নবাব স্যার সলিমুল্লাহ্র নাম শোনেননি, বাংলাদেশে শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেই আমার বিশ্বাস, তবে এটাও আমি মনে করি যে, ঊনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশভারতে পিছিয়ে পড়া পূর্ববাংলার অর্থনীতি, সমাজ, শিক্ষা, ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্যার সলিমুল্লাহ্র অবদানের ব্যাপ্তী ও গভীরতা অনেকেরই অজানা। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আমি নিজেও জানতাম না আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে
তিনি কেবলই তাঁর অগাধ সম্পদ বিলিয়ে দেননি, তারচেয়েও অনেক বড় মূল্য তিনি পরিশোধ করে গেছেন যার মাপজোক কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমাদের এবং আমাদের পূর্বপ্রজন্মের জন্য তিনি কতখানি ত্যাগ স্বীকার করে
গেছেন, তার একটি আন্দাজ আপনারা পেয়ে যাবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই।
এটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার সমাজ বিনির্মাণে স্যার সলিমুল্লাহ অবদানের কোনো মূল্যায়নও হচ্ছে না। সলিমুল্লাহ্ মেডিক্যাল কলেজ, আহসানউল্লাহ্ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে যা বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয় সংক্ষেপে বুয়েট), আহসানউল্লাহ্ এতিমখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল,
নারায়ণগঞ্জের সলিমুল্লাহ্ রোড। এ ছাড়া বাংলাদেশের আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে স্যার সলিমুল্লাহ্র নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি ঢাকাসহ পূর্ববাংলার বিভিনড়ব জায়গায়, মসজিদ, মাদ্রাসা, ছাত্রদের জন্য আবাসিক হোস্টেল, হাসপাতাল, এতিমখানা করে গেছেন। পূর্ববাংলার কৃষি উৎপাদন ও হস্তশিল্প সম্প্রসারণের জন্য তিনি নিজ খরচে ঢাকায় কৃষিপণ্য ও হস্তশিল্প প্রদর্শণীর আয়োজন করেছিলেন।
স্যার সলিমুল্লাহ পূর্বপুরুষ খাজা আব্দুল হাকিম, মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহ্র আমলে কাশ্মীরের গভর্নর ছিলেন। ১৭৩৯ সালে নাদির শাহ্ যখন ভারত আক্রমণ করে তখন খাজা আব্দুল হাকিম তৎকালীন আসামের অন্তর্গত সিলেট অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁরই বংশধর খাজা আব্দুল গনি মিঞা ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে ঢাকায় এসে প্রথমে ব্যবসা
এবং পরে নবাবী প্রতিষ্ঠা করেন। প্রম থেকেই ঢাকার নওয়াব পরিবার পূর্ববাংলার অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উনড়বয়নের ব্যাপারে ছিলেন খুবই মনোযোগী, মুক্তহস্ত, স্পর্শকাতর এবং যতড়বশীল।
স্যার সলিমুল্লাহ জন্ম হয় ১৮৭১ সালের ৭ জুন ঢাকার আহসান মঞ্জিলে। তাঁর পিতার নাম ছিল নওয়াব খাজা আহ্সানউল্লাহ্ এবং মা ছিলেন বেগম ওয়াহিদুনেড়বছা। তাঁর দাদা নওয়াব খাজা আব্দুল গনি মিঞার নামেই রাখা
হয়েছে ঢাকার সচিবালয় এবং উসমানী মিলনায়তনের মাঝখানের রাস্তার নাম। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী, স্যার সলিমুল্লাহ্ ছোটবেলা স্কুলে না গিয়ে ঘরোয়া পরিবেশে উর্দু, আরবি, ফারসি ও ইংরেজি শেখেন। ১৮৯৩ সালে তিনি ইংরেজ সরকারের অধীনে ডেপুটি ম্যাজিট্রেটের চাকরি নেন। মাত্র দু’বছর পর, সরকারি কাজে ইস্তফা দিয়ে ময়মনসিংহে গিয়ে পাটের ব্যবসা শুরু করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, আহসান মঞ্জিল থেকে দূরে সরে গিয়ে ব্যবসা শুরুর পেছনে একটা অন্তর্নিহিত কারণও ছিল। স্যার সলিমুল্লাহ্ ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে তাঁর পিতার গুরুতর মতভেদের জন্য
তিনি ইচ্ছা করে বাবা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন।
১৯০১ সালে পিতার মৃত্যু হলে, প্রথম ছেলে হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ্ আহসান মঞ্জিলে ফিরে এসে নবাব টাইটেল নিয়ে পুরো জমিদারির দায়িত্ব নেন। তখন কলকাতাকে রাজধানী করে, পূর্ববাংলা, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ও উড়িষ্যা মিলে ছিল এক বিশাল প্রদেশ। এর মধ্যে পূর্ববাংলা (অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ) ছিল সবচেয়ে উপেক্ষিত ও পিছিয়ে পড়া এলাকা। এ অঞ্চলের মুসলমানদের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গড়ার জন্য ১৯০৩ সালে শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। ওই আন্দোলনের মাধ্যমে স্যার সলিমুল্লাহ্ প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ওই সময় তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত গঠনের জন্য সহযোগীদের নিয়ে সারা পূর্ববাংলা চষে বেড়িয়েছেন। তাঁরই
ডাকে, ১৯০৪ সালের ১১ই জানুয়ারি আহসান মঞ্জিলে পূর্ববাংলার নেত্রীস্থানীয় হিন্দু-মুসলমান ব্যক্তিদের এক গুরুত্বপূর্ণ সভা বসে। ওই সভায় তিনি বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার কিছু কিছু বিষয়ের বিরোধিতা করে তাঁর দৃঢ় মতামত ব্যক্ত করেন। এক মাস পর, ফেব্রুয়ারি ১৮-১৯ তারিখ বড়লাট লর্ড কার্জন ঢাকা আসেন এবং স্যার সলিমুল্লাহ আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।
তখন বড়লাটের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে, স্যার সলিমুল্লাহ্ বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার সব খুঁটিনাটি বিষয়ের চূড়ান্ত মীমাংসা করেন। সেই সমঝোতা অনুযায়ী, ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববাংলা ও
আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হয়।
ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ হওয়ার ফলে ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত পূর্ববাংলার ভীষণভাবে পিছিয়ে পড়া সাধারণ জনগণের মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলকলেজে ভর্তির হার বেড়ে যায় ৩৫ শতাংশের ওপরে। প্রাদেশিক সরকারের আনুকূল্যে এখানকার ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা নতুন উদ্যমে ব্যবসাবাণিজ্য শুরু করেন। ১৯০৬ সালে আঞ্চলিক সওদাগররা চট্টগ্রাম -
রেঙ্গুন জাহাজ সার্ভিস চালু করেন। ওই সময়ে পূর্ববাংলার মানুষদের জন্য এর প্রত্যেকটি ছিল সফলতার একেকটি মাইলফলক, যা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের কারণে। যে দিন বঙ্গভঙ্গ অধ্যাদেশ কার্যকর হয়, সেদিনই স্যার সলিমুল্লাহ্র সভাপতিত্বে ঢাকার নর্থব্রুক হলে পূর্ববাংলার মুসলমান নেতাদের এক সভা হয়। ঐ সভায় ‘মোহামেডান প্রোভিন্সিয়াল ইউনিয়ন’ নামে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম তৈরি হয়। পরবর্তীকালে এই প্ল্যাটফরমের ওপর ভিত্তি করেই, স্যার সলিমুল্লাহ্র নেতৃত্বে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় জন্ম হয় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের। স্যার সলিমুল্লাহ আমন্ত্রণে, ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর ২৭-৩০, এই তিন দিনের জন্য নবাবের ঢাকাস্থ শাহ্বাগের বাগানবাড়িতে এক বিরাট সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে গোটা ভারত থেকে দুই হাজার মুসলিম ডেলিগেট ঢাকায় আসেন। অতিথিদের তিন দিনের থাকাখাওয়া এবং সম্মেলনের অন্যান্য যাবতীয় খরচ বাবদ স্যার সলিমুল্লাহ্ তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে অনুদান দিয়েছিলেন নগদ ৬ লাখ টাকা। ১৯০৬ সালের ৬ লাখ টাকার মূল্যমান আজকে কত হতে পারে আপনারা সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন!
বঙ্গভঙ্গের ফলে স্থাপিত নতুন প্রদেশে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ১৯০৯ সালের ২১ মার্চ, হিন্দু-মুসলমান নেতাদের একসাথে করে তিনি ‘ইম্পেরিয়াল লীগ অফ ইষ্ট বেঙ্গল এ্যান্ড আসাম’ নামে একটি শক্তিশালী সামাজিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন প্রদেশে পূর্ববাংলার সাধারণ মুসলমান জনগণের নতুন ক্ষমতায়নের ফলে, জোতদার, জমিদার, মহাজন, ও কলকাতা কেন্দ্রিক ডাক্তার, উকিল, মোক্তারসহ কিছু সুবিধাবাদী পেশাজীবিদের স্বার্থে দারুণ আঘাত লাগে। ঘটনাক্রমে তাঁরা সবাই
ক্ষমতাশালী এলিট শ্রেণীর লোক ছিলেন। তাই, কোনো অবস্থাতেই তারা বঙ্গভঙ্গকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের উৎসাহে ও প্ররোচনায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রদেশজুড়ে গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাসী আন্দোলন শুরু হয়। স্যার সলিমুল্লাহ্কে ব্রিটিশরাজের শত্রু হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ওই সময় তাঁকে কুমিল্লায় গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়। একই সময় কুমিল্লা থেকে ঢাকা
ফিরে আসার পথে, তাঁর ট্রেন লাইনচ্যুত করা হয়, তাঁকে হত্যার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা হিসেবে। ভাগ্যক্রমে তিনি সে যাত্রাও বেঁচে যান। কলকাতা কেন্দ্রিক পূর্ববাংলার মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী গোষ্ঠী বঙ্গভঙ্গ বাতিলের উদ্দেশ্যে দূর্বার অন্দোলন গড়ে তোলে। এতে একপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথও এসে যোগ দেন এবং রচনা করেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায়
ভালোবাসি...’।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী আন্দোলনের তীব্রতা বাড়লে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ব্রিটিশরাজ বঙ্গভঙ্গ রহিত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে রাজা পঞ্চম জর্জ দিল্লির দরবার হলে এই মর্মে ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা কার্যকর হয় ১৯১২ সালের ১লা এপ্রিল। একই সময়ে ব্রিটিশভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে
স্যার সলিমুল্লাহ দারুণভাবে আশাহত হয়ে ব্রিটিশদের ওপর ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হন। প্রতিবাদে তিনি ব্রিটিশরাজের দেওয়া জিসিআইই ব্যাজ ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং অনতি বিলম্বে পূর্ববাংলার অবহেলিত জনগণের স্বার্থ রক্ষার
জন্য একটি আট দফা দাবি রাজা পঞ্চম জর্জের কাছে পেশ করেন। এ সব দাবির মধ্যে ছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়, হাইকোর্ট, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের একজন শিক্ষা অফিসারের পদায়ন। হাইকোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিনি ঢাকার রমনায় প্রয়োজনীয় জমি সম্প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন।
তাঁর মুত্যুর পর, টাঙ্গাইলের জমিদার নবাব সৈয়দ নওয়াব আলীসহ আরো কয়েকজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তির উদ্যোগে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়, হাইকোর্ট, ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা অফিসার পদায়নের দাবি বাস্তবায়িত হয়। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস স্থাপিত হয়েছে যে জমির ওপর তা ঢাকার নবাব পরিবারেরই বদান্যতায় পাওয়া।
নবাব সলিমুল্লাহ্ কাছ থেকে পূর্ববাংলার গরিব মুসলমানদের আরো অনেক কিছু পাওয়ার ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, কিছু দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি তাঁর কলকাতার চৌরঙ্গীর বাড়িতে স্যার সলিমুল্লাহকে মৃত পাওয়া যায়। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৪ বছর। মৃত্যুর অব্যবহিত পর যাঁরা মৃতদেহের বিবর্ণ চেহারা ও মুখের বিকৃতি দেখেছেন, তাঁদের কাছে মনে হয়েছে যে, স্যার সলিমুল্লাহকে বিষপানে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর লাশ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সিলগালা করা কফিনে ব্রিটিশ সৈন্যদের কড়া পাহারায় নদীপথে কলকাতা থেকে ঢাকায় আনা হয় এবং বেগম
বাজারে তাঁদের পারিবারিক গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। সড়কপথে কিংবা রেলযোগে তাঁর লাশ ঢাকায় আনার ব্যাপারে ব্রিটিশরাজ সাহস পায়নি।
তাদের ভয় ছিল নবাবের অনুসারী শোকাহত ও ক্ষুব্ধ জনগণ পথিমধ্যে কফিন ভেঙ্গে মৃত নবাবের বিকৃত চেহারা দেখে ফেলতে পারেন! স্যার সলিমুল্লাহ্র লাশ যখন ঢাকার সদর ঘাটে আসে তখন হাজার হাজার মানুষ শেষবারের মতো তাঁদের প্রিয় নবাবের মুখ দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাহারারত ব্রিটিশ সৈন্যরা কাউকেই লাশের চেহারা দেখতে দেয়নি। এমন কী তাঁর স্ত্রীসন্তান এবং স্বজনরাও শেষবারের মতো মৃত নবাবের মুখ দেখতে পারেননি। লাশ দাফনের পর, ব্রিটিশ সৈন্যরা আহসান মঞ্জিল এবং স্যার সলিমুল্লাহ কবরের চারপাশ দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা ঘেরাও করে রেখেছিল টানা ছ’মাস। এভাবে লাশ পচে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার পরই কেবল তারা তাদের পাহারা প্রত্যাহার করে। তার আগে নয়। এতে অনেকের ধারণা, স্যার সলিমুল্লাহ্কে বিষপানে হত্যা করা হয়েছিল এবং এ হত্যা ষড়যন্ত্রের সাথে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরোধী ও ব্রিটিশরাজের যুক্ত থাকা অসম্ভব নয়। কারণ বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকারের
বিরুদ্ধে স্যার সলিমুল্লাহ্ অনেক কড়া কড়া বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছিলেন।
এটা হয়ত কোনো দিনই জানা যাবে না, কে কীভাবে স্যার সলিমুল্লাহ খাবারে বিষ দিয়েছিল, কিন্তু এটা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের অবশ্যই জানা উচিৎ, পূর্ববাংলার অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য স্যার সলিমুল্লাহ্ যে আযান দিয়ে গেছেন তার ধ্বনি প্রতিধ্বনি এখনো বাংলার আকাশে বাতাসে মিশে আছে, কিন্তু তাঁরা তা শুনতে পাচ্ছেন না। স্যার সলিমুল্লাহ জন্ম না হলে ক্ষণকালের জন্যও হয়তো বঙ্গভঙ্গ হতো না। হয়ত মুসলিম লীগের জন্মই হতো না, হয়তো পাকিস্তানও হতো না। আর পাকিস্তান না হলে, স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার প্রশ্নই উঠত না। স্যার সলিমুল্লাহ্র জন্ম না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়তো আরো পিছিয়ে যেত। পূর্ববাংলার অনগ্রসর মুসলমানরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত থাকত। এমতাবস্থায় পাকিস্তান স্বাধীন হলেও পূর্বপাকিস্তানের সরকার ও প্রশাসন চালাবার মতো যোগ্য শিক্ষিত জনশক্তি পাওয়া দুষ্কর হতো। স্যার সলিমুল্লাহ্, ব্রিটিশ ভারতে পূর্ববাংলার হতদরিদ্র মানুষদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শুধু প্রথম কাতারের একজন সৈনিকই নন, বরং প্রথম দিককার একজন শহীদও বটে!
লেখক : আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন