আমার আজকের লেখার শিরোনাম দেখে আপনারা যদি চমকে ওঠেন, তাহলে আমি একটুও বিস্মিত হবো না। এমন শিরোনামে আপনারা অবাক হতেই পারেন! অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘ভালোর ভয়’ এ আবার কেমন কথা? ভালো তো ভালোই। যা কিছু ভালো তা সবই তো সুন্দর, সবই তো মঙ্গলময়, সবই তো আনন্দময়! আমরা সবাই সব সময় ভালোটাই চাই। আর যা চাই, তা আবার ভয়ের হতে যাবে কেন’? উত্তরে আমি বলব, হতে পারে বৈকি! নিয়ম-কানুন, ন্যায়বিচার, শান্তি-শৃঙ্খলা, আনন্দ-উচ্ছ্বাস ইত্যাদিও যে মানুষের মনে ব্যথা-বেদনা এবং হতাশার জন্ম দিতে পারে সেটা ফুটিয়ে তোলাই এ নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য। ভালোও যে মানুষের জন্য কোনো দিন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, তা একটি উদাহরণ দিয়ে আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব। আর এ কাজটি যদি সঠিকভাবে সফলতার সাথে করতে পারি, তাহলে সেটাই হবে আমার আজকের এ লেখার সার্থকতা।
উনিশ শ’ চুরানব্বই সালে হলিউড থেকে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিল্ম রিলিজ পায়। পরে সেটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে। সিনেমাটির নাম, ‘দ্য শোশাঙ্ক রিডেমশন’। যারা ছবিটি দেখেননি, তাদের বোঝার সুবিধার জন্যে এর একটি সারসংক্ষেপ সংক্ষেপে বয়ান করছি। আমেরিকার একেবারে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত, মেইন অঙ্গরাজ্যের একটি কারাগারের নাম ‘শোশাঙ্ক স্টেট প্রিজন’। উনিশ শ’ চল্লিশ-এর দশকের শেষের দিক থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়টায় ওই কারাগারে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাবলি এ সিনেমার বিষয়বস্তু। কারাগারের নিরাপত্তা কর্মচারী, প্রধান কারা কর্মকর্তা, তাদের নিষ্ঠুরতা ও দুর্নীতি এবং কারাগারের অসংখ্য কয়েদিদের সুখ-দুঃখের প্রাত্যহিক জীবন নিয়ে এই ছবির গল্প এগিয়ে গেছে। কাহিনিটি লিখেছেন স্টিভেন কিং এবং এর পরিচালক, ফ্র্যাঙ্ক ড্যারাবন্ট। এরা দু’জনই নিজ নিজ জগতে অতি সুপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত।
সিনেমার যে চরিত্রটি আমার এই আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক, তার নাম ব্রুকস হ্যাটলেন। ছবির গল্প অনুযায়ী, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর কারাভোগ করার পর উনিশ শ’ ষাটের দশকের মাঝামাঝি কোনো একসময়ে, হ্যাটলেন জেল থেকে ছাড়া পান। অর্থাৎ তিনি ১৯১৫-১৬ সালের দিকে ‘শোশাঙ্ক স্টেট প্রিজনে’ কারাজীবন শুরু করেন। জেলখানায় কয়েদিদের জন্য ছিল একটি ছোট্ট লাইব্রেরি। হ্যাটলেন ছিলেন তার লাইব্রেরিয়ান। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর হ্যাটলেন বেঁচেছিলেন মাত্র অল্প কিছু দিন। ওই সময়ে তার আত্মীয়স্বজন এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা কেউ অবশিষ্ট ছিলেন কি না তা সিনেমার কাহিনী থেকে বোঝা যায় না। তবে যত দিন তিনি বেঁচেছিলেন, একেবারে একাই ছিলেন। মুক্ত হওয়ার পর তিনি যে দিকে যেতেন, শুধু অবাক হয়ে দেখতেন, পঞ্চাশ বছরে সব কিছু কিভাবে বদলে গেছে! সমাজ, দেশ, দেশের মানুষ, মানুষের চিন্তাভাবনা, জীবন-জীবিকা, এমনকি রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দালানকোঠা সব কিছুতেই তিনি আমূল পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি যেন তার আশপাশের কোনো কিছুই আর চিনতে পারছিলেন না, কোনো কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।
জেলজীবনের সাথে তুলনা করে, মুক্তজীবনে তার কাছে কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। কারাগারে যাওয়ার আগের কথা বলতে গিয়ে তিনি একসময় বলছেন, ‘ছোটবেলা আমি একটি গাড়ি দেখেছিলাম। আর এখন সব জায়গায় খালি গাড়ি আর গাড়ি। যেখানে যাই সেখানেই গাড়ি। গাড়ির জন্য রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে সাহস পাই না’। ‘ছোটবেলা আমি একটি গাড়ি দেখেছিলাম’ তার মানে তখন মাত্র গাড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে। গাড়ির দাম ছিল বেশি। মানুষের আয় ছিল কম, আর তাই গাড়ি ছিল নিতান্তই একটি দুর্লভ বস্তু। সে যা হোক, মুক্তজীবনে হ্যাটলেন একেবারেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। কি ঘরে কি বাইরে সবসময় তিনি ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন!
এ রকম এক মানসিক অবস্থায় হ্যাটলেন নিজেকে নিজে বলছেন, ‘আই ওয়ান্ট টু কমিট এনাদার ক্রাইম, সো দ্যাট দে উইল সেন্ড মি হোম’। অর্থাৎ তিনি আরেকটা অপরাধ করতে চান, তাহলে আইন আদালত তাকে ‘বাড়ি’ পাঠিয়ে দিবে। মজার ব্যাপার, এখানে হ্যাটলেনের মনস্তত্ত্ব লক্ষ করার মতো! পঞ্চাশ বছর কারাগারে থাকতে থাকতে, হ্যাটলেন কারাগারকেই মনে করছেন তার আপন ‘বাড়ি’ আর মুক্তজীবনের বাসগৃহকে মনে করছেন যন্ত্রণাদায়ক ‘কারাগার’। এটা যে হ্যাটলেন মুক্তজীবনে এসে প্রথম অনুভব করেছিলেন তাও নয়। জেলজীবনের শেষ দিকে তিনি বিষয়টি আগাম বুঝতে পেরেছিলেন বলেই মনে হয়। আর তাই কারাজীবনের মেয়াদ শেষে, ছাড়া পাওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি এক কয়েদির গলায় ছুরি ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, যাতে কারা কর্তৃপক্ষ তার মুক্তির আদেশ বাতিল করে আবারো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে দেয়। সহকয়েদিদের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের কারণে হ্যাটলেনের সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়। তিনি সময়মতো মুক্তি পেয়ে মুক্তজীবনে ফিরে আসেন।
কিন্তু দিনে দিনে মুক্তজীবন হ্যাটলেনের কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। স্বাধীন ও স্বাভাবিক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। জেলে (তার ভাষায় নিরাপদ ও শান্তিময় আপন ঘর) ফিরে যাওয়ার মতো কোনো অপরাধ করতে না পেরে অবশেষে হ্যাটলেন আত্মহত্যা করেন। হ্যাটলেন সিনেমার মূল চরিত্র ছিলেন না। ফলে তার মৃত্যুতে ছবির গল্পটি শেষ হয়ে যায়নি। মূল চরিত্রের ঘটনাবলি নিয়ে তার পরও কাহিনী আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি ‘দ্য শোশাঙ্ক রিডেমশন’ নায়িকাবিহীন পরিচ্ছন্ন এক বিরল ছায়াছবি।
এবার আসি আসল কথায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। চড়াই-উতরাই পার হয়ে দেশ অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার বছর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সরকার বাজেট দিয়েছিলেন মাত্র পাঁচ কি সাত শ’ কোটি টাকার। এখন সেই বাজেট হয় তিন লাখ কোটি টাকার ওপরে। আগে বাংলাদেশীদের গড় মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলারের নিচে আর এখন সেটা কোথায় উঠে এসেছে তা কারো অজানা নয়। সাক্ষরতা, শিশুমৃত্যু, নারীর ক্ষমতায়ন, জীবনপ্রত্যাশা, এমডিজি ইত্যাদি অনেক আর্থসামাজিক সূচকে বাংলাদেশ, ভারত পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে।
তারপরও সোনার দেশের রয়ে গেছে অনেক ব্যর্থতা, হতাশা ও বঞ্চনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিশ্বাস, অসম্মান আর সহিংসতা দিনে দিনে বাড়ছে বৈ কমছে না। কি বড় কি ছোট, সব দলেই নেতায় নেতায় অবিশ্বাস, অনাস্থা, মারামারি, এমনকি খুন-খারাবিও হচ্ছে এবং তা হচ্ছে অহরহ। প্রশাসনের একাংশে দুর্নীতি, অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও দলীয়করণ এক মারাত্মক মারণব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার-সমর্থক হলেই হলো, প্রমোশন পেতে যোগ্যতা লাগে না বললেই চলে। সরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় অবাধে নগদ টাকার লুণ্ঠন এক নতুন মাত্রায় উঠেছে। এ থেকে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও রেহাই পায়নি। সম্প্রতি নারী ও শিশুনির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সীমান্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুপ্তহত্যা লেগেইে আছে।
স্কুল, কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক শিক্ষিকার সংখ্যা বেড়েছে বটে, কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা নি¤œগামী। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের আগের মতো শ্রদ্ধা করে না, মান্য করে না। আইন আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা আগের চেয়ে অনেক কম। গরিবের পক্ষে সুবিচার পাওয়া যেন এখন সোনার পাথরবাটি। সরকার সমর্থকদের কাছাকাছি না থাকলে হত্যার বিচার পাওয়া যায় না। মানুষে মানুষে ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা কমেছে। সব ব্যাপারেই মানুষের ধৈর্য কমে গেছে। সমাজে হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা বেড়েছে।
টাকা ও বিত্ত-বৈভবকেই মানুষ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য করে ফেলেছে। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, দিনরাত টাকার ধান্ধায় মশগুল। ধনী-গরিবের বৈষম্যে কমতির কোনো আলামত নেই। যেকোনো বিচারে সমাজে নিষ্ঠুরতা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি। মা সন্তানকে বলি দিতে দ্বিধাবোধ করে না। ভাই-ভাইকে মারে, স্বামী-স্ত্রীকে খুন করে ও সহজেই মানুষ-মানুষকে শিয়াল কুকুরের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলে। সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় বেড়েছে। ইত্যাদি সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক দিক থেকে এগিয়ে গেলেও নীতিনৈতিকতা, আদর্শ ও মানবিকতার দিক থেকে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে। দেশের শাসনব্যবস্থা দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে। সুশাসন আজ রীতিমতো সুদূরপরাহত। গণতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হতে হতে এখন একেবারে ভেঙে পড়ার উপক্রম। সার্বিকভাবে মানুষের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়জীবনে অশান্তি ও অস্থিরতা দিনে দিনে বাড়ছে।
এ অবস্থায় আগামীতে অর্থাৎ আরো বিশ-ত্রিশ বছর পর কোনো লৌকিক কিংবা অলৌকিক কারণে দেশের জনগণ যদি সুখের মুখ দেখে। অর্থাৎ যদি সমাজে ও রাষ্ট্রে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে। দুর্নীতির পরিবর্তে সুনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। সত্যি সত্যি সব ক্ষেত্রে আইনের শাসন কায়েম হয়। মানুষে মানুষে প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসা ফিরে আসে। রাজনীতিতে হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে যদি শান্তি-শৃঙ্খলার সুবাতাস বইতে থাকে। তাহলে কী হবে?
সেই অবস্থা আমরা জীবনে দেখে যেতে পারব কি না জানি না, তবে এমন দিনে আমার ভয় হয়, বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্ত্ব ‘দ্য শোশাঙ্ক রিডেমশন’-এর হ্যাটলেনের মনের মতন হয়ে যায় কি না! অর্থাৎ দীর্ঘ দিন অস্বাভাবিক, অস্বাস্থ্যকর ও খারাপ পরিবেশে থাকতে থাকতে মানুষের কাছে ‘খারাপকে’ ভালো এবং ‘ভালোকে’ খারাপ মনে হতে পারে। আমার ভয় মিথ্যা হোক! আমার শঙ্কা অমূলক হোক! জনগণ ‘হ্যাটলেন সিনড্রোম’ থেকে মুক্ত থাকুক, নিরাপদ থাকুক! আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেই আজকের লেখার ইতি টানছি। আমার প্রচেষ্টায় সফল হলাম কি না সে বিচারের ভার আপনাদের ওপরই রইল।
অধ্যাপক, অর্থনীতি : টেনেশি স্টেট ইউনিভার্সিটি; যুক্তরাষ্ট্র; এডিটর : জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ; ইমেল:
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন