বার্লিনের টিগেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যাচ্ছি। এয়ারপোর্ট এলাকা ছাড়িয়েই ট্যাক্সি ড্রাইভার যে রাস্তায় মোড় নিলো সেটা বড়ই সুন্দর। সোজা রাস্তার ডান দিকে সমান্তরালভাবে চলে গেছে নদী, বাঁ দিকে বিশাল ঘন বন। নদীতে বুনোহাঁস নির্ভয়ে সাঁতার কাটছে, আনন্দে জলকেলি খেলছে। আইনের শাসন কড়া বলে এখানে পাখিশিকারিরা কাছেও ভিড়তে পারে না। শীতকাল, তাই বনের করুণ সুর কান পাতলে শোনা যায়। কিছু কিছু চিরসবুজ গাছ ছাড়া, গাছে গাছে পাতা নেই, যাও বা আছে মরা পাতা। একটু বাতাস লাগলেই ঝরে পড়ে যাচ্ছে। ঝরা পাতা, পাতাবিহীন গাছ আর ডাল থেকে ডালে অস্থির কাঠবিড়ালির লাফালাফিরও যে একটা রূপ আছে, তা জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম। সব মিলে কী অপূর্ব বার্লিনের এ খণ্ডচিত্র!
ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানলাম, যাকে নদী বলছি সেটা আসলে নদী নয়, একটি কৃত্রিম খাল আর যাকে বন বলছি সেটা সিটি পার্ক। বিদেশের মাটিতে যখন যেখানে যাই, আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সাথে মনে মনে একটা তুলনা করে নিই। এবারো সে কাজে ভুল হলো না। ভাবলাম, বার্লিনবাসী কী ভাগ্যবান! শহরের ভেতরে এত বড় সবুজের সমারোহ! কী সুন্দর জলাধার, পরিষ্কার পানি! এমন পার্ক যদি ঢাকায়ও একটা থাকত, ঢাকার খালগুলোয় যদি স্বাভাবিক পানির প্রবাহ থাকত, কতই না ভালো হতো!
এসব না থাকলেও ঢাকাবাসীর নসিব খারাপই বা বলি কী করে? এত বড় শহর, চার দিক নদীবেষ্টিত হয়েই তো আছে। শহরে এবং তার আশপাশে রয়েছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু। ধলেশ্বরীও খুব দূরে নয়। বার্লিন যেখানে খাল খনন করে নদীর অভাব ঘোচাচ্ছে, নগরের শোভা বর্ধন করছে, সেখানে ঢাকার মানুষ খালনালা সব ভরাট করে রাস্তা বানাচ্ছে, ইটের ওপর ইট গেঁথে দালান তুলছে। দখল ও দূষণে নদীগুলোকে গলা টিপে টিপে মেরেই চলেছে। মহা আহাম্মক না হলে কি মানুষ কখনো এমন আত্মঘাতী কাজ করতে পারে? আফসোস, এ বোধোদয় আমাদের মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের কবে হবে?
হোটেলে গিয়ে দেখি, জায়গাটা একটু নীরব নিরিবিলি আবাসিক এলাকা। চার দিকে বড় বড় গাছ। দোকানপাট ব্যবসায় বাণিজ্য এখানে চলে না। দিনদুপুরে ফুটপাথে মানুষের চলাচল নেই বললেই চলে, রাস্তায় গাড়িও কম। আছে শুধু বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। ফ্রন্ট ডেস্কে জিজ্ঞেস করলাম, আমার একটু দোকানে যাওয়া দরকার, ধারেকাছে কি কিছু আছে? কিভাবে যাবো? আমাকে বলে দিলো, ‘ডান দিকে যাও, আধমাইল হাঁটলে পরে পাবে।’
আধমাইল যাওয়ার পর হাতের ডান দিকে পেলাম লাল ইটের বিশাল এবং অতি পুরনো এক ছয়তলা বিল্ডিং। এত বড় বিল্ডিং খুব কমই দেখেছি। বিল্ডিংটি কিসের, জানতে খুব আগ্রহ হলো। কাছে গিয়ে দেখলাম, সামনের দেয়ালে মাটি থেকে মাত্র তিন-চার ফুট উঁচুতে লেখার মাঝে একটা পরিচিত শব্দ ‘Seimens’। তার সাথেই একটা সাবওয়ে স্টেশন। এর ঠিক পরেই চার লেনের চওড়া ব্যস্ত রাস্তা। রাস্তার ওপারে দেখলাম ‘Seimens’-এর একই রকম আরেকটি বিল্ডিং। তারপর একটি গ্রোসারি দোকানের খোঁজে বড় রাস্তা ধরে বাঁ দিকে হাঁটতে থাকি। দুই পা ফেলতেই দেখি ওপার থেকে এক যুবক ব্যস্ত রাস্তা পার হয়ে আমার দিকে দ্রুত ছুটে আসছে। ফুটপাথে উঠেই সালাম করে সামনে এসে দাঁড়াল।
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম, একটু ভয়ও পেলাম! কী করে সে বুঝল যে, আমি মুসলমান? এত মানুষ বাদ দিয়ে কেন আমাকেই বা নিশানা করল। আমি ইংরেজিতে কথা বলি, সে তার ভাষা বলে, কোন ভাষা তা-ও জানি না। তার কথা আমি বুঝি না, না আমার কথা সে বোঝে। তার মুখের শুধু একটা শব্দই আমার কাছে অর্থবহ মনে হলো- ‘পোল্যান্ড’, অর্থাৎ সে পোল্যান্ড থেকে এসেছে। মানুষের মুখের ভাষা আল্লাহর অসাধারণ সৃষ্টি, অপূর্ব নেয়ামত, কিন্তু তিনি মানুষের মাথায় যে মগজ দিয়েছেন সেটা ভাষার চেয়েও শক্তিশালী। এবার নতুন করে অনুধাবন করলাম, বাকশক্তি যেখানে অচল, মানুষের বুদ্ধি সেখানেও সচল। লোকটি তার পেট, মুখ ও হাত ব্যবহার করে আকারে ইঙ্গিতে আমাকে বুঝিয়ে দিলো যে, তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ঘরে উপোস করছে, সে সাহায্য চায়। পকেট থেকে এক ইউরো বের করে তার হাতে তুলে দিয়ে সামনে হাঁটতে থাকলাম। রাস্তার ওপারে দেখতে পেলাম Seimens-এর আরেকটা বড় বিল্ডিং, কিন্তু এটা নতুন। আরো দুই ব্লক সামনে গিয়ে দেখি এক সাবওয়ে স্টেশন- নাম Seimensdahmm। অনুমান করলাম, আমি Seimens-এর জগতে প্রবেশ করেছি। স্টেশনের কাছেই এক দোকানে কাজ সেরে হোটেলে ফিরে এলাম।
ফ্রন্ট ডেস্কে জানতে চাইলাম, তোমাদের চার দিকে Seimens-এর এত স্থাপনা! ব্যাপার কী? আমাকে বলল, ‘তুমি যে জায়গায় আছো, এটার নামই ‘Seimens City’। Seimens-এর প্রতিষ্ঠাতা এখানেই থাকতেন। কোম্পানির দু’টো হেড অফিস- একটি এখানে, আরেকটি মিউনিখে। দিনটি ছিল ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর। লবিতে বসেই কম্পিউটারে লগইন করে পড়তে লাগলাম Seimens-এর কথা। দেখলাম, ঠিক দুই শ’ বছর আগে অর্থাৎ ১৮১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর Seimens কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মালিক Werner von Seimens-এর জন্ম। ১৮৪৮ সালে তিনি এখান থেকেই শুরু করেন তার এ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। আজ এটি পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদাশালী কোম্পানিগুলোর অন্যতম। উইকিপিডিয়া থেকে নতুন যে কথা শিখলাম সেটা হলো, ‘Seimens’ শব্দটির উচ্চারণ ‘সিমেন্স’ নয়, জার্মান ভাষায় এর সঠিক উচ্চারণ ‘জিমেন্স’।
পরদিন সকালে আমার বার্লিন দেখতে যাওয়ার কথা। ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে সব বুঝে নিলাম, কোথায় যাবো, কিভাবে যাবো এবং সেখান থেকে কেমন করে ট্যুর বাসে উঠব। সকাল বেলা দেখলাম আবহাওয়া ভালো নয়, ঠাণ্ডাও খুব বেশি। ভালো করে গরম কাপড়চোপড় পরে হাতব্যাগে পানি, কিছু শুকনো খাবার ও ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম Seimens বিল্ডিংয়ের কাছে সাবওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখিÑমানুষজন নেই বললেই চলে। কারণ শীতের সকাল, তা-ও আবার রোববার। আমি জার্মান ভাষা জানি না। মেশিন থেকে টিকিট কিনতে হবে। নির্দেশনা সব জার্মান ভাষায়, তাই এক বৃদ্ধার সহায়তায় টিকিট কিনে সাবওয়েতে উঠলাম।
এর মধ্যে যে বিষয়টি আমাকে অবাক করল সেটা হলো, সাবওয়ে স্টেশনে ওঠানামার ব্যাপারে কার টিকিট আছে আর কার নেই, সেটা দেখভালের জন্য কোনো মানুষও নেই, কোনো যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাও নেই! পরে জানতে পারলাম, বার্লিনবাসীর নাগরিকজ্ঞান এবং নৈতিক মূল্যবোধ এতটাই উঁচুমানের যে, তারা সাধারণত টিকিটের ব্যাপারে ফাঁকি দেয় না, তবে কদাচিৎ যে এর ব্যত্যয় হয় না, তা-ও নয়। তাই মাঝে মধ্যে পরিদর্শকেরা ট্রেনে টিকিট চেক করে। বিনা টিকিটে কাউকে ধরতে পারলে ওয়ার্নিং দেয়, জরিমানা করে। এটা সত্যি অবাক হওয়ার মতো অভিজ্ঞতা। কারণ এমন উন্মুক্ত ব্যবস্থা আমি টোকিওতে দেখিনি, লন্ডনে দেখিনি, প্যারিসে দেখিনি, রোমে দেখিনি, নিউ ইয়র্কে দেখিনি, ওয়াশিংটন ডিসিতেও দেখিনি! অনেক দিন আগের টরেন্টো ও মন্ট্রিয়েলের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে গেছি, তবে শুনেছি সিডনির সাবওয়েব্যবস্থা নাকি বার্লিনের মতোই।
আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন থেকে নেমে ওপরে যখন রাস্তায় উঠে এলাম, বুঝতে পারলাম হোটেলের ফ্্রন্ট ডেস্ক আমাকে ভুল নির্দেশনা দিয়েছে। ট্যুর বাস ধরার জন্য আমি সঠিক জায়গায় আসিনি। জায়গাটা প্রধানত আবাসিক। রাস্তার দুই ধারে সব বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, নিচতলায় দোকানপাট; কিন্তু রোববারের শীতের সকাল বলে ব্যবসায় বাণিজ্য সব বন্ধ। লোক চলাচল নেই, একা মানুষ, পকেটে পাঁচ-ছয় শ’ ডলার আছে বলে একটু ভয়ও হচ্ছে! কী করব, কোথায় যাবো, কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। দিশেহারা হয়ে কিছু দূর হাঁটার পর দেখলাম এক হেয়ার ড্রেসারের দোকান খোলা। কিন্তু দোকানের দরজায় একটা বিরাট কুকুর দাঁড়িয়ে আছে, তাই ওই দিকে না গিয়ে আরো হাঁটতে থাকলাম। ডান দিকে বাঁক নিয়ে আরেকটা দোকান খোলা পেলাম; কিন্তু সেটাও চুল কাটার দোকান।
জায়গাটা আরো নির্জন, তাই ফিরে এলাম সেই কুকুরওয়ালা দোকানে। এসে দেখলাম, কুকুর ভেতরে একটা সুন্দর পরিষ্কার বিছানায় শুয়ে আরামের ঘুম ঘুমোচ্ছে। বাহ, কী ভাগ্যবান বার্লিনের কুকুর! জগতের সব কুকুর যদি এভাবে নরম বিছানায় ঘুমোতে পারত! তবে এখানে একটি কথা আছে। বাংলাদেশে অনেকে কুকুর পোষে বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য। ছোটবেলা আমাদের গ্রামের বাড়িতেও একটি কুকুর ছিল, রাতে চোর এলে ঘেউ ঘেউ করে বাড়িসুদ্ধ লোকজনের ঘুম ভাঙাত। এ ভাবে আরামে ঘুমালে কি কুকুর রাতে চোর তাড়াতে পারবে?
চুল কাটা মানুষের আদি ব্যবসায়গুলোর অন্যতম, সবাই যখন ঘরে ঘুমোচ্ছে তখন বার্লিনের সব নাপিত জমজমাট ব্যবসায় করছে। দোকানি সেই কুকুর নিয়ে এসে দোকানদারি করছে, যে কুকুর মানুষের কাছে ঐতিহাসিকভাবে সবার আগে পোষ মেনেছিল। এসব তাত্ত্বিক ভাবনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ভেতরে ঢুকে ক্যাশিয়ারের কাছে আমার সমস্যার কথা বললাম। সে আমার কথা বুঝল। ট্যুর বাস কোম্পানিতে ফোন করে জেনে নিলো, তাদের বাসে উঠতে হলে আমাকে কোথায় যেতে হবে, কিভাবে যেতে হবে, কিন্তু সমস্যা হলো তার ইংরেজি জ্ঞান এমন নয় যে, আমাকে বলে বোঝাতে পারে। এ জন্য সে নিয়ে এলো চাদর গায়ে দেয়া, আধা চুল-কাটা হয়েছে এমন এক কাস্টমারকে। কাস্টমার মহিলা অত্যন্ত যত্নের সাথে আমাকে বলে দিলো, কোথায় এবং কিভাবে যেতে হবে। একটি হাসিমাখা ধন্যবাদ দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। হিসাব করে দেখলাম এখন আমাকে উল্টো দিকে বেশ কিছু দূর হেঁটে গিয়ে বাসে চড়ে যেতে হবে আরেক জায়গায়। পকেটে হাত দিয়ে দেখি, টিকিটের জন্য আমার কাছে প্রয়োজনীয় ভাঙতি পয়সা নেই।
বাস স্টপে এসে দেখলাম এ দিকে অনেক লোকসমাগম। নির্জন এলাকায় মানুষকেই ভয় পাচ্ছিলাম। আর এখানে এসে মানুষ দেখেই ডরভয় সব চলে গেল। মানুষ মানুষের ক্ষতি করে, ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আবার এ মানুষই মানুষকে অভয় দেয়, সাহায্য করে। দ্বিতীয় কিসিমের মানুষ বেশি আছে বলেই হয়তো বা দুনিয়াটা এখনো টিকে আছে, নয় তো কবেই ধ্বংস হয়ে যেত। বাস স্টপের সাথেই এক দোকানে ঢুকলাম টাকা ভাঙানোর জন্য। লাইনে দাঁড়িয়ে ক্যাশিয়ারের কাছে খুচরো চাইতে না চাইতে আমার ঠিক পেছনের লোকটি স্বপ্রণোদিত হয়ে আমার হাতে পাঁচ ইউরোর ধাতব মুদ্রা তুলে দিলো। তাকে একটি উষ্ণ ধন্যবাদসহ নোটখানা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। জার্মানরা যে এত ভালো মানুষ, তা তো জানতাম না। হবে না কেন? একটা জাতির মধ্যে যদি অন্তর্নিহিত কোনো মৌলিক গুণ না থাকে তা হলে তারা এত বড় হতে পারে না, এত ওপরে উঠতে পারে না! দেখলেন না, সবাই যখন সিরিয়ান শরণার্থীদের তাড়াতে পারলে বাঁচে, তখন জার্মানির অ্যাঙ্গেলা মার্কেল কী সাহসিকতা ও মহানুভবতার পরিচয়টাই না দিলেন! নোবেল কমিটি এ মহীয়সী মানুষটিকে স্বীকৃতি না দিলে কী হবে, তিনি দুনিয়ার তাবৎ, মানবদরদি মানুষের হৃদয়ে নোবেলের মেডেল হয়ে আলো ছড়াবেন যুগ যুগ ধরে!
বাংলাদেশ ষোলো কোটি মানুষের একটি জাতিরাষ্ট্র। এখানে গত ৪৫ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে অনেক উন্নতি হয়েছে, আগামীতে আরো হবে। এখন ভেবে দেখতে হবে, এ আত্মপ্রত্যয়ী ও পরিশ্রমী জাতির আর কী কী মানবিক ও নৈতিক গুণ আছে, যা কিনা অদূর ভবিষ্যতে তাকে বিশ্বসভায় একটি উঁচু ও সম্মানিত আসনে বসতে সাহায্য করবে। ওই গুণগুলোকে শনাক্ত করে একটি ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের হৃদয়-মনে ছড়িয়ে দিতে হবে। তারপর ওই গুণগুলোকে সর্বদা শাণ দিতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে পৃথিবীর কোনো শক্তিই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
এত সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখলাম, বাস এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য যাত্রীর সাথে আমিও বাসে উঠে গন্তব্যে গিয়ে নামলাম। তারপর কয়েক কদম হেঁটে এক বিশাল পুরনো চার্চের পাশে গিয়ে টিকিট কেটে ট্যুর বাসে উঠে বসলাম। বার্লিনের চোখ ঝলসানো বড় বড় দালান কোঠা, চওড়া সোজা রাস্তা, পর্যটকদের ভিড়, ফুটপাথে মানুষজনের কর্মচাঞ্চল্য ইত্যাদি দেখে দেখে চোখ দু’টো ক্লান্ত হয়ে আসছে। হেডফোনে ধারা বর্ণনা শুনছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোন রাস্তায় কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, কোন কোন দালান পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে, কোনগুলো যুদ্ধের আগের বিল্ডিং, কোনগুলো পরে তৈরি, হিটলার কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে জার্মান নাগরিকত্বের শপথ নিয়েছিল ইত্যাদি, ইত্যাদি।
শুনছি আর ভাবছি, বার্লিনের ইতিহাস মানে যুদ্ধের ইতিহাস, বার্লিনের ইতিহাস মানে হিটলারের ইতিহাস। বার্লিন তথা আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস পড়তে গেলে এর পাতায় পাতায় পাওয়া যায় হিটলারের হাতের ছোঁয়া। আরো ভাবছি, কে বলে হিটলার পরাজিত হয়েছে? সে হয়তো বা যুদ্ধে হেরেছে, কিন্তু দিব্যিই তো সে ইতিহাস ‘জয় করে’ বসে আছে। হিটলারকে বাদ দিয়ে আজো আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস হয় না। বার্লিনের ব্যস্ততম রাজপথে হাঁটতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, আমি যেন হিটলারের ছায়া দেখছি, চুপি চুপি আমাকে অনুসরণ করছে এবং কানে কানে বলছে, What is war, no one knows better than a warrior. 'What is war, no one knows better than Hitler'.
বার্লিন দেখতে গিয়ে আরেকটি বিষয়ে আমার বোধোদয় হলো। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যত শাখা-প্রশাখা আছে তার মাঝে ব্যাপ্তিতে ও গভীরতায় ইতিহাস সবচেয়ে ব্যাপক, বিস্তৃত, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। আজ যা ভাষা, আজ যা অর্থনীতি, আজ যা রাজনীতি কিংবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আজ যা কূটনীতি, যা রণনীতি, আজ যা সমাজবিজ্ঞান, কালের আবর্তে সব কিছুই বিলীন হয়ে যায় ইতিহাসের গর্ভে, সব কিছু গলিত মথিত হয়ে, হয়ে যায় ইতিহাস! সময়ের সাথে সাথে ইতিহাস ধারণ করে ফেলে অন্য সব জ্ঞানকে। তাই ইতিহাসকে বলা যায় সব জ্ঞানের উদার ও যত্নশীল ধারক ও সংরক্ষক। বলে রাখি, পুরনো দিনের তথ্য-উপাত্তের সমাহারই ইতিহাস নয়, সত্যের অনুসন্ধানও ইতিহাস নয়, অতীত দিনের ঘটনাবলির বর্ণনাও ইতিহাস নয়। ইতিহাস হলো বর্তমান থেকে অতীতকে দেখা, বোঝা ও ব্যাখ্যা করা। যেহেতু বর্তমান বদলায়, তাই ইতিহাসও বদলায়।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতির প্রফেসর ও অ্যাকাডেমিক জার্নাল সম্পাদক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন