্যার সঙ্গে বাস করতে পারে না। এমন হতেই পারে- সেই ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক থাকে, ইতিহাসে ভুল বা অপব্যাখ্যা হতে পারে। সময়ের বিবর্তনে ইতিহাসের পাতাগুলো বিবর্ণ হতে থাকে; কিন্তু তারপর কালের সীমান্তে আমাদের ইতিহাসের বাতিঘরে মুক্তিযুদ্ধের আলো জ্বলজ্বল করতে থাকে। এই যে অতিসম্প্রতি এ কে খন্দকারের লেখা নিয়ে বিতর্ক কিংবা স্বাধীনতার পর থেকে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা, মেজর জলিল বা কাদের সিদ্দিকীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক যখন যাঁরাই তুলেছেন, তখন দেশের বিবেক বলেছে, যা-ই করা হোক সত্যের যেন অপলাপ না হয়। মুক্তিযুদ্ধ কোনো বন্ধকি গহনা নয়; বরং হাতের আঙুলে পরে থাকা হীরার আংটি। ওটা সব সময় জ্বলজ্বল করতে থাকবে। কেউ চাইলেই হীরার উজ্জ্বলতা ম্লান করে ফেলতে পারবে না। ধিক্কার ওই পাঁচ সচিবকে, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সনদকে একটা ব্যবসার সার্টিফিকেট মনে করেছিলেন।
বিএনপি তো নয়ই, আওয়ামী লীগও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে না
কথা এভাবে শেষ করা যেত; কিন্তু এখানেই কথাটা শেষ হচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দেওয়ার নিশ্চয়ই একটি স্বীকৃত সত্য প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু স্বাধীনতার এই ৪৩ বছর পর এ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠছে। প্রাপ্ত সূত্র থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত মোট মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়া হয়েছে প্রায় এক লাখ ৫২ হাজার। গত পাঁচ বছরে- অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময় সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। এর আগের সরকারের আমলে আরো ৪০ হাজার সনদ দেওয়া হয়। প্রশ্ন উঠেছে, এই সরকার কিংবা এর আগের সরকার যাঁদের সনদ দিয়েছে তা কি ঠিক ছিল? কারণ অভিযোগ পাওয়া গেছে, অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাননি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত প্রায় ১৪ বছরে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল- জামুকার সিদ্ধান্ত ছাড়া যাঁরা সনদ নিয়েছেন, তাঁদের সবার সনদ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো। মন্ত্রী জানান, লাল মুক্তিবার্তা ও ভারতের কাছ থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণ তালিকার এক লাখ ৪৪ হাজার ছাড়া অন্যদের সনদ স্থগিত করা হয়েছে। সেই হিসেবে এই পাঁচ সচিবের সনদ তো আগেই স্থগিত হওয়ার কথা ছিল। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে, এই পাঁচজন সচিব সনদ পেলেন কী করে। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের অনুমোদন না নিয়ে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলামের একক ক্ষমতাবলে গেজেট ও সাময়িক সনদ নিয়েছিলেন চার সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব।
বিস্ময়কর মনে হয় না? একজন প্রতিমন্ত্রী দেশের প্রচলিত সব আইন ভেঙে ইচ্ছামতো একজন অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেন এবং এটা যে ভুল তা বলার অবকাশ নেই। কারণ তিনি এ ধরনের অপকর্ম এর আগেও করেছেন। বিদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা ক্রেস্টে স্বর্ণ না থাকার ঘটনা মানুষ এত তাড়াতাড়ি ভুলে যায়নি। দেশজুড়ে যখন হইচই শুরু হয়েছিল, তখন সরকার একটা তদন্তের ব্যবস্থা করেছিল এবং সেই তদন্ত আবিষ্কার করেছিল যে মন্ত্রীর কোনো দোষ নেই। সব দোষ সচিবের। যেন সচিবই মন্ত্রণালয়ের মূল ব্যক্তি। মন্ত্রী সাহেব ঠুঁটো জগন্নাথ মাত্র। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রী সাহেব এত ক্ষমতাশালী যে তিনি চাইলে অমুক্তিযোদ্ধা সচিবদের মুক্তিযোদ্ধা পর্যন্ত বানিয়ে দিতে পারেন। সরকার সেটা বোঝে এবং বুঝেই এ ধরনের একজন কপটাচারী মন্ত্রীকে নির্দোষ আখ্যা দিতে পারে। অবশ্য এ রকম ঘটনাও নতুন নয়। কারণ এর আগে আমরা খোদ প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পরিষদের সদস্যদের কাউকে দেশপ্রেমিক, কাউকে 'মি. কিং' বলে সার্টিফিকেট দিতে দেখেছি। গত কেবিনেট সম্পর্কে তাঁকে বলতে শুনেছি যে তাঁর কেবিনেটের কোনো মন্ত্রীর দিকে দুর্নীতির আঙুল উঁচিয়ে দেখানো যাবে না। যদিও এই নতুন টার্মের সরকারের শুরুতেই তারই সৃষ্ট দুদক দুজন মন্ত্রীর নামে দুর্নীতির মামলা দিয়েছে। আর দুজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ বলতে আমরা কী বুঝি? দুর্নীতি মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি শত্রু- এ কথা কি ঠিক নয়? মিথ্যাচার মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না। এই সরকার মিথ্যাচার করছে না? ক্ষমতার জন্য মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরছে না? মিথ্যার ওপর তার বসত নির্মাণ করেনি? অবশ্যই আমি পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা বলেছি। কিন্তু এখন বলছি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নিয়ে। মাত্র কয়েক মাস হলো মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন গেল। সেটা কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছিল? একই রকম অভিযোগ কি ওঠেনি সেই নির্বাচন নিয়ে? যেইভাবে সরকার পেশাজীবী ব্যবসায়ীদের নির্বাচনসহ সর্বত্র হাত খেলাচ্ছে, সেইভাবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করেনি? এগুলো কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রকাশ? কত মুক্তিযোদ্ধার বুকের জমাট কান্না গলে গলে পড়ে যেতে দেখলাম তখন।
লেখার শিরোনামে আমি দুটি দলের কথাই বলেছি, জোর করে কাউকে টেনে আনতে চাইনি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, নিজেদের আমলে বিএনপি যে ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিল, সে ব্যাপারে আন্তরিকতা ও সঠিকতার দাবি করতে পারবে তারা? ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের মন্ত্রী বানানোর অভিযোগ তো আছেই সেই সরকারের বিরুদ্ধে, কর্নেল তাহেরসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনাও তো আছে। বিএনপিকে নিয়ে এ জন্য আর কথা বাড়াতে চাই না। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে তাদের আখের গোছানোর কাজ করে না। জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে তারা এ কথা স্পষ্ট করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ- যারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল বলে নিজেদের দাবি করে, তারাও যে সেই চেতনার বাতি নিভিয়ে দিয়ে স্বৈরাচার ও মিথ্যাচারের বালিয়াড়িতে ঘর বেঁধেছে, তা এই দলের আন্তরিক নেতা-কর্মীরাও খেয়াল করছে না।
লেখক : আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন