নবজাত শিশুরা দিনে ১৮-২০ ঘণ্টা ঘুমায়। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য সাত-আট ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। তারপর বয়স যত বাড়ে, মানুষের জীবনে স্ট্রেস-টেনশন ততই বাড়তে থাকে এবং এর সাথে সাথে ঘুমও কমে যায়। বয়সের সাথে স্ট্রেস-টেনশন কেন বাড়ে এবং ঘুম কেন কম হয়Ñ এ প্রশ্নগুলো আজকের এ নিবন্ধের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। ইতোমধ্যে বয়সে ষাটের কোঠা পেরিয়ে এসেছি। স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারি, কোনো কোনো রাতে ঘুমের বেশ অসুবিধা হয়। এমনি এক রাতে ঘুম আসছিল না। বিছানায় ছটফট করছি আর মাথায় এলোমেলো বিচ্ছিন্ন সব ভাবনা এসে জট পাকাচ্ছে। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, এক লাফে আমার মনের ঘড়ির কাঁটা চলে গেছে ৫০ বছর পেছনে।
১০-১২ বছরের ছেলে- সেই আমি শুয়ে আছি আমাদের গলগজা গ্রামের পুরনো বাড়ির দক্ষিণ পাশের বাঁশের বেড়া আর কাঁচা মেঝের চারচালা টিনের ঘরের একটি ছোট্ট কামরায়। ঘরের বেড়ার ফাঁকে ঠাণ্ডা বাতাস যেমন অবাধে বয়ে বেড়াত; তেমনি ঘর থেকে স্পষ্ট শোনা যেত বাইরের সব হৈ-হুল্লোড় এবং চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ। সঙ্গত কারণেই দিনের চেয়ে রাতে আওয়াজ শোনা যেত ঢের বেশি। ওই সময় শীতকালে গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে যা শুনতে পেতাম, সে দিন রাতে আমার ন্যাশভিলের বাড়িতে শুয়ে মনে হলো সেটাই যেন শুনছি, ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাও চইলা...।’
আমাদের ঘরের পেছন দিয়েই ছিল গ্রামের লোকজনের চলাচলের জন্য সরু আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। ওই পথ ধরে সন্ধ্যায় শুরু হতো হাটবাজার শেষে মানুষজনের বাড়ি ফেরার পালা; বিশেষ করে শুক্র, রবি ও মঙ্গলবারে। ওই দিনগুলোতে হাজীগঞ্জ বাজার সেরে দলে দলে গল্প করে গ্রামের লোকজন হেঁটে যেত আমাদের ঘরের পাশ দিয়ে। কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যেত না, তবুও ঘরের ভেতরে আমাদের কানে ভেসে আসত অনর্গল আড্ডারত মানুষজনের গুঞ্জন আর তাদের পায়ের আওয়াজ। যারা দেরি করে বাজার থেকে ফিরত, তারা গভীর রাতে একা একা চলত একই পথ ধরে, আমাদের ঘরের পেছনের রাস্তা দিয়ে। যেহেতু একা থাকত, তাই মনে ভূতের ভয় তাড়ানোর জন্য জোরগলায় গান গেয়ে গেয়ে বাড়ি ফিরত। ততক্ষণে আমাদের দু-এক চক্র ঘুম পুরো হয়ে যেত। ঘুম ভাঙলে বিছানায় শুয়েই শুনতে পেতাম হাঁটছে আর সুর করে চড়াগলায় গাইছেÑ ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাও চইলা...।’ এমন মধুর গান শুনতে শুনতে কখন যে আবার ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়তাম, বুঝতেও পারতাম না।
গ্রামের নদীনালা, খালবিল পানিতে ভরে টইট¤ু^র হয় বর্ষাকালে। ওই সময় নাইওরি নাও বাইতে বাইতে মাঝি ভাটিয়ালি সুরে এমন গান গেয়ে থাকেন। শীতকালে কৃষকের গলায় কেন ‘গরমকালের এমন গান?’ সে প্রশ্ন করার মতো বয়স তখনো হয়নি, তাই কাউকে করা হয়নি। কিন্তু পেছন ফিরে এখনো যখন ভাবি, তখনো অসময়ে ভাটিয়ালি গানের কোনো হদিস খুঁজে পাই না। কৌতূহলী মনকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করি, হয়তো বা তারা অন্য কোনো গান জানতই না। হয়তো বা ভাটিয়ালি গানের আবেদন গ্রাম্য কৃষকের জীবনে সময় কিংবা ঋতুর বন্ধনে বাধা পড়ে থাকতে চাইত না। এ বিষয়ে আরো জানার জন্য চিরায়ত বাংলার লোকসঙ্গীতের কিছু বইপত্র জোগাড় করার চেষ্টা করে এখনো সফল হতে পারিনি, ভবিষ্যতের কথা জানি না।
তিরিশ বছরেরও অধিক কাল, মার্কিন মুল্লুকে স্বেচ্ছায় প্রবাসজীবন বেছে নিয়েছি। মাঝে মধ্যে অবশ্য দেশে যাই। কোনো সময় পেশাগত কাজে, কোনো সময় সাংসারিক প্রয়োজনে, আবার কোনো সময় বেড়াতে ও ছুটি কাটাতে। কিন্তু গেলেও বেশির ভাগ সময় ঢাকাতেই থাকা হয়। গ্রামের বাড়িতে প্রতিবার যেতে পারি না। মাঝে মধ্যে গেলেও মাত্র দু-এক দিনের জন্য। কিছুটা চোর-ডাকাতের ভয়ে, আর কিছুটা সময়ের অভাবে। তার পরও রাতের বেলা গ্রামের ওই বাড়িতে ওই ঘরে ঘুমানোর সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা শহরের পাশে আমাদের অরেকটা বাড়ি আছে। আজকাল সেখানে থাকাই অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ মনে করি। প্রায় দেড় যুগ হতে চলল, বড়লেখাতেও আর যাওয়া হয় না। তাই প্রায়ই আমার জানতে খুব ইচ্ছে করে, আমাদের গ্রামের পুরনো বাড়িতে ওই ঘর কি এখনো আছে, থাকলে তার পাশের সেই মেঠোপথের দশাই বা কী? সে পথ ধরে এখনো কি কাঞ্চনপুর, গোপালপুর, গগড়া, ভটরমাল, ভাগীরপার, ধর্মদেহীর বাজার ফেরা লোকজন গভীর রাতে গান গেয়ে বাড়ি ফেরে? প্রশ্নগুলো যখন তখন মনে উঁকি মারে। জিজ্ঞেস করার মতো হাতের কাছে কাউকে খুঁজে পাই না।
আপন মনের সওয়ালের জওয়াব নিজে খুঁজতে গিয়ে ভাবি, হয়তো বা এখন আর বাজারফেরত লোকজনের ওইভাবে জোরে জোরে গান গেয়ে বাড়ি ফেরার দরকার পড়ে না। কারণ ওইসব জায়গায় এখন আর রাতের বেলা অন্ধকার থাকে না। পল্লী বিদ্যুতের বদৌলতে ওই রাস্তা এখন সারা রাত আলো ঝলমল করে। আগে ওখানে অন্ধকারে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকির মেলা বসত এবং ওই একই জায়গা পরিণত হতো গা ছমছম করা ভয়াল এক পেতিœপুরীতে। আর আমাদের ছোট্ট ঘরের পেছনের রাস্তার ওপরে হয়তো এখন ফকফকা বিদ্যুৎ বাতির চার দিকে গিজগিজ করে হাজার জাতের কীটপতঙ্গ। পাখি ভিড় করে ওড়াউড়ি করা পাখনাপোড়া হরেক রকমের ফড়িং আর পোকা খাওয়ার জন্য। এমন পরিবেশে মানুষের মনে এখন জিন-ভূতের আর ভয় থাকবে কেন, বরং আমি বলি, আলোর ভয়ে ভূতেরাই পালিয়েছে গ্রাম ছেড়ে গহিন জঙ্গলে; পূর্বে অনেক দূরে, পাথারিয়া পহাড়ে। আমার এসব অনুমান যদিও বা মিথ্যা হয়, তথাপি আমার আশায় গুড়েবালি। কিভাবে, সে কথাতেই আসছি।
একদিন ফোন করেছিলাম গ্রামের বাড়িতে আমার এক চাচাকে। তার সাথে আমার বয়সের তফাত খুব একটা বেশি নয়। তিনি যতটা না আমার চাচা, তার চেয়ে বেশি বন্ধু! তাকে ছোটবেলা থেকেই আপনির বদলে তুমি বলেই সম্বোধন করে থাকি। ফোনে জানতে চাইলাম বাড়ি-ঘর-দরজার কথা। তিনি বললেন, দক্ষিণের ওই ঘরটি পুরনো হয়ে একেবারে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। তাই ওটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে গড়ে উঠেছে একটি পাকা দালান। এতে বাড়ির সবাই যত খুশি, ততটা খুশি হতে পারলাম না নিজে। দালানকোঠায় ফাঁক-ফোকর নেই; দরজা-জানালা বন্ধ করলে টিনের কাঁচাঘরের মতো সে ঘরে আর আলো-বাতাস খেলে না। বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে। তাই নতুন দালানঘরে ফ্যান চলে ও বাতি জ্বলে। এর মধ্যে হয়তো বা এসিও লাগানো হয়ে গেছে। মজবুত দালানঘরের সুুবিধাটা সবাই বোঝে। ছোট-বড় সবাই, এমনকি বাড়ির চাকরটি পর্যন্ত। পাকা ইমারত গরমকালে টিনের ঘরের মতো গরম হয় না এবং শীতকালে তেমন ঠাণ্ডাও হয় না। বাহ, কী মজা!
মজা যতই হোক না কেন, আফসোস অন্যখানে। সুবিধা যত সহজেই বুঝুক না কেন, অসুবিধা কারো চোখে ধরা পড়েনি; কারো হৃদয় এতটুকু স্পর্শ করেছে বলেও মনে হয় না। শীতকালে দালানঘরে চার দিক থেকে যেমন নির্মল কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া হু হু করে ঢোকে না, তেমনি পেছনের রাস্তা থেকে ভেসে আসে না অজানা-অচেনা বাজারফেরত গ্রাম্য কৃষককণ্ঠের সুমিষ্ট ভাটিয়ালি গানের সুর। সে সুরের মূর্ছনায় ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের ওই কাঁচাঘরের শক্ত বিছানায় কাঁথার নিচে বড় আরামের ঘুম ঘুমাতাম! আধুনিকতা এবং বৈষয়িক উন্নয়ন আমাদের দিয়েছে অনেক, আবার যা নিয়েছে, তাও কম নয়! যা দিয়েছে, তা টাকার অঙ্কে হিসাব করা যায়। কিন্তু যা নিয়েছে, তার কোনো মাপজোক হয় না! হয় কি?
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর- জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ;
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন