ছোটবেলায় যখন হাইস্কুলে পড়তাম, তখন স্কুলের সামনে প্রায়ই চা-বাগানের ছোট ছোট ট্রাক্টর-ট্রেইলার সিঅ্যান্ডবির কাঁচা রাস্তা দিয়ে ঘট ঘট আওয়াজ করে চলতে দেখতাম। মাঝে মধ্যে দেখতাম ট্রেইলার বোঝাই করে লোহার পাতে সিল করা কাঠের বাক্সে চা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রেলস্টেশনের দিকে। সে চা ট্রেনের ওয়াগন ভরে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে রফতানি হতো বিদেশের বাজারে। বলে রাখা প্রয়োজন, গত শতকের ষাটের দশকে মৌলভীবাজারের বড়লেখা অঞ্চলে দেশী মালিকানায় ছোটবড় বেশ কয়েকটি চা-বাগান ছিল এবং এখনো আছে।
স্কুলের ছাত্র হিসেবে সে বয়সে চা-বাগানের ট্রাক্টর-ট্রেইলার, তার আওয়াজ, বাক্সভর্তি চা কিংবা বিদেশে তার রফতানি, কোনো কিছু আমার মনে কোনো প্রশ্নের জন্ম দেয়নি। তবে যে লোকটি মনে কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল, সে হলো ওই ট্রাক্টর-ট্রেইলারের চালক। তার ঠোঁটের ওপরে কাঁচা-পাকা গোঁফ, মাথায় রঙিন কাপড়ের পাগড়ি, খালি গা, পরনে ময়লা ধুতি, উন্মুক্ত দু’খানা পা, মুখে বাংলা, হিন্দি ও উর্দুমিশ্রিত এক জগাখিচুড়ি ভাষা। চালকের এমন অবয়ব দেখে আমার মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছিল। যেমনÑ লোকগুলো কি স্থানীয়, না হলে এরা কোত্থেকে কবে এলেন, তারা স্থানীয় লোকদের সাথে মেলামেশা ও আত্মীয়তা করেন না কেন, কেন স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি জানেন না, তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে দেখা যায় না কেন? ইত্যাদি।
বড় হয়ে প্রশ্নগুলোর যে উত্তর পেয়েছি, তা নিয়েই লিখতে বসেছি আজকের এ নিবন্ধ। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সিলেটে প্রথম চা-এর আবাদ শুরু হয় আজ থেকে দেড় শ’ বছরেরও বেশি আগে। আটারো শ’ পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ কোম্পানি, ডানকান ব্রাদারস সিলেট অঞ্চলে প্রথম চা-চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারপর ওই এলাকায় ছোট ছোট পাহাড়, টিলা ও জঙ্গল অধ্যুষিত বিপুল জমি অধিগ্রহণ করে। চা-এর চারা রোপণের আগে জঙ্গল পরিষ্কার করা এবং পরবর্তীপর্যায়ে চা-চারার পরিচর্যার জন্য ডানকান ব্রাদার্স ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় আসাম, মাদ্রাজ, বিহার, উড়িষ্যা ও ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক সিলেটে নিয়ে আসে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এ কাজে সিলেট অঞ্চলের স্থানীয় শ্রমিকদের ব্যবহার না করে এত দূর থেকে যাতায়াত খরচ দিয়ে ভিন্ন প্রদেশের ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির শ্রমিকদের এখানে নিয়ে এলো কেন? এর অনেক কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, অপেক্ষাকৃত গরম ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় বসবাসকারী, অশিক্ষিত, নি¤œবর্ণ গরিব জনগোষ্ঠী স্থানীয় শ্রমিকদের তুলনায় বেশি কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী হবেন। দ্বিতীয়ত, যেহেতু এরা সমাজের একেবারে নি¤œবর্ণের লোক, তাই তাদের একেবারে ছ’কড়া ন’কড়া মজুরিতে খাটানো সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, যেহেতু এরা স্থানীয় ভাষা সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি অপরিচিত, তাই তাদের দেশ, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন্ করে বন্দী-শ্রমিক (ক্যাপটিভ লেবার) হিসেবে যুগ যুগ ধরে অল্প মজুরিতে কাজে লাগিয়ে রাখা যাবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই।
১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে চা-এর চাষ শুরু হয়। ১৮৫৪ সালে ডানকান ব্রাদারস সিলেটের সুরমা ভ্যালির মালনীছড়ায় বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা-বাগান আবাদ করে। ১৮৫৭তে শুরু হয় এর উৎপাদন। ১৮৬০ সালে এটা সম্প্রসারিত হয় লালচান্দ এবং মের্টিঙ্গায়। বাংলাদেশে চা-শ্রমিকদের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁদের সিলেটে আনার সময় ডানকান ব্রাদারস ও ব্রিটিশ কর্মকর্তারা একটা ন্যক্কারজনক প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন। সহজ সরল লোকগুলোকে বলা হয়েছিল, ‘তারা সিলেটে এসে পাহাড়ি অঞ্চলে একধরনের গাছের যত্ন নেবেন যে গাছের গোড়ায় ঝাঁকি দিলে সত্যিকারভাবেই সোনালি রঙের সোনার পাতা গাছ থেকে ঝরে ঝরে পড়বে এবং সেই মূল্যবান সোনার পাতা তারা সহজেই কুড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসতে পারবেন’ (জোনস্ রিপোর্ট ১৯৮৬ : ১১)। গরিব ও অশিক্ষিত, নিম্নবর্ণের হাজার হাজার চা-শ্রমিক ব্রিটিশদের কথায় সরল বিশ্বাস রেখে খাঁটি সোনার লোভে নিজেদের দেশ ও সমাজ ছেড়ে, বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে কয়েক শত মাইল দূরে এসে সিলেটের চা-বাগানের খাঁচায় বন্দী হলেন। তারপর কেটে গেল দীর্ঘ দেড় শ’ বছরেরও বেশি সময়। ব্রিটিশ বিদায় নিলো, ভারত স্বাধীন হলো, পাকিস্তান কায়েম হলো, বাংলাদেশ জন্ম নিলো। কিন্তু এখানকার চা-শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। বদ্ধ খাঁচায় বন্দী পাখির মতো এখনো তারা ছটফট করছেন আগের মতোই!
বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং পঞ্চগড় অঞ্চলে সর্বমোট জেলায় ১৬৩টি চা-বাগান আছে। সব বাগানে প্রায় দেড় লাখ চা-শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ নারী শ্রমিক। চা-এর পাতা তোলার কাজ নারীরা পুরুষদের চেয়ে ভালো পারেন এবং তাদের মজুরি পুরুষদের চেয়ে কম, তাই মালিকেরা নারী শ্রমিকদের এ কাজে বেশি পছন্দ করে। পুরুষ শ্রমিকেরা অবশ্য জঙ্গল সাফ করা, গাছ কাটা ও বয়ে নেয়া, মাটি কাটা, রাস্তা বানানো মেরামত ও অন্যান্য ভারী কাজ করে থাকেন। প্রতি আটজন শ্রমিক কাজ করেন একজন সর্দারের অধীনে এবং চৌকিদারেরা সরদারদের ‘ওপরওয়ালা’। চৌকিদারেরা সাধারণত স্থানীয় বাঙালি হয়ে থাকেন। তারা প্রতিদিন সকালবেলা এসে সরদারদের কাজ দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দিয়ে যান।
চা-শ্রমিকেরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে আসছেন। এ দেশে বর্তমানে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চা-চাষ হচ্ছে। বছরে সাড়ে পাঁচ কোটি কেজি চা উৎপন্ন হয়। এর অর্ধেকের বেশি দেশের বাজারে বিক্রি হয়, বাকিটা রফতানি হয় বিশ্ববাজারে। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ০.২ শতাংশ আসে চা-শিল্প থেকে। পৃথিবীর ৩০টি চা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নবম। বাংলাদেশের চা, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, সাইপ্রাস, সুইজারল্যান্ড, রাশিয়া, পোল্যান্ড, কাজাখস্তান, তাইওয়ান, ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যায়। দেড় লাখ লোক সরাসরি এ সেক্টরে কাজ করেন। তাদের ওপর প্রায় পাঁচ লাখ লোকের ভরণ-পোষণ নির্ভর করে।
এর পরও চা-শ্রমিকদের অবস্থা বড়ই করুণ। তারা বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে সপ্তাহে ছয় দিন ৮টা-৫টা কাজ করে থাকেন। এতে যা পান, তাতে কোনো মতে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটে। তাদের আয়-ব্যয় থাকলেও কোনো সঞ্চয় নেই, নেই তাদের বিনিয়োগ। তাদের অর্থনৈতিক অতীত যেমন ছিল অন্ধকার, তেমনি তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। তারা পেটে-ভাতে বেঁচে আছেন যুগ যুগ ধরে এবং এভাবেই হয়তো বেঁচে থাকতে হবে বাকি জীবন ধরে!
চা-বাগানে কর্মরত খ্রিষ্টান মিশনারিদের ইন্টারনেটে পোস্ট করা তথ্য অনুযায়ী, চা-শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্য সারা দেশে বিটিবি (বাংলাদেশ টি বোর্ড) মাত্র ১৫৩টি স্কুল চালায়। স্কুলগুলোর অবস্থা এতই করুণ যে, এগুলো থাকা না থাকা একই কথা। ঘর আছে তো দুয়ার নেই, বেঞ্চ আছে তো ডেস্ক নেই, চেয়ার আছে তো টেবিল নেই, ছাত্র আছে তো মাস্টার নেই, এমনই বেহাল!
প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের কমপক্ষে আধা পাকা ঘর থাকার কথা। কিন্তু চা-শ্রমিকদের থাকার ঘর মানুষের বসবাসের অনুপযোগী। তারা একটি মাত্র কাঁচা কক্ষে পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে বাস করে। কেউ কেউ আবার একই ঘরে গরু-ছাগল নিয়েও থাকেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের ওপর সালমান সায়ীদ একটি বিস্তারিত রিপোর্ট ইন্টারনেটে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘চা-শ্রমিকদের থাকার ঘর বাগানের ম্যানেজারদের পোষা কুকুর বেড়ালের ঘরের চেয়েও খারাপ।’ তাদের স্বাস্থ্যসেবা বলেও যে ব্যাপার আছে, সেটা না থাকারই মতো!
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত চা-শ্রমিকেরা মূলত সাঁওতাল, ওঁরাও, ও মুন্দা সম্প্রদায়ের লোক। তারা যখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুরমা ভ্যালিতে আসেন, তখন ডানকান ব্রাদার্সের সাথে তাদের চুক্তি ছিল মাত্র চার বছরের। যে চুক্তিনামায় তারা টিপসই দিয়েছিলেন তা তারা পড়তে পারেননি, জানতে ও বুঝতে পারেনি এর শর্তাবলি। বস্তুতপক্ষে তারা আজও জানেন না এমনকি জাদুকরি চারসালা চুক্তিতে তারা সায় দিয়েছিলেন, যার মেয়াদ দীর্ঘ দেড় শ’ বছরেও শেষ হচ্ছে না। তারা হারিয়েছেন তাদের পরিচয়, তাদের দেশ, সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি। তারা জানেন না নিজেদের ইতিহাস, আত্মপরিচয়। তাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও গোত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আজ তারা আগাছা-পরগাছার মতো বেঁচে আছেন ভিন দেশে। সময়ের পথ বেয়ে তারা কচুরিপানার মতো ভাটির টানে ভেসে ভেসে এত দূর চলে এসেছেন। পেছনে উজান ফেরার আর কোনো উপায় নেই! তারা সহজ, সরল, অশিক্ষিত ও গরিব। তারা যে দেশে থাকেন এর ভাষা সংস্কৃতি বোঝেন না, প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলতে জানেন না, তাদের সাথে মিশতে পারেন না। তারা হারিয়ে ফেলেছেন আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা। তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এতই নাজুক যে, তারা ১৮৫৪ সালের সেই প্রতারণার চুক্তি ছিন্ন করে মানুষের মতো বাঁচার অধিকার নিয়ে বেরিয়ে আসার সাহসটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন। আর তাই তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়েও পরাধীনতার নাগপাশে আজো আবদ্ধ। তারা শৃঙ্খলিত; তারা অবিচার, শোষণ ও বঞ্চনার চরম শিকার। আর পাঁচ-দশজনের মতো তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ নেই। তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, নেই বর্তমান। অতীত যাও বা একটু ছিল, বিস্মৃতির অতলে কবে তলিয়ে গেছে। এটা তারা নিজেরাও জানেন না, অন্য কেউ জানেন না, জানার প্রয়োজনও মনে করেন না।
চা-শ্রমিকেরা বাংলাদেশের নাগরিক। প্রতিটি নির্বাচনে ভোট দেন। তার পরও তারা দেশের সংবিধানে সংরক্ষিত মানবিক ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। জীবন জীবিকার জন্য পেশা নির্বাচনে অন্যদের মতো তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। চা-শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের চা-শ্রমিক হওয়া ছাড়া তেমন কোনো বিকল্পও নেই, তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার উপায় নেই, তারা বাংলাদেশের ভূসীমানার মধ্যে যেখানে ইচ্ছা সেখানে গিয়ে বসত করতে পারেন না। অর্থাৎ চা-শ্রমিকদের বেলায় দেশের সংবিধান ও আইন আদালত বলতে গেলে অপ্রাসঙ্গিক। এ অবস্থা নতুন নয়। এর ওপর বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। সরকারেরও অজানাও নয়। সরকার আসে, সরকার যায়, তারপরও চা-শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের কোনো আলামত দেখা যায় না।
বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের এই করুণ অবস্থা দেখলে মনে হয়, পৃথিবী যেভাবে তাবৎ জীববৈচিত্র্য আর বায়ুমণ্ডল নিয়ে অনন্তকাল ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে মহাশূন্যে মহাজাগতিক নিয়মের মধ্যে বাঁধা পড়ে, ঠিক সেভাবে এ দেশের ১৬৩টি চা-বাগানের শ্রমিক ও তাদের পোষ্যরা দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন আদালতের আওতার বাইরে গিয়ে কোনো এক নো ম্যান্স ল্যান্ডের ওপর নিরাশা আর হতাশার আবর্তে ঘুরছেন এবং এ ঘূর্ণন নিউটনের ‘ল অব মোশন’ মেনে চলতে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত!
লেখক : অধ্যাপক, টেনেশি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ;
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন